ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জোবায়ের আলী জুয়েল

শেখ ফজলল করিম

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ১১ মার্চ ২০১৬

শেখ ফজলল করিম

বাঙালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয় হয়ে রয়েছেন তাঁদের মধ্যে শেখ ফজলল করিম হলেন অন্যতম। ‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে’ তা বহুদূর, মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক মানুষেতে সুরা সুর।’ কবিতার রচয়িতা কবি শেখ ফজলল করিম সাহিত্যবিশারদ, কাব্য রতœাকার, নীতিবাদী সাহিত্যিকের ৭৮তম মৃত্যুবার্ষিকী অতিক্রান্ত হতে চলেছে। কবি শেখ ফজলল করিম লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনায় ১৮৮৩ সালের ১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পিতার নাম আমীর উল্লা সরদার ও মাতার নাম কোকিলা বিবি। শৈশবে কাকিনা স্কুল থেকে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে শেখ ফজলল করিম মধ্য ইংরেজী পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে রংপুর জেলা স্কুল থেকে তিনি মাইনর পরীক্ষায় পাস করেন। ছাত্রাবস্থায় কাকিনা স্কুলে ৭ম শ্রেণীতে পড়ার সময় তাঁর বিয়ে হয় কালীগঞ্জ উপজেলার বিন বিনিয়া গ্রামের গনি মোহাম্মদ সর্দারের মেয়ে বসিরণ নেসা খাতুনের সঙ্গে (মৃত্যু ১৯৬২ খ্রিঃ)। অতঃপর নানা কারণে তার স্কুলজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। দাম্পত্য জীবনে দু’পুত্রের জনক ছিলেন কবি। তাঁর প্রথম পুত্র মাত্র ৩ দিন জীবিত ছিল। দ্বিতীয় পুত্রের নাম মতিয়ার রহমান। কবি শেখ ফজলল করিম ১৯০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মেসার্স এমভি. কোম্পানিতে চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন। স্বাধীনচেতা ফজলল করিম কোম্পানির মন যুগিয়ে কাজ করতে না পারায় স্বীয় চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। ত্রিশের দশকে শেখ ফজলল করিম ইউনিয়ন বোর্ডের প্রসিডেন্টও ছিলেন। কর্মজীবনে তিনি মুন্সি মেহেরউল্লার (১৮৬১-১৯০৭) খ্রিঃ অনুপ্রেরণা ও পরামর্শ পেয়েছিলেন। সাহিত্য সৃষ্টি, প্রকাশনা ও সাধনার পথে ধাবমান শেখ ফজলল করিম কাকিনায় নিজ বাড়িতে তাঁর পীর সাহেব হযরত মওলানা মহম্মদ শাহ সাহাব উদ্দীনের নামানুসারে তৎকালীন প্রায় দেড় হাজার টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘সাহাবিয়া প্রিন্টিং ওয়ার্কস।’ তিনি শেষ জীবন পর্যন্ত লেখার জগত নিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন। তাঁর সাহিত্যিক জীবনের উন্মেষ ছোট বেলা থেকেই। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি ‘সরল পদ্য বিকাশ’ কবিতা গুচ্ছ প্রকাশ করেন। এরপর থেকে তিনি আজীবন সাহিত্য সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর সাহিত্যকর্মে ধর্ম ও নীতি শাস্ত্র বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। নৈতিক আদর্শে সমৃদ্ধ কবিতা ও গদ্য লিখে তিনি প্রভূত সুনাম অর্জন করেন। মুসলিম ইতিহাস, মুসলিম উপাখ্যান, মুসলিম জীবন ইত্যাদি ছিল তাঁর সাহিত্যের মূল উপজীব্য বিষয়, ছাত্রাবস্থায় ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘আহমেদিয়া লাইব্রেরী’ নামক একটি ব্যক্তিগত পাঠাগার নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছিলেন। স্কুলের বাঁধা ধরা নিয়ম-কানুন তাঁর কখনই ভাল লাগেনি। তবে বাইরের প্রচুর বই অধ্যায়নে তাঁর অনীহা ছিল না। বিশেষ করে ইতিহাসবিষয়ক গ্রন্থের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল সবচেয়ে বেশি। প্রচুর জ্ঞানপিপাসা ও অনুশীলন তাঁর লেখার জগতকে সমৃদ্ধি করেছে। শেখ ফজলল করিমের সাহিত্যে উপজীব্য বিষয় ধর্মীয় হলেও দৃষ্টিভঙ্গির উদারতা ও সাহিত্যিক প্রসাদ গুণে তাঁর সৃষ্টি সার্বজনীন হয়ে উঠেছে। শেখ ফজলল করিমের পরিচিত মূলত একজন কবি হিসেবে কিন্তু আমরা দেখি তিনি কবিতা ও কাব্য ছাড়াও লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ, নাট্যকাব্য, জীবনী গ্রন্থ, ইতিহাস গবেষণামূলক নিবন্ধ, সমাজ গঠনমূলক তত্ত্বকথা, গল্প, শিশুতোষ সাহিত্য, নীতি কথা, চরিত গ্রন্থ এবং বিবিধ সমালোচনামূলক রচনা, সাহিত্যের সকল শাখায় ছিল তাঁর প্রবল পদচারণা। ইসলাম প্রচারক, নবনুর, কোহিনুর, বাসনা, মিহির ও সুধাকর, ভারত বর্ষ, সওগাত, বঙ্গীয় মসুলমান সাহিত্য পত্রিকা, শিশুসাথী, কল্পতরু, মোসলেম ভারত, সোলতান, মাসিক মোহাম্মদী, আলহক, বসুমতি ইত্যাদি