ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া;###;মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

প্রকৃতিপ্রেমী প্রত্নতত্ত্ব সাধক

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ১১ মার্চ ২০১৬

প্রকৃতিপ্রেমী প্রত্নতত্ত্ব সাধক

বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে গত ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ ও অক্লান্ত গবেষণা করেন আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া। বাংলাদেশে প্রত্নতত্ত্ব চর্চায় অসামান্য অবদানের জন্য তাঁকে অনেকে ‘প্রত্নতত্ত্বের গুরু’ বলেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ বুধবার ৯৭ বছর বয়সী আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া মৃত্যুর কয়েক মাস আগেও লেখালেখি করে গিয়েছেন। তাঁর অসামান্য স্মৃতিশক্তি এবং কর্মক্ষমতা অনেকের কাছে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। ‘বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ নামে তাঁর লেখা গবেষণাধর্মী বইটিকে এ বিষয়ে একটি আকর গ্রন্থ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ‘বাংলাদেশের প্রাচীন কীর্তি ’(দুই খ- ), ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস’, ‘কুমিল্লা জেলার ইতিহাস’, ‘প্রশ্নোত্তরে বাংলাদেশের প্রাচীন কীর্তি’ (দুই খ- ), ‘বৃহত্তর ঢাকা জেলার প্রাচীন কীর্তি’, ‘দিনাজপুর মিউজিয়াম’সহ আরো অনেক মূল্যবান বই লেখার পাশাপাশি ফারসি ভাষা থেকে সরাসরি অনুবাদ করেছেন ‘তবকাত-ই-নাসিরি’, ‘তারিখ-ই-বঙ্গালা-ই-মহব্বত জঙ্গী’, ‘মোযাফফর নামা’, ‘সিয়ার-উল-মুতাখখিরিন’, মৃত্যুর আগেও মাসিক রুটসে একাধিক ফারসি বই ও সূত্র থেকে ধারাবাহিকভাবে লিখছিলেন ‘হিন্দুস্তানে বিশেষ করে এর পূর্বাঞ্চলে মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস’। পুঁথি সাহিত্য নিয়ে গবেষণা ও সম্পাদনা ছিল তাঁর আরেক সাধনার বিষয়। ‘গুপিচন্দ্রের সন্যাস’, ‘গাজী কালু চম্পাবতী’সহ বিভিন্ন পুঁথি নিয়ে তাঁর গবেষণা প্রাচীন পুঁথিগুলোকে সবার সামনে নিয়ে আসে। দুইখ-ে প্রকাশিত ‘গ্রাম বাংলার হাসির গল্প’ তাঁর ভিন্নধর্মী সংগ্রহের সংকলন। ‘বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ তাঁর অরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বই। প্রকাশিত উপন্যাস ‘মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকার ও একজন তরুণী’। এর বাইরেও তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের প্রথম পর্বসহ উপন্যাস- ‘আলোছায়ার কল্পকথা’, ‘জোড়াতালি মিয়া’, ‘বসতি’, ‘কাইমা গাদির কিসসা’, ‘মির্জা সাহেবের শেষ উইল’, ‘সেতুর সাংবাদিকের ডায়রি’ এবং ইতিহাসের বই ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাস’, ‘দিনাজপুরের ইতিহাস’, ‘বাঞ্ছারামপুরের ইতিহাস’ ও আরো কিছু বই অপ্রকাশিত রয়েছে। তিনি এক সময় কবিতাও লিখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ছাত্র হিসাবে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া অবিভক্ত বাংলার প্রতিযোগিতামূলক বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস বা বিসিএস পরীক্ষায় পাস করে সে সময়ের অতি দুর্লভ সরকারী চাকরিতে যোগ দেন ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার সময়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে অবসর নেন ১৯৭৬ সালে। তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। তিনি ছিলেন একজন চমৎকার ক্রীড়া সংগঠক। প্রশাসনিক কাজের বাইরে তিনি তাঁর পুরো জীবন উৎসর্গ করেন দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা প্রতœ সম্পদ অন্বেষণে। বর্তমান সময়ে আলোচিত উয়ারী বটেশ্বর প্রতœস্থানটির বিষয়ে স্থানীয় গবেষক হানিফ পাঠানকে সহযোগিতা করা এবং দেশের ইতিহাসবিদদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রথম উদ্যোগ নেন তিনি। সীতাকোট বৌদ্ধ বিহারসহ অসংখ্য প্রতœস্থান তিনি অবিষ্কার এবং খননের ব্যবস্থা করেছেন। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ, বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে গ্রহণ করেন রাষ্ট্রীয় একুশে পদক। এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ তাঁকে দিয়েছে সোসাইটির সম্মানজনক রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক। যা তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমি, ইতিহাস পরিষদ, ইতিহাস একাডেমি থেকে সম্মানিত হয়েছেন। রুটস আজীবন সম্মননা পেয়েছেন ২০০৯ সালে। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার সঙ্গে লেখকের ব্যক্তিগত দীর্ঘ আলাপচারিতা, স্মৃতিচারণ, সাক্ষাৎকার ও অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে পাওয়া কিছু তথ্য নিয়ে লেখাটি তৈরি করা হয়েছে। ছেলেবেলা ও পড়াশোনা আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার গ্রামের বাড়ি ব্র্াহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার দরিকান্দি গ্রামে। বাবা ইমদাদ আলী মিয়া ও মা আতিকুন্নেসা বেগম। গ্রামের পাশেই মামার বাড়ি ভেলানগরে তাঁর জন্ম ১ অক্টোবর ১৯১৮। রূপসদী বৃন্দাবন হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯৩৯ সালে। এতো দেরি হওয়ার কারণ বাবা তাঁকে মাঝখানে আরবি, ফারসি পড়িয়েছেন। এই শিক্ষাটা পরে তাঁকে ফারসি বই অনুবাদ করতে সাহায্য করেছে। ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। পরীক্ষায় তিনি বোর্ডে দশম হয়েছিলেন। ঢাকা কলেজ তখন ছিল পুরনো হাইকোর্ট বিল্ডিং-এ। এখানে শিক্ষক হিসাবে পান কাজী আবদুল ওয়াদুদসহ আরো অনেক নামকরা মানুষকে। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন ইংরেজি সাহিত্যে। কিন্তু তাঁর আগ্রহ ছিল নানা দিকে। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া বলেন, ‘ইতিহাসের রমেশ চন্দ্র মজুমদার, বিশ্বখ্যাত সত্যেন বোস-এর ক্লাসে গিয়ে তাঁদের কথা শুনতাম। একবার সত্যেন বোসের সামনে বাহারি পাঞ্জাবি পরে যাওয়ায় তিনি আমাকে নিয়ে মজা করেছিলেন।’ ১৯৪৫ সালে এমএ পাস করার পরের বছর ১৯৪৬-এ বগুড়ায় সরকারী আযিযুল হক কলেজে ইংরেজীর শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া। এ সময় কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। এ বছর বিসিএস পরীক্ষা দিলে পরের বছর রেজাল্ট হয়। তখন অবিভক্ত বাংলা থেকে দুই তিনজন সুযোগ পেতেন। সরকারী চাকরি পাওয়ায় কলেজের চাকরি ছেড়ে দেন। তিনি বলেন, ‘১৯৪৭-এ কলকাতায় গেলাম কাজে যোগ দিতে। কিন্তু তারা বললেন যেহেতেু আমি ত্রিপুরা জেলা থেকে এসেছি তাই আমার ঢাকাতে যোগ দেয়া উচিত। তখন দেশ বিভাগের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। আমার প্রথম পোস্টিং হয় চট্টগ্রামে।’ প্রতœতত্ত্ব ও ইতিহাস ইতিহাস এবং প্রতœতত্ত্বের বিষয়ে আগ্রহের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া বলেন, ‘ক্লাস এইটে পড়ার পর থেকে একাডেমিকভাবে আমি কখনো ইতিহাস পড়িনি। কিন্তু এ বিষয়ে আগ্রহ আমার বরাবরই। যখন বগুড়ায় ছিলাম তখন প্রায়ই মহাস্থানগড় যেতাম। তখন সেখানে শুধু ঢিবি ছিল। সরকারী চাকরির সুবাদে পরে বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশের কোথায় কি আছে বা ছিল সবই আমি চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই। যেমন দিনাজপুরে আমি পাঁচ বছর ছিলাম। সেখানে নিজে সার্ভে করেছি, খননে অংশ নিয়েছি। সেখানে হাজার হাজার ঢিবি ছিল। এখন তার প্রায় কিছুই নেই। আমরা যে কত কিছু হারিয়ে ফেলেছি, কত মূল্যবান প্রতœসম্পদ নষ্ট করেছি। এসব ভাবলে চোখে পানি চলে আসে।’ প্রতœসম্পদ নষ্ট হওয়া প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের দেশের আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্যের কারণে অনেক কিছুই বেশিদিন টেকে না। প্রতœসম্পদের একটি বড় উপাদান হচ্ছে পাথর। বহু বছর পরেও পাথরের তৈরি জিনিসপত্র থেকে যায়। আমাদের দেশে পাথরের অভাব এবং এর ব্যবহার কম। তাই কাঠ, বাঁশ, বেত ইত্যাদি দিয়ে বানানো ঘরবাড়ির অস্তিত্ব বেশিদিন থাকে না। ধাতু নির্মিত অস্ত্র কিংবা ব্যবহার্য জিনিসপত্র আমাদের এখানে অনেক কম হওয়ায় সময়কে প্রতিনিধিত্ব করার মতো উপকরণ তেমন একটা থাকে না। এছাড়া আমাদের দেশে নদীর গতিপথ সব সময়ই বদলে যাচ্ছে। ফলে অনেক চিহ্নই নিয়মিতভাবে আমরা নদীগর্ভে হারিয়ে ফেলছি।’ দীর্ঘ ও কর্মময় জীবন আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া ৯৭ বছরেরও বেশি সময় বেঁচেছেন। মৃত্যুর কয়েক মাস আগেও তিনি লেখালেখি করেছেন। তাঁর কাছে দীর্ঘ ও কর্মময় জীবনের রহস্য জানতে চাইলে তিনি মিষ্টি হেসে বলেছিলেন, ‘আসলে দীর্ঘ জীবন পাওয়ার জন্য আলাদা কোনো চেষ্টা করিনি। আমার বাবা প্রয়াত ইমদাদ আলী মিঞা ১০০ বছরের বেশি বেঁচেছিলেন।’ দীর্ঘজীবন প্রাপ্তিতে খাদ্যাভ্যাস কেমন হওয়া উচিত জানতে চাইলে সহজাত হাসি হেসে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া বলেন, ‘আমার জীবনে কোনো বদ অভ্যাস নেই। মাংস সবসময়ই কম খাই। মাছ ও সবজি বেশি খাই। আমি স্বল্পাহারী। এক সময় সিগারেট পাইপ খেতাম। ১৯৮৭ সালে ছেড়ে দিই। আর ধরিনি। ১৯৫৮ সালে শেষ বারের মতো চা খাই। কফি সারা জীবনে একবার খেয়েছি। সারাদিনে খাবারের তালিকায় আছে অল্প ভাত, দুটো পাতলা রুটি। একটি ডিম। সবজি। সারাজীবনে কখনো মদ খাইনি।’ এই দীর্ঘজীবনে অনেক ঘাত প্রতিঘাত পার হয়ে আসতে হয়েছে। এই বিষয়গুলোকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন জানতে চাইলে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া বলেন, ‘আমার ব্যক্তি জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট এসেছে। আমি যে নীতিটি মেনে চলি তা হলো, যতোটা সম্ভব সহজভাবে বিষয়টি গ্রহণ করতে। যে জিনিসের প্রতিকার নেই তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে কোনো সমাধান আসবে না। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ পেয়েছি আমার ছোট ছেলে মাশফিকের মৃত্যুতে। যতো বড় দুঃখ আসুক চেষ্টা করতে হবে তাকে এড়িয়ে যেতে। এমনও দিন গিয়েছে আমার দিন রাত ঘুম হয়নি। কিন্তু তারপর চেষ্টা করেছি তা কাটিয়ে উঠতে। কারণ এটা সম্ভব না হলে জীবন যাপন অসম্ভব হয়ে উঠবে। কোনো কিছুকেই অতিরিক্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। যতোটা সম্ভব ভুলে থাকা এবং ক্ষমা করে দেয়ার চেষ্টা করা জরুরী। ক্ষমা করাটা কঠিন। প্রতিশোধ নেয়া যতো সহজ, ক্ষমা করা তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি কঠিন। কিন্তু এটার চেষ্টা করা প্রয়োজন। আরো প্রয়োজন পরচর্চা বা পরনিন্দা থেকে দূরে সরে থাকা। কারণ মানুষ হিসাবে আমাদের কিছু দায়িত্ব আছে। আমাদের চেষ্টা করা উচিত সেই দায়িত্ব পালন করা। মানুষের নিন্দা না করে, সুযোগ পেলে প্রশংসা করা প্রয়োজন। অনেক অপ্রিয় বিষয় এড়িয়ে যেতে হয়।’ শখের জগত দুই বছর আগেও আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার কলাবাগানের তিনতলা বাড়ির পুরো ছাদ জুড়ে বিশাল বাগান। অনেক ধরনের গাছ সেখানে ছিল। নিয়ম করে গাছ লাগানো এবং তার পরিচর্যা করতেন তিনি। তাঁর বাগানে ছিল পেয়ারা, পেঁপে, বাতাবি লেবু, বড়ই, তাল, কলা, করমচা, বেল, আনারস, আমসহ বিভিন্ন ধরনের অনেক ফলগাছ। সবজির মধ্যে ছিল লেবু, করল্লা, লাউ, বেগুন, বরবটি, টমাটোসহ অনেক ধরনের সবজি। থানকুনি পাতা, তুলসি পাতা, পুদিনা পাতাসহ আরো অনেক প্রয়োজনীয় গাছ। সারা বাগান জুড়ে ছিল অসংখ্য ফুলের গাছ। দুঃখজনকভাবে এই বাগানটি সরিয়ে ফেলা হলে তিনি খুব বড় মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন। বই পড়া এবং গান শোনার প্রতি তাঁর সবসমই আগ্রহ ছিল। তাঁর কাজের রুমটি ভরে আছে দুর্লভ বইয়ে। শেলফে, খাটে সব খানেই বই। তিনি বলেন, ‘বইপড়ার প্রতি আগ্রহ ছেলেবেলা থেকেই। নিজের চেষ্টায় পড়ার চেষ্টা করেছি। কারণ শিক্ষকদের অনেকের মধ্যেও সীমাবদ্ধতা ছিল। পরবর্তী সময়ে যতবার বিদেশ গিয়েছি প্রচুর বই কিনে এনেছি।’ গানপ্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি। অবসরে গুনগুন করতেন নিজে নিজে। তিনি বলেন, ‘গানের মধ্যে রবীন্দ্র সঙ্গীত, ক্লাসিকাল মিউজিক ও পল্লীগীতি আমার পছন্দ। রবীন্দ্র সঙ্গীতের অনেক গান আমার মুখস্থ। কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, পংকজ মল্লিক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গান আমার বেশি পছন্দ। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন’, ‘এই করেছো ভালো নিঠুর’ ইত্যাদি গান খুবই প্রিয়। পল্লীগীতির ক্ষেত্রে আব্বাসউদ্দীনের গান আমার খুব প্রিয়। তার সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল। আমার প্রচুর লংপ্লে রেকর্ড ছিল। আমেরিকা থেকে রেকর্ড প্লেয়ার নিয়ে এসেছিলাম। গান শুনে শুয়ে শুয়ে লিখতে এবং পড়তে পছন্দ করি। আমার ছোটবেলা থেকেই এভাবে পড়ছি এবং লিখছি। এটা কাউকে দেখে শেখা নয়। এখন মাঝে মাঝে টিভি অনুষ্ঠান দেখি। এটা অনেকটা রিলিফ দেয়।’ ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (সিডিএ) চেয়ারম্যান ছিলেন আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া। সে সময়ের কথা জানতে চাইলে আবেগময় কণ্ঠে তিনি বলেছিলেন, ‘২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় কী হচ্ছিল সে বিষয়ে চট্টগ্রামে বসে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। সেদিন সন্ধ্যার পর চট্টগ্রামের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, অ্যাডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, এসপি, এএসপি, অ্যাডিশনাল কমিশনার আমার মেহেদীবাগের বাংলোতে এসে বললেন তারা রাতে এখানে গল্প করবেন। আমি তাদের স্বাগত জানালাম। পদের দিক দিয়ে আমি ছিলাম কমিশনারের মর্যাদায়, সিনিয়র মোস্ট অফিসার। রাতে তাদের কেউ কথা বলছিলেন, কেউ খেলছিলেন। এমন সময় হঠাৎ রাত দেড়টার দিকে এসপি বললেন, স্যার ঢাকার কী অবস্থা? আমি তাকে আমার ফোন দিলাম খোঁজ নিতে। ফোনে কথা বলে তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। সব কথা শুনে আমরা নির্বাক হয়ে গেলাম। সে রাতে অর্থাৎ ২৫ মার্চ রাত আড়াইটার দিকে শুরু হলো মাইকিং। চারদিকে একাধিক মাইকে অজানা কণ্ঠস্বরগুলো বারবার বলতে লাগলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। আপনাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়েই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। প্রায় সারা রাত মাইকে এই ঘোষণা