ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ১১ মার্চ ২০১৬

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া

জাবেদ বিন হাকিম ঢাকার কাছেই রসুলপুর, খবর রাখে কে? দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ সংগঠনের দেশ চেনা আয়োজনের কর্মসূচী হিসেবে এবার গিয়েছিলাম পাঁচগাঁও ও রসুলপুর। পুরো গ্রামজুড়ে সারি সারি খেজুর-তালগাছের রয়েছে ছড়াছড়ি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ছুটি নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজার উপজেলার পুরিন্দাবাজার অভিমুখে। গাড়ি থেকে নেমেই পেয়ে যাই, গরম গরম মিষ্টি, সঙ্গে গরুর দুধের চা। কোনটা রেখে কোনটা খাই, অবশেষে খাওয়া আর পান দুটোই চলে সমান তালে। ইতোমধ্যে দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের সব বন্ধু এসে হাজির। ধুপধাপ কিছুক্ষণ সেল্ফি আর ফটোসেশন। শাহীন মামুর উচ্ছ্বাসে মনে হয়, সে যেন বুড্ডার আড়ালে-উদ্দিপ্ত তরুণ। সিএনজি অটোরিক্সাতে চেপে, মুরগি ভরা হয়ে ছুটি রাজু খন্দকারের বাড়ি। অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে যাই পাঁচবাড়িয়া ইউনিয়নের পাঁচগাঁও গ্রামে। মায়াবি চাঁদের রোশনি যেন ভর করেছে, গ্রামের মাঠ-ঘাট আর নানান গাছ গাছালির ওপরে। রাতের নীরবতায় ছেদ পড়ে আমাদের উচ্ছ্বাসে। আসলে নগরের ঘিঞ্জি পরিবেশে বাস করা মানুষেরা একটু খোলামেলা, বিশেষ করে গ্রামে গেলে এমনিতেই আপ্লুত হয়ে পড়ে। সিএনজি অটোরিক্সা ছেড়ে গ্রামের পথ ধরে কিছুদূর হাঁটার পরেই থামি খন্দকার বাড়ির ফটকে। আসার আগেই জেনেছি বাড়িটি প্রায় পরিত্যক্ত। ভেতরে ঢুকতেই চোখ গিয়ে উঠে কপালে। খন্দকার বাড়ি বলে কথা। বিশাল উঠোন তার পাশেই সান বাঁধানো পুকুর, পুরনো সব গাছ। মাথার ভেতর ভূত দেখার নেশা চেপে বসে। কিন্তু বুঝতে দেই না সঙ্গীদের। এরই মধ্যে মাল্টিক্স ফারুক আর ইউশা শুরু করে দেয় মুরগি পোড়ার কাহিনী। ইয়া উঁচু কদবেলগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আসা জোছনার আলো, সঙ্গে রাতুলের গিটারে সুরের মূর্ছনায় চলে বারবিকিউ। রাতের খাবার শেষে, শিয়াল দেখার বায়না তুলে- ছুটি ভূতের সন্ধানে (বদজিন)। শুনতে অবাক শুনালেও কথা সত্য! চারপাশ থেকে ভেসে আসে খেক শিয়ালের ডাক কিন্তু আমাদের মতো পাতি শিয়ালদের (বাউন্ডেলে) ভয়ে খাটি শিয়ালের দল লাপাত্তা। পুরো গ্রাম প্রায় চষে বেড়াই। রাত তখন দুটো। ভূত-শেয়ালের দেখা না পেয়ে নিজেরাই কিছুক্ষণ ভূতের অভিনয় করে, ঘরের পথ ধরি। ঘুমের প্রস্তুতি। উঠতে হবে বিয়াইন (ফজরের সময় ) রাতে, তাই বিছানায় শুয়ে খানিকটা সময় চোখ বুজে রই। আমার খুক্কুর খুক্কুর কাশির কর্কশ সুরে, অন্যদেরও ঘুম গিয়ে মাচায় চড়ে। এপাশ-ওপাশ করতেই ভোর পাঁচটা। বিছানা ছেড়ে অজু করে সোজা মসজিদে। জমাতে নামাজ আদায় করে ছুটি পার্শ্ববর্তী গ্রাম রসুলপুরে। কুয়াশা ভেদ করে সোদা মাটির গন্ধ শুকতে শুকতে অটোরিক্সা পৌঁছে একেবারে খেজুর বাগানের প্রায় রসের হাঁড়ির সামনে। চলে রস পান আর ফটোসেশন। এখানে রয়েছে ৮৫টি খেজুর গাছ। গাছের ছায়ায় বিল, দিগন্তজোড়া শস্যক্ষেত। পুরো পরিবেশটাই এক