ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মাঠে নেমেছে প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা

নিষেধাজ্ঞা জারি নিয়ে সিভিল এ্যাভিয়েশনে তোলপাড়

প্রকাশিত: ০৫:০০, ১২ মার্চ ২০১৬

নিষেধাজ্ঞা জারি নিয়ে সিভিল এ্যাভিয়েশনে তোলপাড়

আজাদ সুলায়মান ॥ বিমানের লন্ডন ফ্লাইটে কার্গো পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার ঘটনায় তোলপাড় চলছে। এতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়েও ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। পাশাপাশি বিমান এ নিষেধাজ্ঞার ফলে কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে পারে, কিভাবে সেটা পুষিয়ে আনা যায়, কত দ্রুততম সময়ে এটা চালু করা সম্ভব- এ সব কর্মকৌশল নির্ধারণ করছে। এদিকে যুক্তরাজ্য তিন মাস ধরে তাগিদ দেয়ার পরও কেন সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেনি সিভিল এভিয়েশন সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা এ ঘটনা তদন্তে মাঠে নেমেছে। সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম সানাউল হককে প্রত্যাহরের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তার পরিবর্তে বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা এয়ার ভাইস মার্শাল এহসানুল গনি চৌধুরীকে সিভিল এভিয়েশনের নতুন চেয়ারম্যান করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এমন এক পরিস্থিতিতে আগামীকাল (রবিবার) ঢাকায় আসছে যুক্তরাজ্যের এসিসি-৩ এর প্রতিনিধি। এ মাসের শেষ সপ্তাহে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের আরও একটি টিম। তাদের দেয়া পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভর করবে- কার্গো ফ্লাইটের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হবে কি হবে না। সিভিল এভিয়েশনের একাধিক নির্ভরশীল সূত্র জানায়, সরকার যুক্তরাজ্যের এ সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক মনে করলেও প্রকৃতপক্ষে হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় আন্তর্জাতিকমানের যে নয়, তাতে কোন সন্দেহ নেই। যুক্তরাজ্য বার বার তাগিদ দিলেও সিভিল এভিযেশন সে ঘাটতি পূরণে পাঁচ মাসেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। গৃহীত পদক্ষেপ বলতে-বিমানবাহিনী আনসার ও পুলিশ থেকে ধার কর্জ করে নেয়া ২৫০ জনের একটি যৌথবাহিনী মোতায়েন। এছাড়া কনকর্স হল বন্ধ করে দেয়া ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনি। এতে করে বিমানবন্দরের বাইরে হাজার হাজার দর্শনার্থী প্রতিদিন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকাটাও এক ধরনের নিরাপত্তা হুমকি বলে মনে করছেন ব্রিটিশ গোয়েন্দারা। এমনকি যুক্তরাজ্য সরাসরি কার্গো ফ্লাইট বন্ধ হবার পরও টনক নড়েনি সিভিল এভিয়েশনের। এদিকে গত বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের পশ্চিম পাশের এয়ারসাইট পরিদর্শনের সময় দেখা যায়- সেখানে এখনো হাজার হাজার লাগেজের স্তূপ পড়ে আছে, যা রীতিমতো নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি মনে করে যুক্তরাজ্য। এ বিষয়ে বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, খোলা আকাশের কার্গো পড়ে থাকা শুধু শাহজালালে নয় দুনিয়া জুড়েই পড়ে থাকে। সিঙ্গাপুরে তো প্রায়ই দেখা যায় মালামাল বাইরে পড়ে থাকতে। ব্রিটিশরা এ নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলেনি। সরেজমিনে পরিদর্শনের সময় দেখা যায়, রফতানি কার্গো ভিলেজের পশ্চিম পাশের খোলা আকাশের লাগেজের স্তূপ ছড়াতে ছড়াতে এয়ারসাইট পর্যন্ত ঠেকেছে। এসব কার্গো স্থানান্তরের কাজে জড়িত কাস্টমস ও ফ্রেইট ফরোয়াডের নিযুক্ত বহিরাগত শ্রমিক যারা সরকার নামে পরিচিত। বছরের পর বছর ধরে এসব শ্রমিক এখানে কাজ করতে গিয়ে অবাধে এয়ারসাইট পর্যন্ত যাতায়াতের সুযোগ পায়। এয়ারসাইট থেকে অবাধে রানওয়ে বা আরও স্পর্শকাতর এলাকায় যাবার সুযোগ থাকে তাদের যা নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকিস্বরূপ। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিজিএমই এর একজন প্রতিনিধি শুক্রবার জনকণ্ঠকে বলেন- এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনাল কাজের জন্য কতটা দ্রুত সময়ে নির্মাণকাজ শেষ করতে হবে সেটাই অনুধাবন করতে পারেনি সিভিল এভিয়েশনের দুর্নীতি আর লুটপাটে ব্যতিব্যস্ত কর্মকর্তারা। যুক্তরাজ্য বার বার তাগিদ দেবার পরও সিভিল এভিয়েশন রহস্যময় কারণে তৎপর এ ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় থাকে। কারণ কার্গো ভিলেজের অপারেশনাল কাজটি করে বিমান। কিন্তু অবকাঠামোগত সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার একক কর্তৃত্ব সিভিল এভিয়েশনের। গত এক বছর ধরে সিভিল এভিয়েশনের শীর্ষকর্তারা বিমানের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণের দরুন সেমি অটোমেশনের অংশ হিসেবে ওয়ারহাউসের র‌্যাকের পেলেট নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে বার বার বিমান তাগিদ দিয়েও গত তিন বছরে ওটা নির্মাণ অনুমোদন দেয়নি সিভিল এভিয়েশন। একইভাবে কার্গো ভবনে সংয্ক্তু স্ক্যানার ও ইটিডি (এক্সপ্লোসিভ টেস্ট ডিটেকশন) অপারেট করার কাজে নিযুক্ত অদক্ষ জনবল নিয়েও প্রশ্ন তোলে যুক্তরাজ্য। এ বিষয়ে গত নভেম্বরে যুক্তরাজ্যের প্রথম গোয়েন্দা টিম কার্গো পরিদর্শনের পর কিছু পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশমালা তৈরি করে। তখন সিভিল এভিয়েশন ওই টিমকে এমন কিছু তথ্য দেয় যা পরবর্তীতে মিথ্যা বলে প্রতীয়মান হয়। