ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

মাথা ও রশির দূরত্ব কমে গেল

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ১৩ মার্চ ২০১৬

মাথা ও রশির দূরত্ব কমে গেল

ইংরেজীতে একটা কথা আছে- গধহ চৎড়ঢ়ড়ংবং নঁঃ এড়ফ উরংঢ়ড়ংবং, অর্থাৎ মানুষ নিজ নিজ ভাগ্য নির্ধারণের জন্য একরকম চেষ্টা করে, আর মহান সৃষ্টিকর্তা সবকিছু নিজের মতো করেই মীমাংসা করেন। একাত্তরের আলবদর কমান্ডার, ঘাতক যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলী নিজেকে ও তার গংদের রক্ষা করার জন্য কম চেষ্টা করেনি। কোটি কোটি টাকা দেশে-বিদেশে দু’হাতে বিলিয়েছেন। কিন্তু শেষ বিচারে মীর জাফরের উত্তরসূরি মীর কাশেম আলী নিজেকে রক্ষা করতে পারলেন না। গত ৮ মার্চ দেশের সর্বোচ্চ আদালত, আপিল বিভাগ মীর কাশেমের ফাঁসির দ- বহাল রেখেছে। ফলে ফাঁসির রশি আর মীর কাশেমের মাথার দূরুত্ব এখন ক্রমশ কমে যাচ্ছে। রাজাকারী মাথা আচ্ছাদিত হবে কালো রঙের যম টুপিতে, যে মাথা ব্যবহার করে মীর কাশেম আলী বাংলাদেশে টাকার পাহাড় গড়েছে। মানুষ হত্যাকারী, নারী ধর্ষণকারী ইসলামের খেদমতগারের বেশ ধরে টাকা কামিয়েছে। কথায় বলে পাপে ছাড়ে না বাপেরে। ভ-ামিরও শেষ আছে, আবার সেটা প্রমাণিত হলো। ১৯৭৫-এর পর থেকে গত ৪০ বছরে তাদের অর্থ সম্পদ এবং রাজনৈতিক কানেকশন ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ও শক্তিশালী হয়েছে, যার জন্য তারা সকলে ঔদ্ধত্যভরে আদালত প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে ভি চিহ্ন দেখিয়েছে। দম্ভভরে বলেছে তাদের কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। কিন্তু আজ তাদের সকল দম্ভ চুরমার। বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে একাত্তরে তারা যে চরম অপরাধ করেছে তার পরিণতি তাদের ভোগ করতেই হবে। টাকা, ডলার, রিয়াল কোন শক্তিই তাদের বাঁচাতে পারবে না। বাংলাদেশের মানুষের কাছে তাদের মাথানত করতে হবে। যেমনটি তারা করেছিল তাদের অভিভাবক পাকিস্তানী সেনাবাহিনীসহ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। রিয়াল এবং ডলারের ক্ষমতাবলে কাশেম আলীর অহঙ্কার ও আত্মবিশ্বাস অন্যদের থেকে অনেক বেশি ছিল। টাকার জোরে তাঁর দিগন্ত টেলিভিশনে (এখন বন্ধ) একজন বড় বীর ও বড় খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধাকে চাকরি দিয়েছিলেন, যিনি নিয়মিত দিগন্ত টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করতেন। তাতে রাজাকারের সাহসের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। দু’চারজন এমন মুক্তিযোদ্ধাকে এতবড় পদস্খলনের কারণেই কাশেম আলীরা বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে ‘ভি’ চিহ্ন দেখানোর সাহস পায়। তবে তাদের প্রধান ও মূল পৃষ্ঠপোষক ও পুনর্বাসনকারী ছিলেন একজন মুক্তিযুদ্ধকালীন ফোর্স কমান্ডার, বীর উত্তম খেতাবধারী। সুতরাং কাকে দোষ দেব। ঘরের শত্রু বিভীষণ। কিছু পদস্খলিত মুক্তিযোদ্ধারা যা করেছেন তা না হলে রাজাকার, আলবদর, জামায়াত-হেফাজত কোনদিন বাংলাদেশে ঠাঁই পেত না। খুনী যুদ্ধাপরাধীদের জঞ্জাল মাথায় নিয়ে একবিংশ শতাব্দীর গতির সঙ্গে তাল মিলানো যাবে না। মাথা থেকে কলঙ্কের বোঝা ফেলে দেয়ার জন্যই। দ্রুত রায় কার্যকর হওয়া প্রয়োজন। দিন গড়ালে ওরা রিয়াল, ডলারের জোর দেখানোর সুযোগ পাবে। এই রিয়াল ডলারের জোরেই মীর কাশেম আলী বেশি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের ‘ভি’ চিহ্ন দেখানো এবং অতি আত্মবিশ্বাসী হওয়ার আরেকটি বড় অভ্যন্তরীণ কারণ আছে। তাদের বড় শরিক বিএনপি শুরু থেকে বলতে থাকে এ বিচার কোনো দিন শেষ হবে