ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

লোপাট অর্থ হাত বদলে বৈধ করা হয় ফিলিপিন্সের তিন ক্যাসিনোয় জুয়া খেলায় ;###;অর্থ উদ্ধারে এফবিআই ও সিক্রেট সার্ভিসের সাহায্য নিচ্ছে বাংলাদেশ ;###;ভুল নির্দেশনায় অর্থ চুরি- বাংলাদেশ ব্যাংক

ছয় হ্যাকার চিহ্নিত

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১১ মার্চ ২০১৬

ছয় হ্যাকার চিহ্নিত

কাওসার রহমান/রহিম শেখ ॥ পরিকল্পিতভাবেই নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা হ্যাকড করা হয়েছে। এ হ্যাকিংয়ের ঘটনার তথ্যানুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ হ্যাকিংয়ের ঘটনা হলিউডের সিনেমাকেও হারা মানায়। সিনেমার পর্দায় যেমন দেখা যায়- আন্তর্জাতিক হ্যাকার চক্র পাসওয়ার্ড চুরি করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়ে বিনোদনে মেতে উঠে। এখানেও ঘটেছে তাই। বাংলাদেশ ব্যাংকের খোয়া যাওয়া অর্থের শেষ ঠাঁই হয়েছে জুয়ার আসর ক্যাসিনোতে। সেই অর্থ দিয়ে তিনটি ক্যাসিনোতে জুয়া খেলা হয়েছে। এখানেই অর্থ লোপাটের কাহিনীর রোমাঞ্চকর ঘটনার শেষ নয়। রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে এই অর্থ তাদের ক্লায়েন্টদের মাধ্যমে চলে যায় স্থানীয় এক ফরেন এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীর কাছে। ওই ব্যবসায়ীর ফরেন এক্সচেঞ্জ কোম্পানি ‘ফিলরেমেতে’ ওই অর্থ ফিলিপিনো মুদ্রায় কনভার্ট করা হয়। ৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার স্থানীয় মুদ্রায় বিনিময়ের পর দাঁড়ায় ৩৭০ কোটি পেসোতে। এরপর ওই অর্থ চলে যায় তিনটি বড় ক্যাসিনোতে। এগুলো হচ্ছে- সোলারি রিসোর্ট এ্যান্ড ক্যাসিনো, সিটি অব ড্রিমস এবং মাইডাস। পুরো অর্থ খরচ করে সেখানে জুয়া খেলার জন্য চিপস কেনা হয়। জুয়া খেলা শেষে ওই চিপস আবার ফিলিপিনো মুদ্রায় কনভার্ট করে সেই অর্থ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে হংকংয়ের বিভিন্ন এ্যাকাউন্টে। মূলত ক্যাসিনোর মাধ্যমে হাতবদল করে ‘সাদা টাকা’ হিসেবে হংকংয়ে পাচার করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও এর পক্ষে কোন দালিলিক প্রমাণ এখনও তদন্তকারীদের হাতে আসেনি। উল্লেখ্য, ফিলিপিন্সের আইন অনুযায়ী, ক্যাসিনোতে জুয়ায় জেতা অর্থ থেকে নির্ধারিত ট্যাক্স দিলে তা বৈধ আয় বিবেচিত হয়। তবে এভাবে হাতবদলের পর ওই অর্থ ফিলিপিন্স থেকে বাইরে নেয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হলেও সেগুলো আবার বিদেশী মুদ্রায় রূপান্তর এবং অন্য কোন দেশে যাওয়ার পক্ষেও কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ভুল নির্দেশনার মাধ্যমে এই অর্থ চুরি করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ টাকা উদ্ধারে ফিলিপিন্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহযোগিতার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই ও সিক্রেট সার্ভিসের দ্বারস্থ হয়েছে। এছাড়া মানি লন্ডারিংয়ের ব্যাপারে দক্ষ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপেরও (এপিজি) সহায়তা চাইবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিকে ফিলিপিন্সের এন্টি-মানি লন্ডারিং কাউন্সিল বাংলাদেশের অর্থ লোপাটের ঘটনায় ছয় হ্যাকারকে চিহ্নিত করেছে। এরা আন্তর্জাতিক হ্যাকার চক্রের সদস্য বলে কাউন্সিল মনে করছে। এদিকে আন্তর্জাতিক প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘাটতির কারণেই ফেডারেল রিজার্ভ থেকে অর্থ লোপাট হয়েছে। নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ্যাকাউন্ট থেকে দশ কোটি ডলার লোপাটের বিষয়টি নিয়ে ফিলিপিন্সের কয়েকটি পত্রিকায় প্রতিদিনই খবর বের হচ্ছে। কিভাবে নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ থেকে এ অর্থ ফিলিপিন্সের ব্যাংকিং সিস্টেমে ঢুকলো, সেখান থেকে কিভাবে নানা হাত বদল হয়ে