ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভিসা কার্যক্রম দিল্লীতে সরিয়ে নেয়ার পর কার্গো বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞাসহ নেতিবাচক বিভিন্ন পদক্ষেপ

অশনি সঙ্কেত

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ১২ মার্চ ২০১৬

অশনি সঙ্কেত

তৌহিদুর রহমান ॥ ঢাকা থেকে ভিসা কার্যক্রম দিল্লীতে সরিয়ে নেয়া, ঢাকা-লন্ডন কার্গো বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা, ঢাকা-লন্ডন বিমান চলাচল বন্ধে হুঁশিয়ারি, দফায় দফায় ভ্রমণ সতর্ক বার্তা জারি ইত্যাদি কার্যক্রমে ঢাকা-লন্ডন কূটনৈতিক সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ব্রিটিশ সরকার থেকে নেয়া এসব কার্যক্রমে বিব্রতবোধ করছে সরকার। এগুলো ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ঘটনায় যুক্তরাজ্য সরকার থেকে বাংলাদেশকে চাপে রাখার নতুন নতুন কৌশল কি-না সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এদিকে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে ডেভিড ক্যামেরনের চিঠির জবাব দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া বিমানবন্দর পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার জন্য আগামীকাল রবিবার ঢাকায় আসছে একটি ব্রিটিশ নিরাপত্তা প্রতিনিধি দল। যুক্তরাজ্য সরকার থেকে ঢাকা-লন্ডন কার্গো বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষিতে সরকার থেকে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের দেখানো কারণ পুরোপুরি অযৌক্তিক। এই নিষেধাজ্ঞা অবিলম্বে প্রত্যাহার করা উচিত বলেও মনে করে বাংলাদেশ। শুধুমাত্র নিরাপত্তার কারণে বিমান চলাচল বন্ধ এটা কোন যৌক্তিক কারণ হতে পারে না। এর পেছনে অন্য কারণ থাকতে পারে বলেও সরকার থেকে আভাস দেয়া হয়েছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেছেন, কার্গো বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞায় যুক্তরাজ্যের দেখানো কারণ যৌক্তিক নয়। এই নিষেধাজ্ঞা অবিলম্বে প্রত্যাহার করা উচিত। বাংলাদেশ সরকার তেমনই আশা করছে। নিষেধাজ্ঞার পেছনে নিরাপত্তাহীনতা মূল কারণ হতে পারে না। আমাদের বিমানবন্দরে নিরাপত্তা পরিস্থিতি অনেক ভাল। ২০১৪ সালের ২৩ জুলাই যুক্তরাজ্য সফর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠকে ডেভিড ক্যামেরন জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যুক্তরাজ্য সব সময় পাশে থাকবে। বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার হতে চায় যুক্তরাজ্য। সে সময় দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে বৈঠকে আন্তরিকতার কোন অভাব ছিল না। এমনকি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে কোন আলোচনাই হয়নি দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে। তারপর থেকে বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে যুক্তরাজ্য সরকারের অর্থসহায়তা অব্যাহত থাকলেও ব্রিটিশ সরকারের সম্প্রতি নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপে বিব্রতবোধ করছে বাংলাদেশ। ব্রিটিশ সরকার থেকে এসব নির্দেশনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে চাপে রাখার নতুন নতুন কৌশল কি-না সেটাও এখন খতিয়ে দেখছে সরকারের নীতি নির্ধারকরা। কেননা মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিক স্টেট (আইএস) উত্থানের পর বিশ্বজুড়ে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। আর ব্রিটিশ সরকার শুধু বাংলাদেশেই বিমান পরিচালনা করছে না। বিশ্বের অন্য কোন দেশে বিমান ও কার্গো বিমান চলাচল বন্ধ না করলেও দেশটি বাংলাদেশেই কার্গো বিমান চলাচলের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এদিকে ঢাকা থেকে দিল্লীতে ভিসা সেন্টার সরিয়ে নেয়ার পরে বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের ভিসা পেতে সমস্যা হচ্ছে। এই সমস্যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। যুক্তরাজ্যে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশীদের ভিসার আবেদন ঢাকা ও সিলেটে জমা ও প্রদান কার্যক্রম চললেও ভিসার মূল