ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দেবতার সামনে কিছুক্ষণ

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ১২ মার্চ ২০১৬

দেবতার সামনে কিছুক্ষণ

দেবতার সামনে প্রায় ৩০ মিনিট। ১৯৭৩ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের ২ দিন পরে আমি, আমার দাদা টাঙ্গাইল-৪ আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী সাহেবের প্রচার শেষে ও ক্ষুদ্র ব্যবধানে বিজয়ী হয়ে ঢাকা শহরের ৩২ নম্বরের বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর বাসায় দেখা করতে যাচ্ছিলাম। আসলে দাদা লতিফ সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর কাছে যাবেন, সেইসঙ্গে আমরা ৭-৮ জনও। যতদূর মনে পড়ে দিনটা ছিল ৯ মার্চ, ১৯৭৩। ১ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুটো আসনেই তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হয়েছিল। একটি দাউদকান্দিতে খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং আবদুর রশিদ ইঞ্জিনিয়ারের মধ্যে, আরেকটি হয়েছিল টাঙ্গাইল-৪ আসনে, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এবং শাজাহান সিরাজের মধ্যে। আমি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র। দাদার নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়ার জন্য নির্বাচনের ১০ দিন আগেই কালীহাতি পৌঁছে যাই। মজার ব্যাপার হলো, জাসদ তার মনোনীত মশালের প্রার্থী শাজাহান সিরাজের জন্য পুরো বাংলাদেশের সামগ্রিক শক্তি নিয়োগ করেছিল কালীহাতিতে। যেখানে তাদের সশস্ত্র ক্যাডার, রাজনৈতিক নেতা এবং কর্মী প্রায় সবাই ছিলেন। লতিফ সিদ্দিকী এবং শাজাহান সিরাজের সম্পর্ক হলো গুরু-শিষ্যের অর্থাৎ টাঙ্গাইল করোটিয়া কলেজে লতিফ সিদ্দিকী শাজাহান সিরাজকে রাজনীতিতে হাতেখড়ি দেন। যে কোন কারণেই হোক দাদা শাজাহান সিরাজের সঙ্গে নির্বাচন করে হেরে যাবেন এটা মনে হয় মেনেই নিতে পারছিলেন না। নৌকার জনপ্রিয়তা, দাদার জনপ্রিয়তা সব মিলে আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমরা প্রায় দু’ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হই। আমরা যখন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর সামনে বসে আছি ঠিক তখনই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সামনে তাঁর শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য এসে হাজির হলেন আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এবং প্রখ্যাত চিকিৎসাবিদ তৎকালীন পিজি হাসপাতালের পরিচালক নুরুল ইসলাম স্যার। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন আসনে নির্বাচিত সংসদ সদস্য, দু’-একজন সরকারী আমলা, সবার সঙ্গে একই সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছিলেন। মনে হচ্ছিল কয়েকটা মস্তিষ্কের সংযোগে এবং কয়েকটি স্পিচ অর্গান বঙ্গবন্ধুর ভেতরে লুক্কায়িত আছে। উনি যখন কথা বলে যাচ্ছিলেন কোন অসঙ্গতি একজন চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্র হিসেবে আমি দেখিনি, বরং বারবার মনে হচ্ছিল কি করে এত লোকের সঙ্গে একই সঙ্গে, একই তালে কথা বলে যাচ্ছেন। ছোটবেলায় আমরা শুনেছিলাম যে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার লেখার জন্য ৫-৭ জন প-িতকে একসঙ্গে কাগজ-কলম দিয়ে বসিয়ে দিতেন এবং সবাইকে ডিকটেশন দিতেন। আর বঙ্গবন্ধু যেভাবে কথা বলছিলেন সেটা দেখে মনে হচ্ছিল যে উনিও বোধ হয় একজন মাইকেল মধুসূদন। নুরুল ইসলাম স্যারকে দেখেই উনি একই তালে বললেন যে, প্রফেসর সাহেব আমি সুস্থ আছি। আসলে আমার এইসব লোকজন, আমার আশপাশে থাকে তারাই আমাকে অসুস্থ বানিয়ে ফেলছে। কিছু না হতেই আপনাকে ডাকতে বলে। আচ্ছা প্রফেসর সাহেব, আপনি এই পিজি হাসপাতালটাকে মহাখালী, শেরে-বাংলানগর অথবা সাভারের কাছাকাছি কোন জায়গায় কয়েকশত বিঘা জায়গা নিয়ে গড়ে তুলতে পারেন না? আপনি একটা হোটেলের ভেতরে এই পিজি হাসপাতাল করে রেখেছেন! আপনি কি দেখেননি করাচীতে জিন্নাহ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট? আমি যখন পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে থেকে অসুস্থ হতাম আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হতো। সেই পরিবেশটা কত সুন্দর। জাতীয় প্রফেসর নুরুল ইসলাম স্যার নিশ্চুপ রইলেন। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, যেই বঙ্গবন্ধুর সামনে আসছে তিনি তার নাম ধরে ডাকছেন, কেমন আছিস জিজ্ঞেস করছেন, কাউকে কাউকে তাদের ছদ্মনাম ধরে ডাকছেন। আমাদের সামনেই নোয়াখালীর একজন আওয়ামী লীগ নেতা, টেবিলের নিচে হামাগুড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পা ছুঁয়ে দোয়া নিচ্ছেন। বন্ধবন্ধু তখন হেসে বলে উঠলেন, ‘তুই কি সবসময়ই টেবিলের নিচ দিয়ে সালাম করবি’? অমনি উপস্থিত সবাই হেসে উঠলেন। যেহেতু আমি গত ৬ বছর দু’ দফা ২০০৯ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে কাজ করেছি, আমি হারে হারে টের পেয়েছি যে, ভৌত অবকাঠামো যে কোন কিছু সম্প্রসারণের জন্য কত প্রয়োজন। আর পিজি হাসপাতালের চারধারে ভৌত অবকাঠামো সম্প্রসারণের জন্য সরকার যত চেষ্টাই করুক এখন আর কিন্তু কোন জমি একুইজিশন করতে পারবে না। আমি বিস্মিত হয়ে ভাবি একজন রাজনীতিবিদ, শুধুু রাজনীতিবিদ নন, রাজনীতির দার্শনিক না হলে, সমাজবিজ্ঞানী না হলে এই চিন্তাটা ওনার মাথায় কোন অবস্থাতেই আসত না। অথচ আমরা চিকিৎসক হয়ে ওনার এই উপদেশ বা ওনার এই ধ্যান-ধারণার কোন মূল্যায়ন করিনি। ১৯৭৩ সালে মহাখালী থেকে শুরু করে উত্তর দিকে যত খুশি তত জায়গাই নেয়া যেত। কারণ সে জায়গাগুলো ছিল জলাশয়, পতিত জমি এবং সব সরকারী জমি। যা আজ বস্তি হিসেবে মানুষ উপভোগ করছে। যা আজকে মস্তানদের দখলে। সুতরাং ঐ দেবতার নির্দেশ আমাদের অক্ষরে অক্ষরে পালন করা উচিত ছিল। যেরকমটা আমরা ১৯৭১ সালে পালন করেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর সেই অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উনি এক জায়গায় বলেছেন, ‘মহৎ কিছু অর্জনের জন্য মহান ত্যাগের প্রয়োজন।’ আমার মনে হয় সেদিন আমাদের প্রিয় শিক্ষাগুরু নুরুল ইসলাম স্যার সেন্ট্রাল রোড থেকে শাহবাগ পর্যন্ত দূরত্বটাকে অনেক বড় ভেবেছিলেন। উনি তার সম্প্রসারণের জন্য যদি কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত জায়গাগুলোতে পিজি হাসপাতাল স্থানান্তর করতেন তাহলে আজকে এটাও একটা সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে পারত। দ্বিতীয়টি, উনি যেটা বললেন সেটা হলো দাদা লতিফ সিদ্দিকীকে উদ্দেশ করে, ‘লতিফ তোমার কানের কাছ দিয়ে গুলিটা চলে গেছে। যদি হেরে আসতা আমি তোমাকে গুলি করে মারতাম। আজ থেকে আমার নির্দেশ যতটুকু পার সময় তুমি কালীহাতিতে ব্যয় করবে। তোমার কুমার জীবনের অবসান ঘটাবে নতুবা তোমার রাজনৈতিক শিষ্যের কাছে তোমাকে কখনও না কখনও ধরাশায়ী হতে হবে।’ বঙ্গবন্ধুর এই অমীয় বাণী সত্য হয়েছিল। দাদা কিন্তু দু’বার শাজাহান সিরাজের সঙ্গে নির্বাচনে হেরেছিলেন। আমরা উঠে আসার মুহূর্তে যখন ওনাকে প্রণাম করি। তখন দাদা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন চট্টগ্রাম থেকে আমার নির্বাচনের জন্য কালীহাতি এসেছিল, মেডিক্যালের ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা এবং ৭১-এর ১৩ নবেম্বর বাবাকে হারিয়েছে। এ সব শুনে জাতির পিতা দাদাকে বললেনÑ ‘প্রাণ গোপালের যেন লেখাপড়া চালিয়ে যেতে কোন অসুবিধা না হয়। এটা দেখার দায়িত্ব কিন্তু লতিফ তোর।’ আমার সঙ্গে পৃথিবীর কোন বিখ্যাত দার্শনিকের পরিচয় ছিল না। যেহেতু চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্র চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আমার ওঠা-পড়া, তবে যে সব দার্শনিকের জীবনী পড়েছি তা থেকে মনে হয় যে, আমার দেবতার দার্শনিকতত্ত্ব তাদের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না, বরং বহু অংশে বেশি ছিল। কেননা, তিনি একটি জাতিকে মুক্তির স্বাদ দিয়েছেন। একটি স্বাধীন ভূখ-রেখা তৈরি করে দিয়েছেন। স্বল্প সময়, অধিক রক্তক্ষয়, বিস্ময়কর সার্বিক ত্যাগের মাধ্যমে তা সম্ভব হয়েছে। ত্রিশ মিনিটের সেই উপস্থিতিটি আমার কাছে এক বিরাট প্রাপ্তি, সুন্দর এক মুহূর্তের সত্য, যাতে আমার মতো এক ক্ষুদ্র মানবসন্তানের স্বপ্ন এক মহান ব্যক্তির মহৎ স্বপ্নের দ্বারা আলিঙ্গনাবদ্ধ হলো। এই বিরল মুহূর্তটি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। যদিও বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় কারও প্রাপ্তিতে তৃপ্তি নেই, আরও চাই। আরও চাই! লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×