ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

স্বর্গসম বেলফাস্ট

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ১১ মার্চ ২০১৬

স্বর্গসম বেলফাস্ট

ফারজানা সুমনা বেশ কিছুদিন ধরেই পরিকল্পনা চলছিল ব্যস্ত শহুরে জীবন ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাওয়ার। পরিকল্পনামতো আমরা দুই বন্ধুতে মিলে ৩ দিনের একটা ট্যুর দিয়ে ফিরলাম মোহনীয় আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্ট থেকে। মাঝরাতে লন্ডনের স্থানীয় সময় সাড়ে ৪টায় কনকনে শীতে কাঁপতে কাঁপতে লোকাল বাস ধরে একা অবলা আমি (!) স্ট্রাটফোর্ডের সিটি সেন্টারে পৌঁছালাম স্ট্যানস্টেড এয়ারপোর্টগামী ন্যাশনাল এক্সপ্রেস ধরার জন্য, সেখান থেকে বন্ধুকে নিয়ে এক ঘণ্টার উড়াল পথে সোজা বেলফাস্ট ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। হোটেলে চেক ইন করে ব্রেকফাস্ট সেরে প্রথমদিনেই বেলফাস্টের চমৎকার হপ অন-হপ অফ সিটি ট্যুর বাসে করে দেখে নিলাম শহরটাকে। হপ অন-হপ অফ বাস সার্ভিসের চমৎকার দিক হলো, এক টিকেটে এক নাগাড়ে ৪৮ ঘণ্টা শহরের যে কোন প্রান্ত থেকে বাসে ওঠা যাবে, আবার যেখানে খুশি বাস থেকে সেখানে নেমে পড়া যাবে। কোন এক ট্যুরিস্ট স্পটে এসে বাস থামে, যাত্রীরা পছন্দমতো স্থানে নেমে যায়; বাসের কন্ডাকটর এবং একই সঙ্গে ধারাভাষ্যকার জানিয়ে দেয় এই বাস স্টপ থেকে পরের বাসটা কখন ধরা যাবে। টাইটানিক কোয়ার্টার, বেলফাস্ট সিটি হলো, নর্দান আয়ারল্যান্ড পার্লামেন্ট বিল্ডিংস, আলস্টার মিউজিয়াম, বোটানিক গার্ডেন, কুইন্স ইউনিভার্সিটি-কিছুই বাদ দেইনি ঘুরতে। টাইটানিক কোয়ার্টার বেলফাস্টের পর্যটকদের খুব প্রিয় একটি স্থান। বিখ্যাত জাহাজ টাইটানিক, যে কি না তার প্রথম যাত্রায় ডুবে যায়, সেই জাহাজের নির্মাণ স্থান বেলফাস্ট। আমরা হয়ত অনেকেই জানি না, টাইটানিকের বড় ও ছোট আরও দুটো বোন আছে; মানে টাইটানিকরা তিন বোন অলিম্পিক বড়, মেঝ হলো টাইটানিক আর কনিষ্ঠটার নাম ব্রিটানিক। ২০০৩ সাল পর্যন্ত এই একই ইয়ার্ডের অজস্র জাহাজ নির্মাণ করা হয়েছে যেগুলো সমুদ্রে বিনা দুঘর্টনায় ভেসে চলেছে। কিন্তু কেন যে এই ইয়ার্ডটা ডুবে যাওয়া জাহাজটার নামে টাইটানিক কোয়ার্টার নামেই পরিচিত তা জানা নেই। ট্যুর গাইডের কাছে শুনলাম লিওনার্দো ডিক্যাপরিওর টাইটানিক সিনেমার পর অনেকেই ট্যুর গাইডদের জিজ্ঞেস করে জ্যাকের বাড়ির ঠিকানা! যাত্রার ক্লান্তিতে সে রাতে আগেভাগেই ডিনার শেষে হোটেলে ফিরে গেছি। পরের দিন সকালবেলা থেকে পুরো দিনের ভ্রমণই ছিল গেম অব থ্রনসের শূটিং স্পটগুলোতে। একপাশে পাহাড় আর অন্য পাশে আইরিশ সাগর নিয়ে মাঝখানে ছুটে চলে পথÑ এক কথায় অসাধারণ অনুভূতি! খুব ভাল লেগেছে এটা শুনে যে, গেম অব থ্রনসের সব এক্সট্রা কলাকুশলীকে অবশ্যই নর্দান আয়ারল্যান্ডের হতে হবে, এই শর্তে শূটিংয়ের অনুমতি দিতে রাজি হয়েছে উত্তর আয়ারল্যান্ডের গবর্নমেন্ট। ফলে স্থানীয় জনগণের কিছুটা বাড়তি আয়ের উৎস হয়ে গেছে এই সিরিজ। আমাদের ট্যুর গাইড মেয়েটা গর্ব করেই জানালো তার পেইন্টার চাচা, কার্পেন্টার বন্ধু সবাই গেম অব থ্রনসের অভিনেতা। এক একটা শূটিংস্পটের উদ্দেশ্যে আমরা যাত্রা করি আর সেখানে পৌঁছানোর আগে এই সিরিয়ালের ওই স্থানে করা ছোট্ট একটা ক্লিপিং দেখিয়ে দেয়া হয় আমাদের বাসের টিভিতে। চমৎকার পরিকল্পনা! দুপুরের লাঞ্চ করলাম জায়ান্ট কসওয়ের কাছে এক