ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সুন্দরবন ॥ দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ১১ মার্চ ২০১৬

সুন্দরবন ॥ দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ

কাজী সেলিম আমাদের বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তথা গোটা দেশের এবং বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক মনোহরণকারী লীলাভূমি সুন্দরবন। বনটিতে বিভিন্ন ধরনের মূল্যবান গাছ, বিভিন্ন জাতীয় প্রাণীকুল যথা, বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বাঘের অবাধ বিচরণ কেন্দ্রের সরকার ঘোষিত একটি বিশাল সংরক্ষিত বনাঞ্চল। ১৯৭৪ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সরকার সুন্দরবন তথা গোটা দেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও রক্ষার্থে ‘জাতীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন’ প্রণয়ন করেছিল। দেশের জাতীয় বন্যপ্রাণী, পশুপাখিপ্রেমিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের বনাঞ্চলে পশুপাখিদের জন্য একটি নিরাপদ অভয়ারণ্য ও তাদের অবাধ মুক্ত বিচরণ এবং সংরক্ষণ ও রক্ষার্থেই এই আইন প্রণয়ন করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর পরবর্তী সরকারসমূহের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, আমলা, পুলিশ সামরিক-বেসামরিক ভিআইপি ও তাদের সফরসঙ্গী পোষ্যগণ সুন্দরবন ভ্রমণে গিয়ে হরিণ ও বন্দুকের আওতায় থাকলে বাংলাদেশের গর্বের প্রতীক। রয়েল বেঙ্গল টাইগার হত্যা করতে ও সঙ্কোচ করতেন না। গর্বের বিষয় বঙ্গবন্ধুকন্যা, শেখ হাসিনার সরকার ১৯৭৪-এর বন্যপ্রাণী আইনের কঠোর নীতি অনুসরণ করায়, সুন্দরবনের বন্যপশু প্রাণীদের প্রতি বন বিভাগীয় কর্মকর্তা অথবা ভ্রমণকারী ভিআইপি সাহেবরা ও সাধারণ পর্যটকগণ বেশ যতœবান। গত ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ সালে সুন্দরবন সফর করতে গিয়ে বিষয়টি আমি বন বিভাগের কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে জানতে পারলাম। শুনে আনন্দিত হলাম যে, এখন আর পূর্বের ন্যায় সফরকারী সরকারী উচ্চ আমলা শ্রেণীর পর্যটক ভ্রমণকারীরা সুন্দরবনে গিয়ে হরিণ বা বাঘ শিকারের অবৈধ সদিচ্ছার কথা বা শিকারের আয়োজনের কথা সফরসঙ্গী আর্দালি চাপরাশিদের কাছে ব্যক্ত করার সাহস পান না। সুন্দরবন ভ্রমণ করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই বিশাল লীলাভূমিতে বিচরণকারী, দেশের সাহসিকতা সৌম্য বীর্যের গর্বের প্রতীক, দুঃসাহসিক রয়েল বেঙ্গল টাইগারদের দর্শন লাভের আকাক্সক্ষা ছিল দীর্ঘদিনের। দেশের বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি হতে গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, খুলনা হয়ে সুন্দরবন যাওয়া ও ভ্রমণ করাটা খুব দুরূহ একটি ব্যাপার নয়, বহু পূর্বের এই অমূলক মনের প্রশান্তি দূর করে তাই গত বছরের (২০১৫) ২৮ ডিসেম্বর আমার দুই প্রকৃতি, গাছপালা, বন্য পশুপাখি ও পরিবেশপ্রেমিক সন্তানসহ সর্বমোট দশজন ঢাকা থেকে বিমানযোগে যশোর বিমানবন্দরে পৌঁছলাম। সুন্দরবন ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে পূর্ব আয়োজিত এই সফরের অংশ হিসেবে যশোর বিমানবন্দর হতে মাইক্রোবাসযোগে প্রায় তিন ঘণ্টা পর মংলাঘাটে পৌঁছলাম। ঢাকা হতে যশোর পর্যন্ত বিমান যাত্রাটি যদিও আরামদায়ক ছিল। কিন্তু যশোর শহর অতিক্রম করার বেশ কয়েক কিলোমিটার অতিক্রম করার পর, মংলামুখী মহাসড়কযোগে যাত্রাটি যেন বিমানের আরামটিকে নস্যাৎ করে দিল। আমিসহ সকলেই বিষয়টি