ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অনুলিপি পাওয়ার পর দণ্ড কার্যকরের পরবর্তী প্রক্রিয়া ;###;বাকি দুই ধাপ রিভিউ আবেদন এবং প্রাণ ভিক্ষা

এখন অপেক্ষার পালা পূর্ণাঙ্গ রায়ের ॥ নিজামী আর মীর কাশেমের মৃত্যুদণ্ড

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১১ মার্চ ২০১৬

এখন অপেক্ষার পালা পূর্ণাঙ্গ রায়ের ॥ নিজামী আর মীর কাশেমের মৃত্যুদণ্ড

আরাফাত মুন্না ॥ সুপ্রীমকোর্টের চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী বদর নেতা মীর কাশেম আলীর দণ্ড কার্যকরে এবার পূর্ণাঙ্গ রায়ের অপেক্ষা শুরু হলো। এছাড়া আরেক কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার পূর্ণাঙ্গ রায়ের অপেক্ষার প্রহর গুনছে জাতি। চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি নিজামীকে দেয়া ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ডের সাজা বহাল রাখে সুপ্রীমকোর্ট। উচ্চ আদালতের রায়ের সর্বোচ্চ সাজাই বহাল থাকায় পূর্ণাঙ্গ অনুলিপির কথা শোনা যায় রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষের আইনজীবীদের মুখেই। রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাওয়া গেলে দণ্ড কার্যকরের পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরু করবে রাষ্ট্রপক্ষ। অন্যদিকে এ রায়ের রিভিউ আবেদন করতে গেলে আসামি পক্ষেরও পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রয়োজন। রায়ের অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর আসামি রায় পর্যালোচনার আবেদন (রিভিউ) করতে পারবেন। তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষারও সুযোগ পাবেন। দুটোই নাকচ হয়ে গেলে সরকার দ- কার্যকরের ব্যবস্থা নেবে। এক্ষেত্রে চার যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের কাদের মোল্লা, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায় বাস্তবায়নের আগে পালিত প্রক্রিয়াগুলো দৃষ্টান্ত হিসেবে থাকছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজনকে হত্যার দায়ে আপীল বিভাগে মীর কাশেমের ফাঁসির রায় এসেছে গত মঙ্গলবার। আরও ছয় অভিযোগে তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দিয়েছে আদালত। রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া জানতে চাইলে ওই দিন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, কাদের মোল্লার রিভিউ পিটিশনের রায়ে বলা হয়, রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে আসামি রিভিউ চাইতে পারবেন। তিনি বলেন, অপেক্ষা করব এই ১৫ দিনের জন্য। তারা যদি রিভিউ পিটিশন দাখিল না করে, তাহলে আমরা এই রায় কার্যকর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আসামির প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনও বলেছেন, আমরা পূর্ণাঙ্গ অনুলিপির জন্য অপেক্ষা করছি। পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি হাতে পেলে রিভিউয়ের উপাদান পাওয়া গেলে রিভিউ দায়ের করা হবে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলমের কথাতেও পূর্ণাঙ্গ অনুলিপির জন্য অপেক্ষার বিষয়টি ফুটে ওঠে। তিনি বলেন, কী কারণে মৃত্যুদ-ের একটা অভিযোগ থেকে মীর কাশেম খালাস পেলেন, সেটা এখনই বলা যাবে না। রায়ের পূর্ণ অনুলিপি পেলে আমরা সেটা বলতে পারব। এর আগে চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীকে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ-ের রায় বহাল রেখে রায় দেয় সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। ওই রায় দেয়ার পর থেকেই শুরু হয় রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপির অপেক্ষা। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে। ওই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর কাদের মোল্লার চূড়ান্ত রায় দেয় আপীল বিভাগ, যাতে ৪:১ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আসামিকে মৃত্যু পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করতে বলা হয়। এর প্রায় আড়াই মাস পর ৫ ডিসেম্বর ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করে আপীল বিভাগ। অনুলিপি পাওয়ার পর ৮ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে। দুই পৃষ্ঠার ওই ‘মৃত্যু পরোয়ানা’ খামে ভরে লালসালুতে মুড়ে ৭৯০ পৃষ্ঠার নথিসহ পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ১০ ডিসেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হবে বলে কারা কর্তৃপক্ষ জানালেও আসামি পক্ষের আবেদনে সুপ্রীমকোর্টের চেম্বার জজ রাতে এক আকস্মিক আদেশে তা স্থগিত করে দেন। ওই রাতেই কাদের মোল্লার পক্ষে তার আইনজীবীরা দুটি আবেদন করেন। এর একটিতে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হয় এবং দ্বিতীয় আবেদনে রায় পুনর্বিবেচনা করে কাদের মোল্লার খালাসের আবেদন করা হয়। এরপর ১১ ও ১২ ডিসেম্বর আসামিপক্ষের আবেদনের শুনানি করে তা নাকচ করে দেয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। ১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে কাদের মোল্লার সঙ্গে দেখা করেন পরিবারের সদস্যরা। ওই রাত ১০টা ১ মিনিটে এই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কাদের মোল্লার পর আপীলে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার শুনানি হয়। ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ-াদেশ কমিয়ে সেখানে তাকে দেয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদ-। যুদ্ধাপরাধের মামলায় ‘রিভিউয়ের সুযোগ’ রয়েছে কি-না, সেই প্রশ্ন কাদের মোল্লার চূড়ান্ত রায়ের পরপরই সামনে চলে আসে। ২০১৪ সালের ৩ নবেম্বর আপীল বিভাগ কামারুজ্জামানের মামলা নিষ্পত্তি করে ট্রাইব্যুনালের দেয়া ফাঁসির রায় বহাল রাখলে ফিরে আসে সেই আলোচনা। এর মধ্যে ওই বছরের ২৫ নবেম্বর কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদনের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করে আপীল বিভাগ। সেই রায়ে আদালত জানায়, যুদ্ধাপরাধের মামলাতেও সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করা যাবে। রায়ে বলা হয়, আসামি ও রাষ্ট্র- দু’পক্ষই ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করতে পারবে। তবে রায়ের নির্ভরযোগ্যতায় ‘খাদ আছে’ বা ‘বিচার-বিভ্রাটের’ আশঙ্কা আছে বলে মনে করলেই আদালত তা পুনর্বিবেচনার জন্য গ্রহণ করবে। ওই রায়ে বলা হয়Ñ ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে দ-িতদের ক্ষেত্রেও আপীলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন গ্রহণযোগ্য হবে। তবে তা আপীলের সমকক্ষ হবে না। ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আপীল বিভাগ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- বহাল রাখার রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করলে ট্রাইব্যুনাল পরদিন মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে। তার আইনজীবীরা ৫ মার্চ রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করলে ৬ এপ্রিল আপীল বিভাগ তা খারিজ করে দেয়। রিভিউ আবেদন খারিজের পর প্রাণভিক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আইনজীবীদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান এই যুদ্ধাপরাধী। কিন্তু আসামি প্রাণভিক্ষার জন্য কত সময় পাবেন এবং কত দিনের মধ্যে তার নিষ্পত্তি হবেÑ সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে সুনির্দিষ্ট কোন সময় বেঁধে দেয়া না থাকায় কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা তৈরি হয়। কাদের মোল্লার রিভিউ খারিজের রায়ে আপীল বিভাগ বলেছিল, যুদ্ধাপরাধ মামলায় মৃত্যুদ- কার্যকরের আগে আসামি সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ পাবেন। তবে প্রাণভিক্ষার জন্য কারাবিধিতে বেঁধে দেয়া ৭ থেকে ২১ দিনের সময়সীমা এ মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। আসামি প্রাণভিক্ষা চাইলে তার নিষ্পত্তির আগে দ- কার্যকর করা যাবে না। কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, তিনি প্রাণভিক্ষার সুযোগ নেননি। এ কারণে রিভিউ খারিজের দিনই তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল। কিন্তু কামারুজ্জামান সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য কয়েক দফা সময় নিলে জটিলতা দেখা দেয়। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সে সময় বলেছিলেন, ওই সুযোগ নেবেন কি-না তা জানাতে কামারুজ্জামান ‘যৌক্তিক সময়’ পাবেন। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, একটি ‘মার্সি পিটিশন’ লিখতে যে সময় লাগে এক্ষেত্রে সেটাই ‘যৌক্তিক সময়’ বলে তিনি মনে করেন। রিভিউ খারিজের পাঁচ দিনের মাথায় ১১ এপ্রিল বিকেলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী (বর্তমানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত মুহাম্মদ কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে চাননি। ওই সন্ধ্যায় আবারও কামারুজ্জামানের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের দেখা করতে দেয়া হয়। রাত ১০টার পর দ্বিতীয় যুদ্ধাপরাধী হিসেবে এই জামায়াত নেতার মৃত্যুদ- কার্যকর করে কারা কর্তৃপক্ষ। গত ২২ নবেম্বর একই দিনে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। একাত্তরে নির্বিচারে অসংখ্য মানুষের প্রাণ সংহার করলেও শেষমুহূর্ত পর্যন্ত মরিয়া হয়ে প্রাণ বাঁচাতে চেয়েছিলেন তারা দু’জন। ক্ষমাভিক্ষাও করেছিল রাষ্ট্রপতির কাছে; তবে তা নাকচ করে তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
×