না, এটা হলো আওয়ামী লীগ সরকারের চালবাজি। বোঝা যায় সেদিন বিএনপির নিশ্চয়তা পেয়েই তারা গৃহযুদ্ধের ভয় দেখায়, দেশব্যাপী আগুন জ্বালানোর হুমকি দেয়। এই হুমকির ধারাবাহিকতায় ট্রাইব্যুনাল থেকে সাঈদীর ফাঁসির পর জামায়াত-বিএনপি একইসঙ্গে সারাদেশে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করে। ২০১০ সালের মার্চ মাসে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়। প্রথম ধাপে গ্রেফতার হয় কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, নিজামী মুজাহিদ ও সাঈদী। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের নামও আসে প্রথম ধাপে। কিন্তু তার দূরদৃষ্টিকে অসাধারণ বলতে হবে। সে ঠিকই বাংলাদেশের মানুষের নাড়ি টিপে বুঝতে পারে এবার আর রক্ষা নেই। ঘরে বাইরে পথে ঘাটে টাকা ছড়িয়ে বাচ্চু রাজাকার পগার পাড়ি দেয়। বাচ্চু রাজাকারের সঙ্গে যারা রাজাকারী করল তাদের মানুষ চিনতে পারল না। এটাও এক ট্র্যাজেডি। বাচ্চু রাজাকার বুঝতে পারে ঘাড়ে মাথা একটাই। রক্ষা পেতে চাইলে পালানো ছাড়া উপায় নেই। ২০১০ সালে ট্রাইব্যুনালের শুরু এবং নিজামী মুজাহিদের গ্রেফতারের পর মীর কাশেম আলী লন্ডনে যায়, সরকারের মৃদু বাধা কাজে আসে না। ইচ্ছা করলে সে ওই সময়ে লন্ডনে থেকে যেতে পারত। মনে হয় রিয়াল ও ডলারের দাপটের অহঙ্কার ও জোরে কাশেম আলী দম্ভভরে বাংলাদেশে ফেরত আসে। বছরে ২৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে প্রকাশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করে আসে কাশেম আলী। ২৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধের রসিদের ছায়ালিপি বাংলাদেশের পত্রিকায় ছাপা হয়। কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনা ও দম্ভকে গুঁড়িয়ে দিয়ে কর্তৃপক্ষ ২০১২ সালের ১৭ জুন মীর কাশেম আলীকে গ্রেফতার করে। সোপর্দ করা হয় ট্রাইব্যুনালে। কাদের মোল্লার ফাঁসির প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিদেশ থেকে যেভাবে টেলিফোন আসে তাতে মনে হয় জামায়াতের ডলার কথা বলছে। বিশ্বের নামকরা একটা প্রতিষ্ঠান এ্যামেনিস্টি ইন্টারন্যাশনাল যখন বলে একাত্তরের রাজাকার আলবদরদের বিচার করলে মুক্তিযোদ্ধাদেরও বিচার করতে হবে তখন ধরেই নিতে হবে এসব প্রতিষ্ঠান জামায়াতের ডলারের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সময়ে এবং এখন মীর কাশেমের চূড়ান্ত রায়ের প্রাক্কালে দেশের ভেতরে বিচার প্রাঙ্গণেও রাজনৈতিক অঙ্গনে যে কথাবার্তা শোনা যায়, যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং যে গন্ধ বাতাসে ভাসতে থাকে তাতে অনেকেই শঙ্কিত হয়ে পড়ে। মনে হতে থাকে জামায়াতের টাকার কাছে বোধ হয় মানবতা, ন্যায়বিচার সবই পরাজিত হবে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ সময়মতো সজাগ হওয়ায় ষড়যন্ত্রকারীদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আর বাংলাদেশের নেতৃত্বে এখন আছেন বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানীরা ফাঁসির দড়ি দেখিয়েও কাবু করতে পারেনি। আর তাঁর মেয়ে বিশ্বের সব ক্ষমতাশালীদের সব তদবির উপেক্ষা করে ন্যায়বিচারকে উর্ধে তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের মর্যাদা রক্ষা করেছেন। কিন্তু যেতে হবে বহু দূর। পথ এখনও দুর্গম ও বহু লম্বা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথে দেশের অভ্যন্তরে সবচেয়ে বড় বাধা বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান। তারা এই যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর কম চেষ্টা করেনি। ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর রোড মার্চ শেষে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জনসভায় বেগম খালেদা জিয়া এই যুদ্ধাপরাধী সকলের নাম উচ্চারণ করে মুক্তি দাবি করেন। সমকাল-২০ অক্টোবর ২০১০। তারপর ২০১১ সালের তিন ডিসেম্বর মওদুদ আহমদ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে একই দাবি তোলেন। চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, আগামীতে জাতীয়তাবাদী শক্তি ক্ষমতায় গেলে এখন যারা বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আছেন তাদের সকলের বিচার করা হবে। তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে প্রবল জনমতের কারণে বিএনপি পূর্বের সরব বিরুদ্ধবাদিতা থেকে সরে এসে এখন নীরব অবস্থান নিয়েছে। বিশ্বের বোদ্ধা বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন বিএনপি আমলে নিচ্ছে না। ২০০৬ সালের ২৫ মার্চ ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা প্রতিবেদন ছেপেছিল। তার হেডলাইন ছিল ইধহমষধফবংয ধহফ ওহফরধ- অ চৎড়নষবস ঝযধৎবফ প্রকাশিত প্রতিবেদনের সঙ্গে একটা কার্টুনও ছিল। কার্টুনটিতে দেখা যায়, ইসলামিক টেরর লেখা একটা ঝাপি থেকে প্রকা- একটা বিষধর সাপ ফণা তুলছে, বিশাল হা করে আছে। হা করার কারণে লম্বা জিহ্বা ও তীক্ষè দুটি দাঁত বেরিয়ে আসছে, আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বেগম খালেদা জিয়া ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় আছে এবং হাত থেকে সাপ খেলানোর বাঁশিটি পড়ে যাচ্ছে। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াত-বিএনপি সরকারের সময় জামায়াত প্রসূত জঙ্গীগোষ্ঠীর সব তৎপরতাসহ ৬৩টি জেলার ৫২৫ স্থানে বোমা বিস্ফোরণের বিস্তারিত বর্ণনা ছিল ওই প্রতিবেদনে। যত তাড়াতাড়ি বিএনপি এই ভয়াবহতা উপলব্ধি করবে ততই দেশের জন্য মঙ্গল। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে দুইজন মন্ত্রী হওয়ার ফলে জামায়াতের জঙ্গীবাহিনী জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ যা দেখিয়েছে তাতে ওই ধারাবাহিকতায় আরেক মেয়াদে জামায়াত-বিএনপির ঘাড়ে ওঠে ক্ষমতায় থাকতে পারলে বাংলাদেশ এতদিন আরেকটি আফগানিস্তান, পাকিস্তান হতো। কিন্তু লেখার শুরুতে যেমন বলেছি, হয়ত সৃষ্টিকর্তাই বাংলাদেশকে রক্ষা করেছেন। কারণ, ৩০ লাখ মানুষের নিঃস্বার্থ অত্মোৎসর্গের লক্ষ্য বৃথা হয়ে যেতে পারে না। সুতরাং প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই জামায়াতের উইকেট পড়া শুরু হয়েছে কাদের মোল্লার ফাঁসির মাধ্যমে। আমাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন স্বঘোষিত খুনী অপরাধীরা রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকলে বিশ্ব দরবারে দেশের নাগরিকরা মর্যাদা পায় না। বিচারহীনতা ও অরাজকতার যে সংস্কৃতি ১৯৭৫ সালের পর রাষ্ট্রযন্ত্রে ঢুকেছে তার থেকে এখনও আমরা বের হতে পারছি না। ফলে অপকর্ম ঘটেই চলেছে। তবে আমরা ধাপে ধাপে এগোচ্ছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হলে অন্যতম বড় একটি ধাপ অতিক্রম করা হবে। এই অব্যাহত যাত্রার পথে মীর কাশেম আলীর চূড়ান্ত রায় অন্যতম মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। তাতে ওদের সম্পদশালী উইকেটের পতন হবে। টাকা, ডলার ও রিয়েলের জোরে মীর কাশেম আলী নিজেদের মাথা বাঁচাবার অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সব চেষ্টাই বিফলে যাওয়া প্রায় নিশ্চিত। ৮ মার্চের পর ফাঁসির রশি আর মাথার দূরত্ব অনেক কমে গেছে। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
×