ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ আইন এবং একটি প্রস্তাব

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ১১ মার্চ ২০১৬

হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ আইন এবং একটি প্রস্তাব

স্বাতি মণ্ডল বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ধর্ম হচ্ছে হিন্দু। এ ধর্মের রীতিতে অনুষ্ঠিত বিয়েও বেশ পুরাতন। বিয়ের মূলমন্ত্রে রাখা হয়েছে- ‘যদেতং হৃদয়ং তব, তদস্তু হৃদয়ং মম। যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব।’ তাই হিন্দু বিয়ের মূল স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের পারস্পরিক সততা, বিশ্বাস ও সম্মান- যা ঈশ্বরের প্রতি সর্বোচ্চ ভক্তিস্বরূপ গৃহীত। বিবাহিত দুটি মানুষের মধ্যে যদি এর এক বা একাধিক শর্ত অনুপস্থিত থাকে, তবে তা বিয়ের মর্যাদা হারায়। যখন এরূপ পরিস্থিতি উপস্থিত হয়- সেখানে ঈশ্বরের আশীর্বাদ প্রাপ্তির আশা থাকে না তখন তার বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। বিজ্ঞানের এই যুগে এটি কারও জানা যে, ক্ষতিকারক টিউমারকে কেটে না ফেললে বা দূর না করলে তা ক্যান্সার আকারে পুরো শরীরকে নিঃশেষ করে দেয়। তেমনি অসুখী কিংবা নৃশংস দাম্পত্য জীবনের বিষ ধীরে ধীরে পুরো সামাজকে গ্রাস করার ইঙ্গিত দেয়। বাংলাদেশে ‘হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ আইন’ প্রচলন করার ক্ষেত্রে বার বার একটি কথা উচ্চারিত হচ্ছে তা ‘হিন্দু শাস্ত্রবিরোধী’। ‘হিন্দু ধর্ম’ অত্যন্ত আধুনিক এবং উদার। মানুষের কল্যাণে সে নিজে বারংবার উদাত্তচিত্তে পরিবর্তনকে গ্রহণ করার পথ সুগম করে দিয়েছে। একেশ্বরবাদিতা থেকে ‘যত মত তত পথ’-এ ঈশ্বরের আরাধনা এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। হিন্দু বিয়ের ক্ষেত্রে ঋগে¦দ ও অথর্ববেদে জ্যেষ্ঠভ্রাতার বধূর ওপর কনিষ্ঠভ্রাতাদের যৌন মিলনের যে অধিকার দান করা হয়েছিল- যার কিঞ্চিত অংশ আমরা মহাভারতে দ্রৌপদী ও পঞ্চপান্ডবের বিয়ের মধ্য দিয়ে দেখেছি তা আজ বিলুপ্ত হয়েছে। মহাভারতে পুরুষের বহুপতœী গ্রহণের যে রীতি আমরা পাই, সেটি রামায়ণের শেষাংশে অনুপস্থিত। কারণ স্বয়ং রামচন্দ্র সীতা ব্যতীত কারও দার গ্রহণ করেননি। তাই এটি বলা কখনোই যুক্তিযুক্ত নয়- ‘হিন্দু ধর্ম নিয়মের শৃঙ্খল।’ অত্যন্ত পীড়িত বোধ করি যখন বাংলাদেশের হিন্দু সমাজের কিছু অংশ হিন্দু ধর্মের এ গৌরবকে অস্বীকার করেন। বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করে বলেন- ‘হিন্দু স্ত্রীরা স্বামী থেকে পৃথক বসবাসের অধিকার নিয়ে আজীবন মর্যাদার সঙ্গে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী এবং স্বামীর পরিবারের স্থায়ী সদস্য।’ মনে পড়ে স্বামীর পরিবারের স্থায়ী সদস্য হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য এসিডদগ্ধ নম্রতার কথা- যার স্বামী তার নিজস্ব জমানো সব টাকাপয়সা হাতিয়ে নেয়ার পর এসিড খাইয়ে দিয়েছিল। এটি যদি পরিবারের সদস্য হওয়ার উপকারিতা হয়, তবে নিঃসন্দেহে কিছুদিন পরে এ দেশের প্রত্যেক পরিবারের সদস্য একে অন্যকে নৃশংসভাবে হত্যার চেষ্টা করার নজির স্থাপন করতে থাকবে এবং সেটি কতটা ভয়াবহ- তা ভাবতেও ভয় হয়। ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ডেইলি স্টারে একজন হিন্দু নারী নাম প্রকাশ না করে তার ওপর সংঘটিত বর্বোরোচিত নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছিলেন। শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত- দুই ধরনের নারীই নির্যাতনের শিকার। ২০০৪ সালে কিংবা তারও পরবর্তী সময়ে তৃণমূল হিন্দু নারী সমাজের প্রতিনিধি কাজল রানী দাস যেমন স্বামী দ্বারা প্রতারিত ও নিগৃহীত হন আমার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকাও এর ব্যতিক্রম নয়। কোন প্রেমের বিয়ে নয়। পারিবারিকভাবে প্রস্তাবকৃত বিয়ের ক্ষেত্রে অসম্মতি জানানোর কারণে প্রতিশোধ আর নির্যাতনের তিক্ত স্মৃতি আমার। বিয়ের পর থেকে চলা বিভিন্ন নির্যাতনে জর্জরিত আমি হতাশার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে বেঁচে থাকার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেছিলাম- তবুও সংসারের বাঁধনটুকু টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। বিফল হয়েছি। একজন অসৎ, অন্য নারীর প্রতি আসক্ত এবং মানসিকভাবে বিকৃত মানুষের সঙ্গে ‘বিয়ে’ নামক পবিত্র বন্ধনের আবশ্যকতা কতটুকু? যে বন্ধনে হৃদয়ের অস্তিত্ব শূন্য- যার কাছ থেকে স্ত্রীর সম্মান আর অধিকারের মূল্য পাবার কোন আশাই নেই- তার কাছ থেকে পৃথক বসবাসের মর্যাদা কতটুকু? যার জীবনের লক্ষ্য আমাকে রিক্ত করা- সে আমাকে বেঁচে থাকার রসদ জোগাবে? শুধু নারীরাই যে এমন দুঃখের ভার বহন করছে তেমন নয়। বিয়ে যেহেতু নারী ও পুরুষের উভয়েরই মেলবন্ধন- বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের অভাবে পুরুষরাও ভুক্তভোগী হচ্ছে। আমার চেনা এক কাপড় ব্যবসায়ী ‘নারী নির্যাতন’ আইনের শিকার। প্রথম স্ত্রী দুর্র্ঘটনায় মৃত্যুবরণের পর তার নাবালক সন্তানের দেখভাল করার জন্য একজন দরিদ্র ও মধ্যবয়সী নারীকে বিয়ে করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তার স্ত্রীর দুর্ব্যবহার ও সীমাহীন লোভ জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। তিনি তার শ্বশুরবাড়িতে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ও গহনা দিয়ে স্ত্রীকে রেখে আসেন। যেহেতু বাংলাদেশে কোন বিচ্ছেদ আইন নেই- তাই স্ত্রী একদিন সুযোগ বুঝে তার বিরুদ্ধে ‘নারী নির্যাতন’ মামলা করেন এবং মোটা অংকের টাকা আদায় করেন। আমার চেনা আরেকজন ঢাকায় গার্মেন্টসে অল্প আয়ে চাকরি করেন। বিয়ের পর থেকেই স্ত্রীর নিরন্তর চাহিদা মেটাতে ক্লান্ত। এমনই এক ক্লান্ত বিকেলে ভালবাসার ছোঁয়া নিয়ে জীবনে আসে অন্য নারী। প্রথম স্ত্রী পৃথকবাসের আবেদন করেন। বর্তমানে অমিত রায়কে দুই স্ত্রীর ভরণপোষণ বহন করতে হচ্ছে। সেখানে প্রথম স্ত্রী বাস্তবিক পক্ষে অনুপস্থিত। বাংলাদেশে হিন্দু নাগরিকদের দাম্পত্য জীবনের এ করুণ সুর কি ‘শাস্ত্রবিরোধী’ সেøাগানের নিচে চাপা দেয়া হবে নাকি মানুষ বিকল্প পথ খুঁজবে? যদি ‘শাস্ত্রবিরোধী’ হয় তবে পার্শ¦বর্তী দেশ ভারত কেন ‘হিন্দু ম্যারেজ এ্যাক্ট’-১৯৫৫ সালে