পত্র-পত্রিকায় ফজলল করিমের অসংখ্য কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, উপন্যাস কাব্য, জীবনী, আলোচনা, সমালোচনা ও অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। সমকালীন মুসলমান কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে তাঁর অবস্থান ছিল প্রথম সারিতে। সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর (১৮৮০-১৯৩১ খ্রিঃ) নেতৃত্বে যে নবতর সাহিত্য প্রচেষ্টার উন্মেষ এ দেশে ঘটেছিল তাঁর সার্থক ধারক ও বাহক ছিলেন শেখ ফজলল করিম, জীবিত কালেই তিনি পেয়েছেন তাঁর সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি। ‘পথ ও পাথেয়’ গ্রন্থের জন্য তিনি রৌপ্যপদক পান। ১৩২৩ বঙ্গাব্দে নদীয়া সাহিত্য সভা তাঁকে সাহিত্যবিশারদ’ উপাধিতে ভূষিত করে। ‘চিন্তার চাষ’ গ্রন্থের জন্য তিনি লাভ করেন নীতি ভূষণ উপাধি। ১৩৩১ বঙ্গাব্দে খিদিরপুর মাইকেল লাইব্রেরী থেকে মধুস্মৃতি কবিতার জন্য তিনি রৌপ্যপদক পান। ১৯৩৪-৩৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সরকারের লঁঃব জবংঃৎরপঃরড়হ রৌপ্যপদক তিনি পেয়েছিলেন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে। এছাড়াও তৎকলীন বাংলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাঁকে দিয়েছিল কাব্যভূষণ, সাহিত্যরতœ, বিদ্যাবিনোদ, কাব্যরতœকর উপাধি ও সম্মান। শেখ ফজলল করিম কাকিনা থেকে ‘বাসনা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পদনা শুরু করেন ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে। ‘বাসনা’ পত্রিকাটি দু’বছর চালু ছিল। সাহিত্যের মাধ্যমে হিন্দু মুসলমান মিলন সম্ভব এটি ছিল তার অভিমত। এই পত্রিকায় হামেদ আলী, শেখ রেয়াজ উদ্দীন আহমদ, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, তসলিম উদ্দীন আহমদ (রংপুরের প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট) এবং অনেক স্বনাম খ্যাত ব্যক্তির লেখা প্রকাশিত হতো। ঐ সময় ‘বাসনা’ পত্রিকাটি ছিল পূর্ব বঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাসিক পত্রিকা। বিভিন্ন সূত্র থেকে শেখ ফজলল করিমের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা অনুযায়ী আনুমানিক মোট ৫৮টি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলোÑ সরল পদ্য বিকাশ (বাল্যকালের রচনা), তৃষ্ণা (কাব্য), মানসিংহ, পরিত্রাণ, (কাব্য), ভগ্নবীণা বা ইসলাম চিত্র, লায়লী মজনু, আফগানিস্তানের ইতিহাস, ভক্তি পুষ্পাঞ্জলি, গাথা, হারুন-অর-রশীদের গল্প, বিবি রহিমা, পথ ও পাথেয়, রাজর্ষি এবরাহিম, চিন্তার চাষ, বিবি খাদিজা, বিবি ফাতেমা, মোহাম্মদ চরিত, বিবি আয়েশা, ছামিতত্ত্ব বা ধর্মসঙ্গীত ইত্যাদি। তিনি ওমর খৈয়ামেরও বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। শেখ ফজলল করিমের গদ্য রচনা উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, ভাষা নির্মাণে তাঁর অসাধারণ দক্ষতা। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টিতে ছিল একটা নিজস্ব সুর, নিজস্ব ভাষা। আবেগ উপলব্ধি ও অনুভূতি প্রকাশের সে ভাষাকে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যবহার করেছেন। স্বাচ্ছন্দ্য গতিময়তা তাঁর লেখার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কবির স্বর্গ ও নরক নামক কালজয়ী কবিতাটি ১৩২১ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যা ভারতবর্ষে প্রকাশিত হয়েছিল। কবির এই কবিতাটি ‘বঙ্গবাণী’ ও কবি ‘মালঞ্চ’ নামক দুটি স্কুল পাঠ্যপুস্তকেও গৃহীত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সিলেবাসে ম্যাট্রিক ক্লাসের জন্য তাঁর কবিতা পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক’? বিখ্যাত কবিতার কবি হিসেবে সমগ্র বাংলাদেশে তিনি আজও সুপরিচিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে অবিভক্ত বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বাঙালী মুসলমানদের অবস্থান মোটেও সুদৃঢ় ছিল না। ব্রিটিশ ভারতে তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা ছিল সুস্থ মননশীল সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। কবি শেখ ফজলল করিম সে সময়ে কবি বা গদ্য লেখক হিসেবে তিনি তাঁর সাহিত্যির মাধ্যমে সুপরিচিত হয়েছিলেন। এটা তাঁর অসীম কৃতিত্বের পরিচয়। বরেণ্য কবি ও সাহিত্যিক শেখ ফজলল করিম ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। কাকিনায় নিজ বাস ভবনে তিনি চিরশায়িত আছেন।
×