চললো। তবে কে বা কারা এই ঘোষণা দিয়েছিলেন তা পরে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হান্নান বা আবদুল মান্নানকে জিজ্ঞাসা করেও জানতে পারিনি। কয়েকজন অজানা মানুষের মুখে আমরা সে রাতে স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা শুনেছিলাম। ২৮ মার্চ পাকিস্তানী আর্মি আমার বাড়ি ঘেরাও করে। আমার পরিবারকে আগেই সরিয়ে দিয়েছিলাম। তারা বাড়িতে যারা ছিলেন সবাইকে লাইন ধরিয়ে দাঁড় করালো। আমাদের গুলি করার আগেই আমি চিৎকার করতে থাকি, আমাদের কেন মারা হচ্ছে, আমাদের অপরাধ কি? শেষ পর্যন্ত গুলি না করে আমাদের অনেক দূর মার্চ করিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে অনেক কথা বলে ছেড়ে দেয় তারা। এরমধ্যে আমার প্রতিষ্ঠানের চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে পাকিস্তানীরা ধরে নিয়ে যায়। তার খোঁজে আমরা বিভিন্ন জায়গায় যাই। মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে বলি তার বিষয়ে খোঁজ নিতে। তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, তার কথা পাকিস্তানি আর্মিরা শুনবে না। আমি তাকে বলে আসি, এদের সঙ্গে থাকেন কেন? পরে আমার এক বিহারি সহকর্মীকে খোঁজ নিতে পাঠাই। সে এসে খবর দেয়, পাকিস্তানীরা জানিয়েছে চিফ ইঞ্জিনিয়ারের ফাইল বন্ধ করা হয়েছে! অর্থাৎ তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। চট্টগ্রামে যেমন সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তেমনি অনেক অভিজাত ব্যক্তি, ব্যবসায়ীসহ অনেকেই ছিলেন পাকিস্তানের সমর্থক। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখতেন আমার এক সহকর্মী। তারা আমাকে সরাসরি যোগাযোগ রাখতে নিষেধ করতেন। তারা মনে করতেন আমাকে ধরে নিয়ে টর্চার করলে হয় আমি মরে যাবো নয়তো সব কথা বলে দেবো। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা আমার কাছে সিটি ম্যাপ চেয়ে পাঠান। আমরা তখন খুব গোপনে চিটাগাং সিটির ম্যাপ চার টুকরো করে হকারদের মাধ্যমে পাঠাই। তাদের অপারেশনে এই ম্যাপ খুব কাজে এসেছিল। আমার বাড়িতে আলু আর চাল থাকায় যারা আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা অন্তত খেতে পারছিলেন। ঢাকার খবর কিছুই পেতাম না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে চরমপত্র মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। বিমান ছাড়া আর কোনো পথে যোগাযোগ সম্ভব ছিল না। পাকিস্তানীদের সন্দেহের তালিকায় আমার নাম ছিল। যুদ্ধের শেষ দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে আমাকে সরে যেতে বলা হলো। আমি কয়েকদিনের জন্য আমার এক বন্ধুর গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। ১৬ জুলাই ১৯৭১ রাত দুইটার সময় আমার একটি বই গুপিচন্দ্রের সন্ন্যাস-এর ভূমিকাতে লিখেছিলাম, সভ্যতার ক্রমবিকাশ থেকে আজ পর্যন্ত মানবতা এর চেয়ে জঘন্য রূপে বিপর্যস্ত হয়েছে কি না জানি না।... একটু বাতাস, একটু শব্দ, সামান্য একটু অস্বাভাবিক আওয়াজ, কোনো বিশেষ ব্যক্তিগণের একটু চাহনি, টেলিফোনের ক্রিং ক্রিং আওয়াজ- সব কিছুই মনে একটা দারুণ ভীতির সৃষ্টি করে- এই বুঝি এলো আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত!’ শেষ কথা নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে বললে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলেন,‘ যতোক্ষণ সময় পাই ততোক্ষণ লিখি। আমার অধিকাংশ বই কমপক্ষে তিনবার লেখা। আমার পক্ষে যতোদিন সম্ভব কাজ করে যাবো। আমি মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও কাজ করতে চাই।’
×