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে জনৈক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, “যুক্তরাজ্য যতটা না ক্ষুব্ধ হয়েছে নিরাপত্তার ঘাটতি পূরণ না করায়- তার চেয়ে বেশি ক্ষেপেছে সিভিল এভিয়েশনের মিথ্যাচারের দরুন। যেমন য্ক্তুরাজ্যের টিম জানতে চেয়েছিল ইটিডি পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবল মোতায়েন করা হয়েছে কিনা। জবাবে সিভিল এভিয়েশন জানিয়েছে- এটিও পূরণ করা হয়েছে। কিন্তু সর্বশেষ ওই টিমের পরিদর্শনের সময়ও দেখা যায় পরিস্থিতি আগের মতোই। সিভিল এভিয়েশনের এহেন মিথ্যাচারের দরুন যুক্তরাজ্যের টিম প্রচ- ক্ষুব্ধ হয়। এদিকে আগামীকাল ঢাকায় আসছে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে সরাসরি কার্গো রফতানি করতে প্রয়োজনীয় সনদ দেয়ার রেগুলটারি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার কার্গো সিকিউরিটি-৩ (এসিসি) এর প্রতিনিধি। তিনি ঢাকায় কয়েকদিন অবস্থান করে শাহজালাল বিমানবন্দর ও কার্গো হাউজে নিয়মিত পরিদর্শন করবেন। সর্বশেষ নেয়া নিরাপত্তা সংক্রান্ত পদক্ষেপগুলো পর্যবেক্ষণ করবেন। স্বচক্ষে দেখবেন কিভাবে ইটিডি ও স্ক্যানার অপারেট করা হয়। বিমান সূত্র জানায়, এই টিমের দেয়া প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করছে যুক্তরাজ্যে সরাসরি কার্গো পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে কি হবেনা। এ টিম যদি সন্তোষজনক হয়ে ইতিবাচক প্রতিবেদন দাখিল করে, তাহলে আগামী মাস থেকেই ফের চালু হতে পারে য্্্্ুক্তরাজ্যে সরাসরি কার্গো ফ্লাইট। উল্লেখ্য, গত জানুয়ারিতে ৩ মাসের জন্য বিমানকে এই সনদ দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কার্গো কমপ্লেক্সের অটোমেশনের সরঞ্জামাদি ও দক্ষ জনবল কাঠামো ঠিক না হলে মার্চের পর তারা আর এই সনদ নবায়নও কঠিন হয়ে যেতে পারে। গত ১৯ ডিসেম্বরের পর বিমানের কার্গো ভিলেজ থেকে শুধু মরদেহ ও ২ গ্রাম ওজনের কূটনৈতিক ডকুমেন্ট ছাড়া অন্য কোন পণ্য অষ্ট্রেলিয়া যাছে না। এ কারণে কার্গো রফতানি টার্মিনালে অস্ট্রেলিয়াগামী রফতানীযোগ্য পণ্যের স্তূপ জমে গেছে। বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ীরা অন্য পথে তাদের পন্য পাঠানোর চেষ্ঠা করছেন। এতে অধিকাংশ ব্যবসায়ীকেই লোকসান গুনতে হচ্ছে। এছাড়া ওই টিম বিদায় নেবার পর বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করতে এ মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকা আসছে দুটি মার্কিন প্রতিনিধি দল। আগামী ২২ ও ২৩ মার্চ তাদের ঢাকায় আসার কথা রয়েছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা সাইবার নিরাপত্তাসহ অন্যান্য বিষয় নিয়েও আলোচনা করবেন। এ প্রতিনিধি দলের সফর নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। এরই মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে সাক্ষাত করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আলাপ সেরেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্টিফেন মার্শা ব্লমি বার্নিকার্ট। সম্প্রতি বিমানবন্দর নিরাপত্তা নিয়ে বিদেশিদের প্রশ্নের মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। নিরাপত্তার অজুহাতে গত মঙ্গলবার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে সরাসরি বিমানের ফ্লাইট বন্ধ করে দেয় যুক্তরাজ্য। এ বিষয়ে ক্রমাগত উদ্বেগ জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যরাও। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি ও বাংলাদেশে এটিএম কার্ড জালিয়াতি নিয়ে সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকিও এখন আলোচিত বিষয়। যা নিয়ে ইমেজ সঙ্কটে রয়েছে বাংলাদেশ। ওই সফরকালে তথ্যপ্রযুক্তি ও সাইবার নিরাপত্তা এবং সাইবার আইন সংশিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করবে প্রতিনিধি দল। পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দলে তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা থাকবেন। আর মাসের শেষে বাংলাদেশ সফর করবেন মার্কিন স্বরাষ্ট্র দফতরের আন্তর্জাতিক বিষয়ক এ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ও প্রধান কূটনৈতিক কর্মকর্তা এ্যালান বারসিনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল। তাদের সঙ্গে আলোচনাতেই মূলত বিমানবন্দরের নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য পাবে বলে আভাস দিয়েছে ঢাকার কূটনীতিক মহল।
×