সেটা বিভিন্ন জায়গায় চলে গেল, তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এসব রিপোর্টে। তবে এ নিয়ে সবচেয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধানী রিপোর্টটি বেরিয়েছে ফিলিপাইন ডেইলি ইনকোয়ারার পত্রিকায়। পত্রিকাগুলোর তথ্যানুসন্ধান করে দেখা যায়, চার হ্যাকার মিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই অর্থ লোপাট করেছে। হ্যাকাররা হলেন- এনরিকো তেওডোরো ভাসকোয়েজ, আলফ্রেড সান্তোস ভারগারা, মিশের ফ্রানসিসকো ক্রুজ এবং জেসি ক্রিস্টোফার লাগরোসাস। তাদের এই অর্থ লোপাটের পরিকল্পনা হয় ২০১৫ সালের মাঝামাঝি। পরিকল্পনামাফিক এই চার হ্যাকার মিলে ২০১৫ সালের ১৫ মে রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনে (আরসিবিসি) প্রত্যেকে ৫০০ ডলার জমা দিয়ে ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খোলে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলোÑ ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির আগ পর্যন্ত এ এ্যাকাউন্টগুলোতে কোনই লেনদেন হয়নি। ঘটনার পরিক্রমা ॥ ফেব্রুয়ারি মাসের ১ বা ২ তারিখে নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০ কোটি ডলার চুরি করা হয়। আন্তর্জাতিক হ্যাকার চক্র বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট কোড হ্যাকড করে ফেডারেল রিজার্ভকে নির্দেশনা দেয় এ টাকা ফিলিপিন্সের একটি ব্যাংকে ট্রান্সফার করার জন্য। এক্ষেত্রে তারা অর্থ স্থানান্তরের সব নিয়মকানুন অনুসরণ করে। ফেডারেল রিজার্ভে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের এ্যাকাউন্টটি মূলত দেশের অভ্যন্তরে উন্নয়ন কাজে জড়িত বিদেশী ঠিকাদারদের অর্থ পরিশোধে ব্যবহার করা হয়। হ্যাকাররা সেটি নিশ্চিত হয়েই ওই এ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ পাচারের পরিকল্পনা করে। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য নেয়া ঋণ শোধের কথা বলে ৮১ মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেয় এই হ্যাকার চক্র। এদের মধ্যে ভাস্কুয়েজের এ্যাকাউন্টে ২৫ মিলিয়ন ঢুকেছে কাঁচপুর, মেঘনা-গোমতী দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ প্রকল্পের জন্য জাইকার কাছ থেকে নেয়া ঋণ শোধের কথা বলে। আইটি প্রফেশনাল লাগ্রোসাসের এ্যাকাউন্টে ৩০ মিলিয়ন ডলার নেয়ার ক্ষেত্রেও জাইকার ঋণ শোধের কথা বলা হয়। এখানে দেখানো হয় ঢাকা মাস র‌্যাপিড ট্রান্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প। একটি আইপিএফএফ প্রকল্পে কনসালটেন্সি ফিস হিসেবে ক্রুজের এ্যাকাউন্টে নেয়া হয় ৬ মিলিয়ন ডলার। আর ভেড়ামারা কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পে ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেন্সি ফিস হিসেবে বাকি ১৯.৯৯ মিলিয়ন ঢোকে ভারজারার এ্যাকাউন্টে। ফেডারেল রিজার্ভ থেকে প্রথম অর্থ যায় যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি ব্যাংকে। এ ব্যাংকগুলো হচ্ছেÑ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক, সিটি ব্যাংক এবং ওয়েলস ফার্গো ব্যাংক। ওই তিনটি ব্যাংক থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের ৪ তারিখে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার (৮১ মিলিয়ন) ট্রান্সফার করা হয় আরসিবিসির চারটি ব্যাংক এ্যাকাউন্টে। এর মধ্যে ৩০ মিলিয়ন ডলার পাঠানো হয় লাগরোসাসের এ্যাকাউন্টে, ১৯.৯৯ মিলিয়ন ডলার পাঠানো হয় ভারগারার এ্যাকাউন্টে, ২৫ মিলিয়ন ডলার পাঠানো হয় ভাসস্কোয়েজের এ্যাকাউন্টে এবং ৬ মিলিয়ন ডলার পাঠানো হয় ক্রুজের এ্যাকাউন্টে। এই অর্থ লেনদেন করা হয় আন্তর্জাতিক সব নিয়মকানুন মেনে। ফলে ফেডারেল রিজার্ভ থেকে নিউইয়র্কের ব্যাংক হয়ে ফিলিপিন্সে অর্থ আসতে কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি। একই দিন লাগরোসাস তার ৩০ মিলিয়ন ডলার থেকে ২২.