প্রবর্তিত করে ‘বিবাহ বিচ্ছেদের’ বৈধতা প্রমাণ করল তা অবশ্যই জানার বিষয়। বহু জন্ম পার হয়ে পাওয়া এ মানব জন্ম সার্থক করার অধিকার নারী ও পুরুষ উভয়েরই। তাই হিন্দু শাস্ত্র কখনোই কোন তিক্ত বৈবাহিক সম্পর্ককে গ্রহণযোগ্য করেনি। মহর্ষি মনু পুরুষের দ্বিতীয় বিবাহের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম বেঁধে দিয়েছিলেন। যদি প্রথম স্ত্রী মদ্যপায়িনী হয়। দীর্ঘকাল ব্যাধিতে আক্রান্ত থাকে। প্রবঞ্চক হয়, সর্বদা কর্কশ কথা বলে, অমিতব্যয়ী হয় এবং শুধু কন্যাসন্তানের জন্ম দেয় তবেই তার পরিবর্তে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করা যাবে। তবে অবশ্যই তাকে শোধরানোর চেষ্টা করতে হবে। মহর্ষি কৌটিল্যের মতে- প্রথম স্ত্রী জীবিত থাকতে অপর স্ত্রী গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বামীকে দীর্ঘ সময় (আট থেকে তেরো বছর) অপেক্ষা করতে হবে। এবারে লক্ষ্য করা যাক, পরিত্যক্ত স্ত্রীর দ্বিতীয় বিবাহ সম্পর্কে। আদি হিন্দু সমাজে পুনর্ভূ অর্থাৎ মহিলাদের পুনর্বিবাহের অধিকার প্রাপ্তির প্রমাণ রয়েছে। মহর্ষি নারদ এবং কৌটিল্যের মতানুযায়ী পাঁচটি ক্ষেত্রে নারী অন্য পতি গ্রহণ করতে পারেন- স্বামী নিখোঁজ হলে, মারা গেলে, সন্ন্যাস নিলে, যৌন ব্যাপারে অক্ষম হলে এবং পতিত হলে অর্থাৎ নৈতিকতার স্খলন হলে। সর্বোপরি হিন্দু ধর্মের ভিত্তি ‘বেদ’-এ সর্বদা নারী ও পুরুষের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক স্থাপনের প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। তাই যারা বাংলাদেশের বিবাহ বিচ্ছেদকে শাস্ত্রবিরোধী বলেছেন, তারা হিন্দু ধর্মের আধুনিকতা ও উদারতাকে খাটো করছেন মাত্র। হিন্দু ধর্ম মানুষের প্রয়োজনের কথাভাবে বলেই ‘সতিদাহ প্রথার’ বিলুপ্তি ঘটেছে, প্রসার ঘটেছে ‘বিধবা বিবাহ আইন’ ইত্যাদি। ধর্ম ধারণ করে যেখানে মানুষ বাঁচতে শেখে, তা কখনোই কাউকে বিষাক্ত জীবনের দিশা দেখায় না। আমি বিশ্বাস করি হিন্দু ধর্ম মানুষের জীবনের সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দেয় যা একটি সফল সমাজ গঠনের চাবিকাঠি। তাই গীতার সারাংশে বলা হয়েছে ‘পরিবর্তনই সংসারের ধর্ম’। তাই বাংলাদেশের হিন্দু সমাজের প্রতি আকুল আবেদন- আমাদের ধর্মকে পূর্ণ সম্মান দিয়ে ‘বিবাহ বিচ্ছেদ আইন’ প্রণয়নে সহযোগিতা করুন। এই বিবাহ বিচ্ছেদ শুধু একটি স্বাক্ষরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। যার বিবাহ বিচ্ছেদ দরকার স্বামী/স্ত্রী ভেদে তিনি আদালতের আশ্রয় নেবেন। আদালত তার বিবাহ বিচ্ছেদের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে ডিক্রী দেবেন। কিন্তু আইনে এই বিধানটুকু না থাকার ফলে আমরা অনেক নারীরাই কখনো কখনো পুরুষরাও বাধ্য হচ্ছি স্বামী-স্ত্রীর বিষাক্ত সম্পর্কের মধ্যে কাটাতে। তাই প্রধানমন্ত্রীসহ হিন্দু সমাজের সকল প্রতিনিধিদের কাছে আমাদের ভুক্তভোগী সমাজের আকুল আবেদন- আমাদের জীবনকে তুলনামূলক সহজ করে চলার স্বাধীনতা দানে সহযোগিতার হাত বাড়ান; মানবতার জয়কে আরেকবার নিশ্চিত করুন। সৌজন্যে : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)
×