ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাযযাদ কাদির

সত্য-মিথ্যা

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ১১ মার্চ ২০১৬

সত্য-মিথ্যা

ঘটনাটা বলেছেন দিলীপ কুমার নিজে। তখন বলিউডের শীর্ষ তারকা তিনি। বিমানে যাচ্ছিলেন কোথাও। তাঁর পাশে বসেছিলেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক। পরনে সাধারণ শার্ট ও প্যান্ট- মানের দিক থেকে মধ্যবিত্ত মানুষের পোশাক। তবে দেখতে তাঁকে সুশিক্ষিতই মনে হয়। বিমানের যাত্রীদের প্রায় সবাই চিনতে পারেন দিলীপ কুমারকে, তাঁদের বিস্ময় চমক ভাবসাব দেখেই বোঝা যায় তা। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না পাশের ভদ্রলোকের। তিনি পত্রিকা পড়েন একমনে, মাঝে মধ্যে জানালা দিয়ে তাকান বাইরে, চা এলে নিজের মতো করে চুমুক দেন, তাকান না আশপাশে। অস্বস্তিতে পড়ে যান দিলীপ কুমার। কথাবার্তা শুরু করতে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসেন তিনি, ভদ্রলোকও সৌজন্য দেখিয়ে হাসেন, বলেন, হেলো! একথা-সেকথা আগড়ম-বাগড়ম করে শেষ পর্যন্ত কোন রকমে তোলেন চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গ। জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি ছবি-টবি দেখেন? ভদ্রলোক বলেন, ওহ... খুব কম। অনেক বছর আগে দেখেছিলাম একটি ছবি। দিলীপ কুমার এক ফাঁকে উল্লেখ করেন, আমি কাজ করি ফিল্মে। খুব ভাল। তা কি কাজ? আমি অভিনেতা। বাঃ দারুণ তো! এরপর কথা এগোয় না আর। বিমান গন্তব্যে পৌঁছলে উঠে দাঁড়ান দুজনেই। হাত বাড়িয়ে দেন দিলীপ কুমার। বলেন, খুব ভাল লাগলো আপনাকে সঙ্গী হিসেবে পেয়ে। আমার নাম দিলীপ কুমার। ভদ্রলোক করমর্দন করেন, স্মিত হেসে বলেন, অনেক ধন্যবাদ। আমি জে আর ডি টাটা। [জে আর ডি টাটা পুরো নাম জেহাঙ্গির রতনজি দাদাভয় টাটা (১৯০৪-১৯৯৩)। ফ্রান্সে জন্মগ্রহণকারী ভারতীয় বৈমানিক ও বাণিজ্য-অধিপতি। ১৯২৯ সালে তিনিই প্রথম লাইসেন্স-প্রাপ্ত ভারতীয় বৈমানিক। টাটা সনস্-এর চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে টাটা মোটরস্, এয়ার ইনডিয়া, টাটা কনসালটেনসি সারভিসেস, টাটা কেমিক্যালস্, টাটা ইনস্টিটিউট অব ফানডামেনটাল রিসার্চ, টাটা গ্লোবাল বেভারেজেস্, লাকমি কসমেটিস্, বোমবে ফ্লাইং ক্লাব, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অভ এ্যাডভান্সড স্টাডিস প্রভৃতি। ] ॥ দুই ॥ আর এ ঘটনাটি বিভিন্ন ওয়েরসাইটে বহুল প্রচারিত, তবে... মহিলার পরনে সাদা-মাটা সুতি কাপড়ের লাল-সাদা চেকের পোশাক। তাঁর স্বামীর পরনে আরও ম্যাড়মেড়ে স্যুট। বোস্টন রেলস্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে দুজনে আস্তে-ধীরে হেঁটে আসেন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসিডেন্টের বহিঃদপ্তরে- কোন পূর্বযোগাযোগ ছাড়াই। সেক্রেটারি মহিলা দেখেই বুঝতে পারেন ওই সেকেলে গেঁয়ো ধরনের দুজনের কোন কাজ থাকতে পারে না হার্ভার্ডে, এমনকি ক্যামব্রিজে যাওয়ারও কোন যোগ্যতা থাকতে পারে না তাঁদের। ভদ্রলোক নম্র স্বরে বলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে চাই আমরা। সেক্রেটারি অবজ্ঞা দেখিয়ে বলেন, তিনি আজ সারা দিনই ব্যস্ত। মহিলা বলেন, আমরা অপেক্ষা করব। কয়েক ঘণ্টা কাটে, সেক্রেটারি চোখ তুলেও তাকান না তাঁদের দিকে। ভাবেন, দেরি করে-করে হতাশ হয়ে চলে যাবেন তাঁরা। কিন্তু না, চলে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যায় না তাঁদের মধ্যে। দেখে-দেখে নিজেই হতাশ হয়ে পড়েন সেক্রেটারি, শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেন প্রেসিডেন্টকে বিরক্ত করার- অথচ এ কাজটিই তাঁর সবচেয়ে বেশি অপছন্দের। প্রেসিডেন্টকে বলেন, দু’-এক মিনিট কথা বললেই চলে যাবেন ওঁরা। অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তিনি, পরে মাথা নাড়েন ‘অগত্যা কি আর করা’ ভঙ্গিতে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে নষ্ট