৭৩ মিলিয়ন ডলার তুলে ইউলিয়াম গোর ডিবিএ সেঞ্চুরিটেক্স ট্রেডিংয়ের এ্যাকাউন্টে জমা করা হয়। আশ্চর্যের বিষয়, ওই এ্যাকাউন্টটিও ওই দিনই খোলা হয়। অথচ ব্যাংকের এই নতুন এ্যাকাউন্টগুলোতে কোথা থেকে কিভাবে অর্থ আসছে, তা নিয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোন প্রশ্ন করেনি। ৫ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি ওই অর্থ স্থানীয় মুদ্রা বিনিময় কোম্পানি ‘ফিলরেমে’ স্থানান্তর করা হয় তা স্থানীয় মুদ্রায় কনভার্ট করার জন্য। ওই অর্থ স্থানীয় মুদ্রা পেসোতে কনভার্ট করে তা চাইনিজ ন্যাশনাল ওয়েকাং জু, ইস্টার্ন হাওয়াই লেইজার কোম্পানি এবং ব্লুমবেরি হোটেলের (সোলারি রিসোর্ট) এ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। এর মধ্যে ৮ ফেব্রুয়ারি চীনের নববর্ষের দিনে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথম জানতে পারে তাদের অর্থ ফেডারেল রিজার্ভ থেকে লুট করা হয়েছে। ওই দিন বাংলাদেশ ব্যাংক রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকের কাছে জরুরী বার্তা পাঠায় ওই অর্থ ছাড় না করা এবং ফেরত দেয়ার জন্য। যদি ওই ফান্ড ট্রান্সফার করা হয়, তা হলে ওই অর্থ যেন ফ্রিজ বা স্থগিত রাখা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক আরও জানায়, জালিয়াতি করে অর্থ স্থানান্তরের অর্ডার দেয়া হয়েছে। কিন্তু ওই দিন ফিলিপিন্সে সরকারী ছুটি থাকায় এ ব্যাপারে কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি। পরদিন ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে রিজাল কামার্শিয়াল ব্যাংক সুইফট বার্তা পায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে। যাতে সঠিক তদন্তের জন্য অর্থ ছাড় বন্ধ এবং এ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। ততক্ষণে কাজ যা হওয়ার হয়ে গেছে। ৮১ মিলিয়ন ডলার থেকে ইতোমধ্যে ৫৮.১৪ মিলিয়ন ডলার তুলে নেয়া হয়েছে ব্যাংকটির জুপিটার স্ট্রিট শাখা থেকে। তখন ফিলরেমের এ্যাকাউন্টে ১৫.২ মিলিয়ন ডলার, ইউলিয়াম গোর এ্যাকাউন্টে ৪২.৯৩ মিলিয়ন ডলার এবং ফিরেমের কাছে আরও ২০ মিলিয়ন ডলার চলে গেছে। উল্লেখ্য, সুইফট হচ্ছে সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াই ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনি-কেশনের একটি সিস্টেম। এই সিস্টেমের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক লেনদেনের তথ্য আদান-প্রদান করা হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক গবর্নর আতিউর রহমান ফিলিপিন্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নর আমানন্দো টেটাংকো জুনিয়রের কাছে এ ব্যাপারে সহায়তা চান। তিনি তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিউইয়র্কস্থ ফেডারেল রিজার্ভ থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরির ঘটনা উল্লেখ করেন। তিনি জানান, ফেব্রুয়ারি মাসের ৪ তারিখে ফেডারেল রিজার্ভ থেকে আরসিবিসির এ্যাকাউন্টে অর্থ হস্তান্তরের সুইফট পেমেন্ট নির্দেশনা জালিয়াতি। ১৯ ফেব্রুয়ারি ফিলিপিন্সের এ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলসি) তদন্ত শুরু করে। তারা প্রথমেই ওয়েকাং জু, ইস্টার্ন হাওয়াই লেইজার কোম্পানি এবং সোলারি রিসোর্টের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট জব্দ করে। এ বিষয়ে অর্থ কেলেঙ্কারির প্রথম রিপোর্ট প্রকাশ করে ২৯ ফেব্রুয়ারি ফিলিপিন্সের দৈনিক ইনকোয়ারার। রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরি করে ফিলিপিন্সে আনা হয়েছে। এএমএলসির জরুরী আবেদনের প্রেক্ষিতে ফিলিপিন্সের কোর্ট অব আপীলস আরসিবিসি, ইস্ট ওয়েস্ট ব্যাংক, বাংকো ডি অরো এবং ফিলিপাইন ন্যাশনাল ব্যাংক- এই চার ব্যাংকে মিশেল ফ্রান্সিসকো ক্রুজ, জেসি ক্রিস্টোফার লাগরোসা, আলফ্রেড সান্টোস ভারগারা এবং এনরিকো তেউডেরো ভাসস্কোয়েজ, ইউলিয়ম গো, সেঞ্চরিটেক্স ট্রেডিং, কাম সিন অং এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সকলের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ছয় মাসের জন্য জব্দ করে। রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকও জড়িত ॥ ফিলিপিন্সের ব্যাংকিং ইতিহাসে এত বড় মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা এটাই প্রথম। আর এই অর্থ লেনদেনের ঘটনায় দেশটির রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশন (আরসিবিসি) জড়িত বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। কারণ গত মাসের ৪ তারিখে প্রথম ৮১ মিলিয়ন ডলার তাদের ব্যাংকেই ট্রান্সফার করা হয়। ফিলিপিন্সের মাকাটি শহরের যে শাখায় এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আসে, সেই শাখার প্রধান কর্মকর্তা বিষয়টি ব্যাংকের উর্ধতন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের নজরে আনেন। অথচ কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোন নির্দেশনা না দিয়ে দিব্যি তা লেনদেন করার সুযোগ করে দিয়েছেন। ফলে এই লেনদেনের প্রত্যেকটি ধাপ সম্পর্কে এই ব্যাংকের উর্ধতন কর্তৃপক্ষ আগাগোড়াই জানতেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু এই ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লোরেনযো ট্যান, এই অভিযোগ অস্বীকার করছেন। ব্যাংকের তরফ থেকে দেয়া এক বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে ফিলিপিন্সের পত্রপত্রিকায়। তাতে ব্যাংকটি এই অর্থ পাচারের ঘটনার তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছে। ছয় হ্যাকার চিহ্নিত ॥ পুরো ঘটনাটি এখন তদন্ত করে দেখছে ফিলিপিন্সের সেনেট, ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন এবং ফিলিপিন্সের ‘এমিউজমেন্ট এ্যান্ড গেমিং কর্পোরেশন’ যারা সেখানকার জুয়ার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। ইতোমধ্যে এএমএলসি এই আন্তর্জাতিক অর্থ জালিয়াতির জন্য সম্ভাব্য ছয় জনকে চিহ্নিত করেছে। এদের মধ্যে পাঁচজন হচ্ছে রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকে এ্যাকাউন্টহোল্ডার এবং অন্য জন হচ্ছে তাদের সহযোগী। এই ছয় সম্ভাব্য হ্যাকার হচ্ছে- মিশেল ফ্রান্সিসকো ক্রুজ, জেসি ক্রিস্টোফার লাগরোসা, আলফ্রেড সান্টোস ভারগারা, এনরিকো তেউডেরো ভাসস্কোয়েজ, ইউলিয়ম সো গো এবং কাম সিন উং (কিম উং)। এ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিলের তদন্ত প্রতিবেদনে এই ছয় ব্যক্তি বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত বলে ফিলিপিন্সের পত্রপত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ক্রুজ, লাগরোসাস, ভারগারা এবং ভাসস্কোয়েজ ইউলিয়াম গোর সঙ্গে যোগসাজশ করে ব্যাংকিং চ্যানেলে ওই জালিয়াতির অর্থ ফিলিপিন্সে নিয়ে আসে। এই জালিয়াত চক্র ব্যাংকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার লেনদেন করলেও তাদের জানা কোন আয়ের উৎস নেই, যা দিয়ে তারা এই বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেনের যথার্থতা প্রমাণ করতে পারে। এদের মধ্যে কিম উং ছাড়া বাকি পাঁচজনের আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং চক্রের সঙ্গে সরাসির যোগাযোগ রয়েছে। তবে কিম উংয়ের এই ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা নেই বলে এমএমসিএলের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে ‘ভুল নির্দেশনা’ ॥ নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ চুরির বিষয়ে আর কোন বিভ্রান্তি নেই বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা। দুই দফায় ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরির পর পুনরায় ৮৭০ মিলিয়ন ডলার চুরির প্রচেষ্টা সম্পর্কে গণমাধ্যম কর্মীদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান। বৃহস্পতিবার রাজধানীর মতিঝিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে আলাপকালে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে অনেক ভুল নির্দেশনা (মিস ইনস্ট্রাকশন) গিয়েছিল। এমন নির্দেশনা দেশে নয়, দেশের বাইরে থেকে গেছে। এর ফলে কয়েকটি নির্দেশনা (ইনস্ট্রাকশনের) বিপরীতে রিজার্ভের অর্থ স্থানান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। এতে ধারণা করা যাচ্ছে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের কোন ত্রুটির কারণে নির্দেশনাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটতে পারে। তবে বাকিগুলো তাদের যে সিকিউরিটি এ্যালার্ট ও এ্যান্টি মানি লন্ডারিং এ্যালার্টের মাধ্যমে তারা বিষয়টি ধরতে পারে এবং এর বিপরীতে কোন ধরনের ট্রানজেকশন হয়নি। এটা নিয়ে বিভ্রান্তির কিছু নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ্যাকাউন্ট হ্যাকড হওয়া নিয়ে ফেডারেল রিজার্ভের বক্তব্য এটা তাদের বিষয়। আমরা শুধু অবস্থান জানিয়েছি। তিনি বলেন, রিজার্ভ পুনরুদ্ধারে অগ্রগতি অব্যাহত আছে। ফিলিপিন্সের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এ বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক। এতে আমাদের আশা আরও জোরালো হয়েছে, যে অর্থটি সেখানে পাচার হয়েছে তার পুরোটাই ফিরিয়ে আনতে পারব। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের টিম ও বিশেষজ্ঞের নেতৃত্বে যে ফরেনসিক টিম কাজ করছে তাদেরও ধারাবাহিক অগ্রগতি আছে এবং এ অগ্রগতি ফলপ্রসূ হবে। ঘটনা নিয়ে রহস্য ॥ এই ঘটনা এত দেরিতে জানা গেল কেন সেটি এক বিরাট রহস্য। এত বিরাট একটা কেলেঙ্কারি, এত বিশাল অঙ্কের অর্থ চুরি হলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অথচ তা জানা গেছে মাত্র গত ক’দিন আগে এবং তাও ফিলিপিন্সের বিভিন্ন পত্রিকায় এ নিয়ে খবর বেরুনোর পর। ফিলিপিন্সের পত্রপত্রিকা বলছে, অর্থ চুরি হওয়ার পর পরই বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা ইতোমধ্যে ফিলিপিন্সে গিয়ে সেখানকার সেন্ট্রাল ব্যাংকের সঙ্গে কথাও বলেছেন। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা পাচার হওয়া অর্থ ফেরত দেয়ার দাবিও জানিয়েছেন। এসবই কিন্তু ঘটেছে পুরো বিষয়টি বাংলাদেশের গণমাধ্যমের নজরে আসার আগে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বলা হচ্ছিল, এসব বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত ॥ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিদেশী আইটি বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে অর্থ চুরির ঘটনা তদন্ত করছে। এ ছাড়া দেশীয় তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের নিয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তারা দফায় দফায় বৈঠক করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন খতিয়ে দেখতে চাইছে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে অর্থ লেনদেনের আইটি ব্যবস্থাপনায় কোন ঘাটতি আছে কিনা? ফেডারেল রিজার্ভের বিরুদ্ধে মামলার কথাও বলেছেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী। বড় অঙ্কের অর্থ চুরির ঘটনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ঘাটতির অভিযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা অস্বীকার করেছে। তবে এই অর্থ চুরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্কেত কোড বা সুইফট কোড ব্যবহারের কথা এসেছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, তাদের কোন ঘাটতি ছিল কিনা, সেটাও তদন্ত করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাংকের আইটি প্রধান এখন বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি প্রকল্পে কাজ করছেন। তার নেতৃত্বে বিদেশী এবং দেশী আইটি বিশেষজ্ঞ নিয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। বাংলাদেশের