অন্যরকম ঘোর লাগা মায়ায় আচ্ছন্ন। ইচ্ছেমতো রস পান আর গাছিদের সুখ-দুঃখের একাল-সেকালের গল্প শুনে, ছুটি এবার গ্রাম দর্শনে। সবজি ক্ষেতের আইল ধরে-গ্রামের মেঠো পথ মাড়িয়ে ঘুরে বেড়াই মহানন্দে। দে-ছুটের পোলাপাইন্না পানা দেখে, গ্রামের যুবা-বৃদ্বরাও যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। রসুলপুর গ্রামবাসী কৃষি জমি আবাদের পাশাপাশি, তাঁতের কাপড়ও বুনে থাকে। ভয়েল, গামছা, পর্দা কাপড়ের গ্রে তৈরি করে থাকে। আমরা তাদের কারখানায় ঢুকে অভিজ্ঞতা নেয়ার পাশাপশি, নিজেকে চিনতে শিখি। কত পরিশ্রমের পরেও তাদের ঠোঁটের কোনায় চিক চিক হাসি। চোখের চাহনিতে ফুটে উঠে, আতিথেয়তার বাণী। অথচ শহুরে মানুষগুলো নিজেকে নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকার পরেও, শত আশায় ভুগে। লাখোপতি থেকে কোটিপতি, কোটিপতি হতে অধিপতি তবুও যেন মিটে না চহিদার গ্লনি। গ্রামের মানুষগুলোর রয়েছে দুটা করে গাভী, গোটা কয়েক ব্লাক বেঙ্গল আর কিছু হাস-মুরগি, রাতে ঘুমানোর জন্য মাটি বা ছনের ঘর, তাতেই তারা বেজায় খুশি। ভ্রমণে যেখানেই যান না কেন দেখার পাশাপাশি শেখারও রয়েছে অনেক কিছু। বেশকিছু দোকান ঘর চোখে পড়তেই, চা পানের জন্য নেই বিরতি। দোকানিকে জায়গার নাম জিজ্ঞাসা করতেই জানাল এটা নরসিংদী। শুনে বেশ মজা পাইলাম। সাত সকালেই এক জেলা থেকে আরেক জেলা। বাজারটা হলো নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীর সীমান্তবর্তী। চলে চা পান আর মাস্তি। অতঃপর ফিটনেসবিহীন গাড়ির চাইতেও ভয়ানক বাহন অটোতে চড়ি, ছুটি সেই ভাললাগার নেশা ধরা খন্দকার বাড়ি। সকালের নাশতায় প্রথমে গরম গরম ভাপাপিঠা পরে গরুর গোস্তের ঝোল দিয়ে পছন্দের তালিকায় নম্বর ওয়ান চিতইপিঠা। আহ্ কি মজা, স্বাদে অতুলনীয়, আয়োজনে আরাফাত। টাকার বিপরীতে পিঠা খেলেও, পরিশ্রম করে যারা তৈরি করেছেন তাদের প্রতি আন্তরিক সাধুবাদ। পিঠাপর্ব শেষে এবার গ্রামের পশ্চিম পাশটায় হাইকিং। ওমা একি! নগরায়নের বিষাক্ত থাবার আঁচড় দেখি, এখানেও পড়তে শুরু করেছে। তাহলে কি থাকবে না এই সবুজ প্রান্তর। অচিরেই কি হারিয়ে যাবে আমাদের গ্রাম বাংলার মেঠো পথ? পূর্বাচলের বাতাস এখানেও ছুঁয়েছে। গ্রাম আর গ্রাম থাকবে নারে ছৈয়াল। ভবিষ্যত প্রজম্ম যেন আর্কাইভে ছবি দেখে জানতে পারে, আমাদের দেশটা সবুজ প্রকৃতি দিয়ে ঘেরা ছিল কত সুন্দর। সেই আবেগ থেকেই মুজাহিদ তার ক্যামেরার সার্টার চাপে অসংখ্যবার। এবার জুম্মার প্রস্তুতি। নামাজ শেষে, দুপুরের আহার কালিজিরা চালের আঠালো খিচুড়ি সঙ্গে মুরগি গোস্তের ভুনা আর ডিমের ঝোল। চেটে- পুটে খেয়ে, বিদায়ের করুণ সুরে, ভাললাগার কিছু স্মৃতি মনে গেঁথে, পথ ধরি ঢাকার দিকে। বিদায় পাঁচগাঁও বিদায় পুরিন্দা। কিভাবে যাবেন : ঢাকার গুলিস্তান হতে বিভিন্ন পরিবহনের গাড়ি যায় মধাবদী ও পুরিন্দাবাজার। ভাড়া জনপ্রতি ১০০ টাকা। সব চেয়ে সুবিধা হবে নিজস্ব/রেন্টকার নিয়ে গেলে। সকালে গিয়ে সন্ধ্যায়ও ফিরতে পারেন। যদি রাতে থাকতে চান তাহলে কেয়ার টেকারের অনুমতি নিয়ে খন্দকার বাড়িতে অথবা মধাবদী বাজার। কত খরচ হবে : জনপ্রতি হাজার বারো শ’ হলেই যথেষ্ট।
×