সার্ভার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে দিল্লী থেকে। যুক্তরাজ্যের ভিসা আবেদনকারীদের অভিযোগ, ভিসা কার্যক্রম দিল্লী থেকে পরিচালিত হওয়ার পর ভিসা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে যুক্তরাজ্য সরকার থেকে বলা হয়েছে, তাদের সরকারের খরচ কমানোর লক্ষ্যে ভিসার সার্ভার দিল্লীতে নেয়া হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশের ভিসা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ভিসা পেতে কোন সমস্যা হবে না বলে জানিয়েছিল যুক্তরাজ্য। তবে ভিসা কার্যক্রম দিল্লীতে নেয়ার পর থেকেই যুক্তরাজ্যের ভিসা হ্রাস পেয়েছে। অনেকেই যুক্তরাজ্যে সেমিনার ও কনফারেন্সে যোগ দেয়ার জন্য ভিসা আবেদন করে অনুষ্ঠানের নির্ধারিত তারিখ পেরিয়ে যাওয়ার পরে ভিসা পাচ্ছেন। সে কারণে নির্ধারিত অনুষ্ঠানেই যোগ দিতে পারছেন না। এ নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্তরাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ঢাকায় নতুন ব্রিটিশ হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেকের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রথম সাক্ষাতের সময়েই ভিসার বিষয়টি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তোলা হয়। সে সময় ব্রিটিশ হাইকমিশনার ভিসা সহজ করার বিষয়ে আশ্বাস দেন। তবে সহজ করার আশ্বাস দিলেও ভিসা সহজে মিলছে না বলে অভিযোগ অব্যাহত রয়েছে। ব্রিটিশ ভিসা নিয়ে যখন সমস্যা অব্যাহত রয়েছে, ঠিক তখনই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে ব্রিটিশ সরকার। ইতোমধ্যেই কয়েকবার ব্রিটিশ নিরাপত্তা প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করেছেন। ব্রিটিশ এভিয়েশনের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের লিয়াজোঁ অফিসার জন লাভসে গত নবেম্বরে ঢাকা বিমানবন্দর পরিদর্শনে আসেন। ফিরে যাওয়ার আগে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য বেশকিছু সুপারিশ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, যাত্রী পরিবহন সংক্রান্ত বিভিন্ন নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়। তিনি ঢাকা থেকে ফিরে গিয়ে যে প্রতিবেদন দেন, সেখানে উল্লেখ করা হয়, যাত্রীদের সঠিকভাবে স্ক্যানিং করা হয় না। মালামাল ট্যাগ করার যন্ত্রপাতিও ব্যবহার করা হয় না। বিমানবন্দরে যারা স্ক্যান করেন তারা অন্যদিকে তাকিয়ে থাকেন, বসে বসে টেলিফোনে কথা বলেন, অন্য লোকের সঙ্গে গল্প করেন, তাদের প্রশিক্ষণ নেই ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী একজন কর্মী ২০ মিনিট স্ক্যান করার পরে তাকে ৪০ মিনিট বিশ্রাম দিতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে লোকবল কম থাকায় এক বা দুই ঘণ্টা একটানা কাজ করতে হয়। যুক্তরাজ্যের ওই প্রতিবেদন দেয়ার পর বাংলাদেশ থেকে মালবাহী বিমান পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে অস্ট্রেলিয়া। গত বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি আবারও ঢাকায় আসেন জন লাভসে। এবার তিনি কার্গো পরিবহনের বিষয়ে সুপারিশ করে প্রতিবেদন দেন। তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কার্গো রাখার জায়গায় বেসরকারী ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার প্রতিষ্ঠানের লোকেরা কাজ করেন, নিরাপত্তা ট্যাগ লাগানোর মেশিন ব্যবহার করা হয় না এবং কার্গো ওয়ারহাউসের বাইরে মালামাল স্তূপ করে রাখা হয়। বিমানবন্দরে এক্সপ্লোসিভ ট্রেসিং মেশিনও কাজ করে না। এছাড়া এ সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত লোকদের সুষ্ঠু প্রশিক্ষণ নেই বলেও জানানো হয়। কার্গো রাখার জায়গায় ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার প্রতিষ্ঠানের বেসরকারী লোকদের সরিয়ে নিতে বলা হয়, নিরাপত্তা ট্যাগ লাগানোর মেশিন ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়া হয়। কার্গো ওয়ারহাউসের বাইরে সব মালামাল ভেতরে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। তবে ব্রিটিশ সরকারের এই প্রতিবেদনকে আমলে নেয় বাংলাদেশ। সে কারণে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা পরিবেশকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর জন্য সরকার থেকে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে কার্গো বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে ব্রিটিশ সরকার। যুক্তরাজ্যে সরাসরি পণ্য পরিবহনে কার্গো চলাচলে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তৈরি পোশাক মালিকরা। তাঁরা বলছেন, কার্গো চলাচলে নিষেধাজ্ঞার কারণে নিশ্চিতভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে পোশাক রফতানি কমারও আশঙ্কা করছেন তাঁরা। গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ থেকে তিনশ’ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়। যা ওই সময়ের মোট পোশাক রফতানির ১১ দশমিক ৩৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এই বাজারে প্রায় দুইশ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে যুক্তরাজ্যের বাজার বাংলাদেশের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন কারণে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সমুদ্রপথে পণ্য পাঠানো সম্ভব হয় না। তখন ব্যবসায়ীদের নিজেদের খরচে বিমানে পণ্য পাঠাতে হয়। যুক্তরাজ্যের এই নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সিঙ্গাপুর, হংকং, থাইল্যান্ড ও দুবাই হয়ে পণ্য পাঠাতে হবে। এতে করে একদিকে খরচ বাড়বে, অন্যদিকে সময়ও বেশি লাগবে। এতে বাংলাদেশের প্রতিযোগী সক্ষমতাও কমে আসবে। ফলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এদিকে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে আগামীকাল রবিবার ব্রিটিশ নিরাপত্তা প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসছে। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখবেন। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যৌথ কর্মপরিকল্পনার বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখবেন। প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। বিমানবন্দরের পরিস্থিতি তুলে ধরে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যে চিঠি দিয়েছেন সেখানে উল্লেখ করেছেন, গত বছর নবেম্বরে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে কয়েক দফা বাংলাদেশ সফর করেছেন। তারা প্রাথমিকভাবে নিরাপত্তার ঘাটতি চিহ্নিত করেছেন। পাশাপাশি তৈরি করেছেন কর্মপরিকল্পনা। সন্ত্রাসের ব্যাপারে ন্যূনতম ছাড় না দিতে শেখ হাসিনার সরকারের নীতির ধারাবাহিকতায় যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ায় এটা স্পষ্ট যে, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা সমস্যা দূর করতে শেখ হাসিনা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তারা সর্বশেষ মূল্যায়নে নিরাপত্তা উদ্বেগ দূর করার প্রশ্নে বড় ধরনের ঘাটতির উল্লেখ করেছেন। ক্যামেরন উল্লেখ করেন, মিসর ও সোমালিয়ায় বিমানে হামলার পর বিষয়টি তাদের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। তিনি প্রশিক্ষিত নিরাপত্তাকর্মী ও যথাযথ নজরদারির ঘাটতিকে মূল সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ডেভিড ক্যামেরনের চিঠির জবাব দেবে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে ডেভিড ক্যামেরনকে একটি চিঠি দেবেন। চিঠিতে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা উন্নয়নে সরকার থেকে কি কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উল্লেখ্য, বঙ্গোপসাগরের নাজিরাটেক পয়েন্টে অভ্যন্তরীণ কার্গো বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর যুক্তরাজ্যের সরকারী ওয়েবসাইটে কার্গো বিমান চলাচলে দেশটির নিষেধাজ্ঞার কথা জানানো হয়। ‘বাংলাদেশ বিমানবন্দরের হালনাগাদ তথ্য’ শীর্ষক ঘোষণাটিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় কিছু বিষয়ে এখনও ঘাটতি রয়েছে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত ঢাকা থেকে যুক্তরাজ্যে সরাসরি কার্গো পরিবহন করতে দেয়া হবে না। তবে অন্যদেশ হয়ে যুক্তরাজ্যে যাওয়া যাবে। এই নির্দেশনার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এখন নড়েচড়ে বসেছে।
×