অতি সহজেই গ্রহণ করে নিয়েছিলাম। ভাগ্যিস, আমাদের সফরসঙ্গী ২-৪ জন আমেরিকান বঙ্গসন্তান ব্যতীত সাদা চামড়ার পশ্চিমা কোন বিদেশী পর্যটক ছিল না। হয়ত বা সড়কের যানজট ও পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তাদের কোন সন্তোষজনক সদুত্তর দেয়ার বা ভনিতা করে মিথ্যা কোন তথ্য-উপাত্ত বা উৎস আমার কাছে প্রস্তুত ছিল না। মংলা অভিমুখী দীর্ঘ তিন ঘণ্টার রাস্তার চারপাশে একটি মানসম্মত চা রেস্তোরাঁর অথবা একটি ভাল পাবলিক টয়লেটের অস্তিত্ব চোখে পড়েনি। বাধ্য হয়ে একটি বাজার সম্ভবত জিরো পয়েন্টের ধুলাযুক্ত নোংরা মাছি পরিবেষ্টিত পরিবেশের মধ্যস্থলে একটি চায়ের দোকানের সামনে যাত্রা বিরতি করে সকলে এক কাপ চা ও সঙ্গে বহনকৃত কিছু হাল্কা খাবার নিয়ে নিলাম। এবার সহযাত্রীদের প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেয়া জরুরী হওয়ায়, পথিমধ্যে একটি সদ্য নির্মিত পেট্রোল স্টেশনে যাত্রা বিরতিকালে, অসমাপ্ত পেট্রোল স্টেশনের টয়লেট তালাবদ্ধ থাকায় ম্যানেজারকে অনুরোধ করে খোলার ব্যবস্থা করে দেখা গেল যে, ভেতরের পানির কলগুলো অচল ও পানির অভাব। ভাগ্যিস সকলের সঙ্গে বহনকৃত পান করার মতো পানি ছিল। গাড়িতে উঠে পুনরায় মংলার দিকে যাত্রা শুরু করার পর হঠাৎ ভাবলাম যে এই দীর্ঘ পথের চারদিকে শুধু ইটের ভাটা ও চিংড়ি মাছের ঘের ছাড়া সদয় দয়ালু আধুনিক রুচিসম্মত হোটেল-রেস্তোরাঁ ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট এবং মোটেল পরিচালনাকারী ব্যবসায়ীর এত অভাব কেন? জাতীয় পর্যটন কর্পোরেশন বা পর্যটন মন্ত্রণালয় কি কাজ করে থাকে? সুন্দরবনে ভ্রমণকারী দেশী-বিদেশী পর্যটকদের স্বার্থে, পর্যটন কর্পোরেশন একা অথবা কোন সংস্থার সঙ্গে যশোর-মংলার সড়কের ৬-৭ কিলোমিটার পরপর প্রয়োজনীয় স্থানে আরামদায়ক, মানসম্মত মোটেল, রেস্তোরাঁ ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট নির্মাণ করে, পর্যটকদের পয়সার বিনিময়ে উপকার করে ভ্রমণকারী পর্যটক মানুষদের সুন্দরবন ভ্রমণকে অধিক আরামদায়ক করে ব্যবস্থা পরিচালনা করতে পারে। বিমান পর্যটন মন্ত্রণালয় ও পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান এমডি সাহেবরা কি জানেন বা বুঝেন এই করণীয় দায়িত্বগুলো সম্পন্ন করে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের স্বার্থে ও দেশের মুদ্রা রাজস্ব অর্জনের পথকে সুগম করতে যথাযথ ব্যবস্থা করা উচিত। নাকি প্রতিবছর শুধু পর্যটন সপ্তাহ উপলক্ষে একটি ঘোড়ার গাড়িকে সুসজ্জিত করে মিন্টু রোডের এপাশ-ওপাশজুড়ে একটি র‌্যালি প্রদর্শন ও পাঁচ তারকা হোটেলে একটি সেমিনার ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থার মাধ্যমেই সুন্দরবন তথা সমগ্র বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সৌন্দর্যের লীলাভূমিগুলোতে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ও বাংলাদেশে সফর ও আগমনের বাণী প্রচার করে কিছু রং-বেরঙের পোস্টারিং করাই কি যথেষ্ট ভূমিকা পালন করছে পর্যটন বিমান মন্ত্রণালয় ও পর্যটন কর্পোরেশন? মংলাঘাট হতে সুন্দরবন যওয়ার মাধ্যম হলো লঞ্চ বা বোট। এই সকল লঞ্চ বা বোটের মাধ্যমেই দেশ বিদেশের অসংখ্য পর্যটক সুন্দরবন পরিদর্শনে গিয়ে থাকেন। সুন্দরবন ও মংলাঘাট পর্যন্ত চলাচলকারী ওই সকল নৌযানগুলোর জন্য মংলাঘাটে বিশেষ কোন লঞ্চ জেটি বা পন্টুনের ব্যবস্থা নেই। যশোর হতে মংলাঘাটে পৌঁছে একটি জীর্ণশীর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ সাধারণ পন্টুনের মাধ্যমে পর্যটকদের লঞ্চ বা বোটে উঠতে হয়। (চলবে)
×