ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অগ্নিঝরা মার্চ

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১১ মার্চ ২০১৬

অগ্নিঝরা মার্চ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ‘বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষè করো চিত্ত/ বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।’ ১১ মার্চ, ১৯৭১। অগ্নিবিদ্রোহে টালমাটাল পুরো দেশ। কবির এই উজ্জীবনীমন্ত্রে দীপ্ত জাতি প্রতিবাদে-প্রতিরোধে তখন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। স্বাধীনতার আন্দোলন ক্রমেই উত্তাল থেকে উত্তালতর হতে থাকে। শান্তিপূর্ণভাবে অসহযোগ আন্দোলন সফল হওয়ায় বঙ্গবন্ধুর ওপর দেশবাসীর আস্থা বেড়ে যায় অনেক। পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ, নিপীড়ন-বঞ্চনার বিরুদ্ধে অগ্নিবিদ্রোহের চূড়ান্ত রণপ্রস্তুতি চলছিল। একাত্তরের এ সময়টায় বাঙালী জাতির মুখ্য চিন্তা ও লক্ষ্য তখন একটাই ছিল- ‘স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ’। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান অনেক আগেই পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। একমাত্র সেনা ছাউনি ছাড়া টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া কোথাও পাকিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। পুরো দেশ, মানুষ চলছিল একমাত্র এক ব্যক্তির নির্দেশে, তিনি হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ও সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু ও আদেশ উপেক্ষা করেই সব দোকানপাট, অফিস-আদালত, কল-কারখানা, কোর্ট-কাছারি বন্ধ রাখা হয়। একাত্তরের এই দিনে ন্যাপ (ওয়ালী) বাংলাদেশ শাখার সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, পাঞ্জাব আওয়ামী লীগ সভাপতি এম খুরশীদ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মমতাজ দৌলতানার বিশেষ দূত পীর সাইফুদ্দিন ও ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি কে উলফ বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর ধানম-ির বাসভবনে পৃথক আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন। এদিকে রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ ১১৪ নম্বর সামরিক আদেশ জারি করেন। সামরিক নির্দেশে কেউ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারী সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করলে অথবা সশস্ত্র সেনাবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ বা সেনাবাহিনীর গতিবিধিতে অন্তরায় সৃষ্টি করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দেয়া হয়। কিন্তু সামরিক আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে সেনাবাহিনীর রসদ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে মুক্তিপাগল সংগ্রামী জনতা। সিলেটে রেশন নেয়ার সময় সেনাবাহিনীর একটি কনভয়কে বাধা দেয়া হয়। যশোর ও অন্যান্য এলাকায়ও এ ধরনের ঘটনা ঘটে। টাঙ্গাইলে বিন্দুবাসিনী হাই স্কুল ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় ন্যাপপ্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান ৭ কোটি বাঙালীর নেতা। তাই নেতার নির্দেশ পালন করুন। লক্ষ্য অর্জনের জন্য সবাই একসঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করুন। এ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনরকম বিভেদ থাকা উচিত নয়। একাত্তরের এই দিনে পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচী থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পাঠানো এক বার্তায় বলেন, দেশের ভবিষ্যত আজ অনিশ্চিত। এ ব্যাপারে আমাদের উভয়ের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। ধ্বংস এড়ানোর জন্য মানুষের সাধ্যায়ত্ত সবকিছুই আমাদের করতে হবে। দেশকে রক্ষা করতে হবে যেকোন মূল্যের বিনিময়ে। এদিকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ছাত্রনেতারা বলেন, স্বাধীন বাংলার নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্যই সমরাস্ত্র বাংলাদেশে আনা হয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা বাংলাদেশের জনসাধারণকে সজাগ করে দিচ্ছি। এসব সমরাস্ত্র ও সৈন্য যাতে বাংলাদেশে নামতে না পারে তা প্রতিহত করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চারজন নেতা অন্য এক যৌথ বিবৃতিতে সরকার প্রদত্ত যাবতীয় খেতাব ও পদক বর্জনের জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। এ বিবৃতিতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর চলাচলে কোন সহযোগিতা না করার জন্যও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জন্য খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করা থেকে বিরত থাকার জন্যও জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এই দিনে ছাত্র ইউনিয়ন দেশবাসীকে সংগঠিত করতে একটি লিফলেট ছাড়ে। সেখানে তারা পাক হানাদারদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানায়। এভাবে একেকটি দিন যেতে থাকে আর বাড়তে থাকে উত্তেজনা। সংঘবদ্ধ হতে থাকে বাঙালী। বাড়তে থাকে বাঙালীর মনের জোর। অনিবার্য স্বাধীনতার দিকে দেশ যাচ্ছে। পূর্ব-পাকিস্তান হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এটা বুঝতে পেরে পাক সামরিক জান্তারা গোপনে বাঙালী নিধনে ঘৃণ্য খেলায় মেতে উঠে। যেকোন মূল্যে স্বাধীনতা ঠেকাতে পাকি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাঙালীর রক্তের হোলিখেলার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। গোপনে পূর্ববাংলায় পাকিস্তানী সামরিক শক্তি ও অস্ত্র-গোলাবারুদ মজুদ করতে থাকে। কিন্তু এই ঘৃণ্য পরিকল্পনার কথা সামরিক বাঙালী অফিসাররা জানতে পেরে তারাও ভেতরে ভেতরে স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে শক্তি-সাহস সঞ্চয় করতে থাকেন।
×