ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

টুটুল মাহফুজ

শেক্সপিয়ারের ‘সাইলক’ শয়তান না ষড়যন্ত্র

প্রকাশিত: ০৪:৪৩, ১১ মার্চ ২০১৬

শেক্সপিয়ারের ‘সাইলক’ শয়তান না ষড়যন্ত্র

শেক্সপিয়ার। আজ প্রায় সাড়ে চারশ’ বছর পরও যিনি মরেও অমর। হয়ত আগামী সাড়ে চারশ’ বছরেও যার মৃত্য হবে না। তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন সদা তার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। তার খুব বিখ্যাত একটি নাটক ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’। আমরা যারা শেক্সপিয়ার সম্পর্কে জানি তাদের অধিকাংশই হয়ত বা এ নাটকটির কারণেই। আর একটু বলতে হয়, নাটকটির গল্প সবার ঠিক মনে না থাকলেও, মনে আছে নাটকের অন্যতম একটি চরিত্র ‘সাইলক’। সম্ভবত এ চরিত্রটির কারণেই মনে আছে এবং থাকবে ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’। এটি এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সর্বাধিক মঞ্চায়িত নাটক। ১৬৯৬ থেকে ১৬৯৮ সালের মধ্যে রচনা করেন তিনি এই ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’। সম্প্রতি ‘ম্যান বুকার’ জয়ী লেখক হোয়ার্ড জেকবসন এ নাটকটির অনুকরণে লিখেছেন ‘সাইলক ইজ মাই নেম’ উপন্যাস। বলা হয়ে থাকে এই ‘সাইলক’ চরিত্রটিই ইতিহাসের অন্যতম রহস্য সৃষ্টিকারী একটি চরিত্র। সাইলক কি প্রকৃতই স্বার্থপর আর লোভী নাকি সে ওই সময়ের সমাজব্যবস্থা বা পরিবেশ পরিস্থিতির শিকার? জেকবসন আসলে তার সমস্ত রচনায় সাইলককে নিয়েই এগিয়েছেন। নাটকটির পূর্বে সাইলক নামটি কেউ শোনেনি। হিব্রু ও খ্রীস্টান গবেষক, সমালোচক এবং ধর্ম বিশেষজ্ঞদের মতে, সাইলক নামটি আদৌ কোন ইহুদি নাম নয়। তবে বাইবেলে ‘সালাহ’ এবং হিব্রু বাইবেলে ‘সালাইচ’ নামের শব্দের অস্তিত্ব আছে। ধারণা করা হয়, সাইলক নামটি এই কোন এক গ্রন্থ থেকে নিয়েই নিজের মতো করে ঠিক করেছিলেন শেক্সপিয়ার। ইতিহাস অনুযায়ী, মধ্যযুগ থেকেই ইহুদিরা শুরু করে অর্থ সংক্রান্ত কাজ কারবার। তাদের হাত ধরেই ব্যাংক ব্যবসার প্রচলন। ওই সময় থেকেই সুদে টাকা ধার দেয়া তাদের অন্যতম প্রধান পেশা হয়ে দাঁড়ায়। তখন খ্রীস্টানদের কেউ এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল না। ফলে অর্থে-বিত্তে প্রভাবশালী হয়ে যেতে থাকে তৎকালীন ইহুদিরা। যা ছিল ওই সময়ের সরকার কর্তৃপক্ষের জন্য হুমকি। তাই সে সময় ক্ষমতায় থাকা সরকার কর্তৃপক্ষরা ইহুদিদের উন্নতির লাগাম টেনে ধরে। তাদের ওপর আরোপ করতে থাকে নানা রকম নিয়মনীতি। ঠিক এই সময়ই কিছু কিছু খ্রীস্টান রাজা ইহুদিদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে থাকে। এমনকি এ সময় বাদ যায়নি তাদের বসতবাড়িও। সমাজ এবং সমাজ সম্পর্কিত বিভিন্ন কাজকর্ম থেকেও বিতাড়িত করা হয়। তারা হয়ে যেতে থাকে নিঃস্ব। এভাবেই ছাড়তে থাকে দেশ। হয়ে যেতে থাকে উদবাস্তু। ইহুদি ও খ্রীস্টান ধর্ম বিশ্লেষক হেইম ম্যাকাবির মতে এ ধরনের ইহুদি বিদ্বেষের পেক্ষাপটেই নাটকটি রচনা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন শেক্সপিয়ার। মানবতার এমন বিরুদ্ধে অবস্থান তিনি মেনে নেননি। এর প্রতিবাদস্বরূপ তিনি ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’ রচনা ও মঞ্চায়ন করেন। জানা যায়, ১২৯০ সালের পর ইংল্যান্ডে আর কোন ইহুদির বসতি ছিল না। অলিভার ক্রমওয়েলের শাসন অবদি অর্থাৎ ১৫৫৮ সাল পর্যন্ত এমন অবস্থায় ছিল। এরপর যখন রানী এলিজাবেথের শাসনকাল শুরু হয় তখন এ অবস্থা কিছুটা শিথিল হয়। কিছু কিছু ইহুদি প্রবেশ করতে শুরু করে। তবে তাদের অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। তাদের খুব অপমানজনক অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হতো। দেখা হতো না মোটেই ভাল চোখে। তখন সারা পৃথিবীজুড়েই বঞ্চিত ইহুদিরা। সে সময়ের ক্রিস্টফার মারলোর ‘দ্য জিউ অফ মাল্টা’ দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যায় বিষয়টা। সমাজের উচ্চ শ্রেণীর ক্ষমতালোভী শাসক শ্রেণী তাদের মুখে পরিয়ে দেয় লোভী, স্বার্থপর আর শয়তানের মুখোশ। ইহুদির মাথায় তখন লাল হ্যাট পরে চলতে হতো, যাতে হ্যাট দেখেই পরিচিতি নিশ্চিত হয়। আর কোনরূপ বিপরীত হলেই শাস্তি ছিল প্রাণদ-। ঠিক তখন ইতালির ভেনিস শহরের অবস্থান ছিল ইংল্যান্ড থেকে দূরে। আর শুধু এই ভেনিসের গেট্টো শহরেই তখনও অনেকগুলো ইহুদি পরিবারের বসতি ছিল। তবে তারা সেখানেও আহামরি শান্তি অথবা নিরাপদে ছিল না। তাদের নিরাপত্তা দিত তাদের প্রতিবেশী খ্রীস্টানরাই। তবে এই নিরাপত্তা দানের বিনিময়ে ইহুদিদের গুনতে হতো মোটা অংকের অর্থ। আর এই গেট্টো শহরের ইহুদিদের নিয়েই শেক্সপিয়ার রচনা করেছিলেন ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিসে’। নাটকে দেখা যায় ‘সাইলক’ চরিত্রটি কখনই মার্চেন্ট (ব্যবসায়ী) ছিল না। নাটকে মার্চেন্ট ছিল নায়ক চরিত্র ‘এ্যান্টনিও’। আর নাটকের গল্প অনুসারে সুদে অর্থ প্রদান ও তা পরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চড়া মূল্যে পরিশোধের যে বিষয়টা দেখানো হয়েছে, তা নিতান্তই ছিল সে সময় সেই সমাজ ব্যবস্থায় টিকে থাকার রক্তক্ষয়ী প্রতিযোগিতার কারণে। লেখক জ্যাকবসন তার এই ‘সাইলক ইজ মাই নেম’ বইটিতে বলেছেন, শেক্সপিয়ার তার এই নাটকে কোথায় দেখায়নি যে, সে একজন ইহুদি। কারণ, সে সময় গেট্টো শহরেই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সিনগগ (ইহুদি উপাসনালয়) ছিল। নাটকে এক পর্যায়ে দেখা যায়, ‘সাইলকে’র মেয়ে চরিত্র লরেনজার বিপদে ‘সাইলক’ প্রার্থনা করতে কখনও সিনগগে যায়নি। সে কোন এক অন্ধকার নির্জন স্থানে তার মেয়ের জন্য দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করেছেন। জানা গেছে, নাটকটির নাম ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিসে’র স্থানে ‘দ্য জিউ অফ ভেনিস’ই করা হতো। তবে এর আগে মারলো’র, ‘দ্য জিউ অফ মাল্টা’র কারণে পরে আর এ নামকরণ হয়। সবকিছুর পর বুকার জয়ী লেখক এ বার্তাই দিয়েছে যে, ইতিহাস খ্যাত ‘সাইলক’ চরিত্রটি আসলে শেক্সপিয়ার সৃষ্টি করেছিলেন ইহুদিদের শোষণের প্রতিবাদ হিসেবে। তিনি বলতে চেয়েছিলেন ‘সাইলক’ প্রকৃত অর্থে শুধুই লোভী, স্বার্থপর বা শয়তান নয়। মোট কথা ইহুদি মানেই লোভী, স্বার্থপর বা শয়তান নয়। মানুষ। শুধুই মানুষ তার বড় পরিচয়। সেই সমাজ, সেই পরিস্থিতি তাদের কে সাইলক বা ইহুদি বানিয়েছিল। গভীর থেকে দেখলে আসলেই বোঝা যাবে ‘সাইলক’ পরিস্থিতির শিকার।
×