করার মতো সময় তাঁর মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নেই, তাই বলে তাঁর বহিঃদপ্তরে গেঁয়ো ধরনের কারও অস্তিত্বও সহ্য করতে রাজি নন তিনি। কঠিন গম্ভীর মুখে, গর্বিত পদক্ষেপে প্রেসিডেন্ট হেঁটে যান দম্পতির দিকে। মহিলা বলেন, আমাদের ছেলে এক বছর পড়েছে এখানে। খুব ভালবাসত এই হার্ভার্ডকে। খুব সুখী ছিল ও এখানে। বছর খানেক আগে এক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ও। আমি ও আমার স্বামীর ইচ্ছা, ক্যাম্পাসে ওর স্মরণে কিছু একটা হোক। এ কথা শুনে কোন সহানুভূতি জাগে না প্রেসিডেন্টের মনে, রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে যান তিনি। রুক্ষ স্বরে বলেন, ম্যাডাম... হার্ভার্ডের সব মৃত ছাত্রের স্ট্যাচু স্থাপন করতে গেলে তো এটা আর ক্যাম্পাস থাকবে না, গোরস্থানের মতো দেখতে হয়ে যাবে। মহিলা ব্যাখ্যা করেন তাড়াতাড়ি, না-না... আমরা স্ট্যাচুর কথা বলছি না। আমরা ভাবছি হার্ভার্ডকে একটা ভবন দেয়া যায় কি না। চোখ গোল-গোল করে প্রেসিডেন্ট তাকান সাদা-মাটা সুতি কাপড়ের লাল-সাদা চেকের পোশাক আর ম্যাড়মেড়ে স্যুট পরা দম্পতির দিকে। বিস্ময়ের সঙ্গে বলেন, একটি ভবন! কি বলছেন... জানেন একটা ভবনের নির্মাণ-ব্যয় কত? এখানে হার্ভার্ডের ভবনগুলো নির্মাণেই ব্যয় হয়েছে ৭৫ লাখ ডলারেরও বেশি! মহিলা চুপ থাকেন কিছুক্ষণ। মনে-মনে খুশি হন প্রেসিডেন্ট। এখন বুঝি নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে এঁদের হাত থেকে! মহিলা নিচু স্বরে স্বামীকে বলেন, একটা ইউনিভার্সিটি শুরু করতে ওই টাকা লাগে? তাহলে আমরাই একটা ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করি না কেন? প্রিয় প্রাণেশ্বরীর কথায় স্বামী মাথা নাড়েন সম্মতি দিয়ে। প্রেসিডেন্ট চার্লস উইলিয়াম এলিয়ট হতবাক হয়ে যান বিস্ময়ে বিভ্রমে। মি. ও মিসেস লেল্যান্ড উঠে দাঁড়ান, অভিবাদন জানিয়ে বিদায় নেন সেখান থেকে। এরপর তাঁরা যান ক্যালিফোর্নিয়ার পালো আলটো-তে, সেখানে গড়ে তোলেন তাঁদের নামাঙ্কিত স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি। [ চার্লস উইলিয়াম এলিয়ট (১৮৩৪-১৯২৬)। আমেরিকান শিক্ষাবিদ। ১৮৬৯-১৯০৯ সালে প্রেসিডেন্ট ছিলেন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির। তাঁর উদ্যোগেই প্রাদেশিক কলেজ হার্ভার্ড উন্নীত হয়ে সবসেরা গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবি টি এস এলিয়ট তাঁর চাচাতো ভাই। আমাসা লেল্যান্ড স্ট্যানফোর্ড (১৮২৪-১৮৯৩)। আমেরিকান ধনকুবের, শিল্পপতি, রাজনীতিক। ১৮৬১ সালে নির্বাচিত হয়ে দু’ বছর গভর্নর ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার, পরে আট বছর ছিলেন ওই অঙ্গরাজ্যের সিনেটর। সাউদার্ন প্যাসিফিক রেলরোড এবং ১৮৬১ থেকে সেন্ট্রাল প্যাসিফিক-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিপুল প্রভাব প্রতিপত্তির অথিকারী হন ওই অঞ্চলের, কুখ্যাতি পান ‘লুটেরা ধনিক’ পরিচয়ে। জেইন এলিজাবেথ ল্যাথ্রপ (১৮২৮-১৯০৫)। স্বামী লেল্যান্ড স্ট্যানফোর্ডের সঙ্গে যৌথভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন স্ট্যানফোর্ড ইউসিভার্সিটি (পুরো নাম ‘লেল্যান্ড স্ট্যানফোর্ড জুনিয়র ইউনিভার্সিটি’)। ১৮৮৪ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে টাইফয়েডে একমাত্র সন্তানের মৃত্যু ঘটলে তার নামে ওই ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৮৫ সালে, তবে এর কার্যক্রম শুরু হয় ১৮৯১ সাল থেকে। ১৮৯৩ সালে স্বামীর মৃত্যু ঘটলে তিনি আমৃত্যু এককভাবে অর্থায়নে ও পরিচালনায় স্ট্যানফোর্ডকে গড়ে তোলেন শীর্ষস্থানীয় গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে। হাওয়াইয়ের ওয়াহু দ্বীপের মোয়ানা হোটেলের এক কক্ষে তাঁকে হত্যা করা হয় স্ট্রিকনিন বিষ প্রয়োগ করে।] প্রথম ঘটনাটির মতো সত্য না হলেও দ্বিতীয় ঘটনাটি নীতিশিক্ষামূলক হিসেবে সমাদৃত রয়েছে ১৯৯৮ থেকে।
×