সকল ব্যাংকের আইটি ব্যবস্থাপনায় কোন ঘাটটি আছে কিনা, বিশেষজ্ঞরা সেটা চিহ্নিত করবে। কিন্তু অর্থ চুরির ঘটনার অনেকটা সময় পরে এসে বাংলাদেশ ব্যাংক তা প্রকাশ করে। ঘটনাটি আসলে কিভাবে ঘটল, সেটাও এখনও পরিষ্কার নয় বলে বলা হচ্ছে। আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলেন, ‘তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘটনা সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে কিছু বিষয় আছে, যেমন স্বাভাবিক একটা লেনদেনের ক্ষেত্রে কোন ঘাটতি হয় কিনা, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সেটা তদন্ত করা হচ্ছে।’ অর্থ চুরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট কোড ব্যবহার হওয়ার যে বিষয় এসেছে, সে ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কর্মকর্তা বলেন, দেশের ভেতরে এবং বাইরে কারা জড়িত আছে। সেটি বের করার বিষয়ে তদন্তে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। মামলা প্রসঙ্গে আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলেন, আইনগত বিষয়গুলোও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এই পর্যালোচনা শেষে মামলা করা না করার প্রশ্ন আসবে। জানা যায়, পুরো বিষয়টি তদন্ত করতে বিশ্বব্যাংকের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ দল ঢাকায় অবস্থান করছেন। সন্দেহজনক কয়েক কর্মকর্তার পাসপোর্ট জব্দ করা ও নজরদারির খবর শোনা যায়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হ্যাক হওয়া অর্থের বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখতে একটি জাতীয় কমিটি করা উচিত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতেয়ার আহমেদ বলেন, ‘তাদের সিস্টেমে ঢুকে কেউ কাজটি করেছে, না আমাদের সিস্টেমে ঢুকে কেউ কাজটি করছে এটি তদন্ত করতে হবে। তাদের দিকে কেউ হ্যাক করে টাকা ট্রান্সফার করে থাকলে বাংলাদেশ সরকারকে টাকাগুলো উদ্ধার করার জন্য ফেডারেল রিজার্ভের কাছে ক্লেইম করতে হবে। আর আমাদের দিক থেকে কেউ করে থাকলে তা খুঁজে বের করে এর পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে।’ এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি অনলাইন ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকদের আস্থার সঙ্কট তৈরি করবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। পাশাপাশি এ ধরনের ঘটনা এড়াতে তথ্যপ্রযুক্তির হালনাগাদ সংস্করণ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অনলাইনভিত্তিক ব্যাংকিং সেবা যত সম্প্রসারিত হবে এ ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ততই বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এক্ষেত্রে গ্রাহক আস্থা ধরে রাখতে আর্থিক খাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। অর্থনীতিবিদ ড. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘এখনও কিন্তু খারাপ ধারণা তৈরি হয়নি। কারণ একটি নতুন সিস্টেমে কিছু সমস্যা তৈরি হতে পারে। কিন্তু বার বার এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আমানতকারীদের দিক থেকে বিশ্বাস হারাতে হবে।’ তথ্যপ্রযুক্তির হালনাগাদ সংস্করণ ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে এ ধরনের অপরাধ ঠেকানো যেতে পারে বলে মনে করছেন প্রযুক্তিবিদরা। এ প্রসঙ্গে প্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, ‘অনলাইন ব্যবস্থা খুব ডাইনামিক এবং প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ও আপডেট হয়। এই আপডেটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের সিস্টেমকেও আপডেট করতে হবে। সিস্টেম কিংবা ফিন্যান্সিয়াল অডিট হোক সব ধরনের চেক এ্যান্ড ব্যালান্স আছে কিনা সেটা যদি না দেখা হয় তাহলে এর চেয়ে আরও বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’
×