লোকাল আইরিশ পাব-এ। স্থানীয় গোট চীজ, লাল পেঁয়াজ দিয়ে করা কী অসম্ভব সুস্বাদু সেই স্যান্ডউইচ! কেইভ, রোপ ব্রিজ, কসওয়ে কোস্টাল এরিয়া, জায়ান্ট কসওয়ে আর সবশেষে ডার্ক হেজেস দেখে যখন বাড়ি ফিরছি তখন বাইরে সূর্য ডুবছে আর বাসের মধ্যে চলছে আইরিশ কান্ট্রি মিউজিক। ততক্ষণে সারাটা দিনে প্রায় মাইল দশেক পাহাড়ী পথে হাঁটাহাঁটি হয়ে গেছে আমাদের। আয়ারল্যান্ড এতই মোহময়ী যে টিপিক্যাল আইরিশ ঠা-া আর বৃষ্টিতেও ভ্রমণে ক্লান্তি ছিল না এতটুকু। ট্যুর শেষে সন্ধ্যায় বেলফাস্ট ফিরে রাতের আলোকিত শহরটা ঘুরেফিরে দেখলাম। পরদিন সকালবেলা ব্রেকফাস্ট শেষে বেলফাস্টের বিখ্যাত সেইন্ট জর্জসে লোকাল মাকের্টে ঘুরেফিরে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে গল্পগুজব কর; তাদের তৈরি হস্তশিল্প দেখে আর লাইভ মিউজিকের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়ে সারাটা দিন কাটিয়ে দিলাম। বন্ধু পরিজনের জন্য এটা-ওটা কিনলাম ফিরতি পথে। এভাবেই কোথা থেকে যেন উবে গেল তিনটে দিন। রাত গড়ালেই বাড়ির পথে দুটো দস্যি মেয়েকে নিয়ে উড়ল এক নারী বৈমানিক। পুনশ্চ ১. আবারও শহুরে জীবন ছেড়ে পালানোর পরিকল্পনা করছি। খুব শীঘ্রই! ২. জানি না কেন উত্তর আয়ারল্যান্ডের মানুষগুলোর সঙ্গে পশ্চিম বাংলার বাঙালীদের মিল খুঁজতে চাইছি বার বার। ওরা বলছে, বেলফাস্ট এখনও ভীষণ রকম আইরিশ। ডাবলিন খুব বেশি কসমোপলিটন হয়ে গেছে, যেমনটা হয়েছে লন্ডন। লন্ডন যথার্থই ইংরেজ রাজধানী, কিন্তু ডরসেট বা সরে এর মতো ইংরেজ ঐতিহ্য লন্ডনে আর অবশিষ্ট নেই। ব্রিকলেনের তান্দুরি চিকেন বা কারি হাউসে ডিনার করা আর এজওয়ার রোডে সিসা করতে যাওয়ার মধ্যেই লন্ডনের সাবর্জনীনতার প্রকাশ পায়। অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপের সঙ্গে সঙ্গে পযর্টকদের তুমুল আকর্ষণ দুই আয়ারল্যান্ড বিভক্তির রাজনীতিতে। তাইতো ট্যুর গাইডদের গল্পে, চুটকিতে বার বার এসে যায় গুড ফ্রাইডের চুক্তি। এতদিন জানতাম প্রটেস্ট্যান্ট আর ক্যাথলিকের বিদ্বেষে বিভক্তি ঘটে আয়ারল্যান্ডের। রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ড আলাদা হয়ে যায় উত্তর আয়ারল্যান্ড থেকে। এবার জানলাম ধর্ম মূল বিষয় নয়, বরং ধর্মের ঢালের আড়ালে ন্যাশনালিস্ট আর ইউনিয়নিস্টরা রাজনীতি করে গেছে এই স্বর্গসম ল্যান্ডস্কেপ নিয়ে। যুক্তরাজ্যের অংশ হয়েও রাজতন্ত্রের সুনজরে কখনোই পড়েনি আইরিশরা, কয়েক দশক আগেও ইংরেজ পানশালার বাইরে লেখা থাকত কুকুর এবং আইরিশরা স্বাগত নয়। এক রকম করুণ কাহিনী বলল বাস কন্ডাকটর, ‘রানী ভিকটোরিয়া কখনো পছন্দ করেনি আমাদের, কিন্তু আমরা রানীকে যোগ্যসম্মান দিয়ে বেলফাস্টের মূল সড়কের নামকরণ করেছি গ্রেইট ভিকটোরিয়া স্ট্রিট!’ ৩. বহু বছর ইংল্যান্ডে থাকার সুবাদে ইংরেজ ভব্যতা, বিখ্যাত ব্রিটিশ হিউমার আর এক রকমের নাক কুঁচকানো বৈষম্য মাঝে মধ্যেই দেখতে পাই। তিন দিনের সফরে আইরিশ উচ্চারণে কথা বুঝতে আমাদের বেশ কষ্ট হয়েছে, তেমনি কষ্ট হয়েছে ওদেরও আমাদের বার বার বলে বোঝাতে। কিন্তু দুইপাশেই ছিল অমলিন হাসি; বিন্দুমাত্র অস্বস্তিতে পড়িনি বাদামি রঙের আমি কিংবা ফ্যাকাশে সাদা আইরিশ কেউ। এখানেই আয়ারল্যান্ডের সৌন্দর্য, তার মানুষ, তার আতিথেয়তা। নিজে এতটুকু না বদলেও সে রূপের রানী তার দরজা খুলে দিয়েছে হাজার মাইল দূরের দেশ থেকে আসা এক নগণ্য পর্যটকের জন্য। [email protected]
×