ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

ব্যবসায়ে নারী ॥ দরকার দক্ষতা মেধা ও অভিজ্ঞতা

প্রকাশিত: ০৪:০১, ১১ মার্চ ২০১৬

ব্যবসায়ে নারী ॥ দরকার দক্ষতা মেধা ও অভিজ্ঞতা

গত সপ্তাহে ‘বিশ্ব নারী দিবস’ পালিত হলো বেশ আড়ম্বরপূর্ণ-ভাবেই। বহু আলোচনা-সমালোচনা খবরের কাগজে পড়লাম। টক শোও শুনলাম, দেখলাম। এই ফাঁকেই এক খবর তাও নারীদের নিয়েই। কিন্তু এটা ভিন্ন স্বাদের। একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে। বিষয় : ‘রিং দ্য বেল ফর জেন্ডার ইক্যুইটি।’ এই সভাটিও বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষেই আয়োজিত। এর খবর তৈরি করতে গিয়ে একটি দৈনিক খবরের শিরোনাম করেছে : ‘পরিবারের সদস্য হিসেবে নয়, যোগ্যতা দিয়ে ব্যবসায় উঠে আসার তাগিদ’। খবরে দেখা যাচ্ছে এই আলোচ্য সভায় বক্তারা বলেছেন, নারীদের যোগ্যতা দিয়ে ব্যবসায় উঠে আসতে হলে তাদের চ্যালেঞ্জ নেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে, দক্ষতা অর্জন করতে হবে। পাশাপাশি নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিএসআর সেন্টারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি তার প্রবন্ধে বলেন, আমাদের দেশের কোম্পানিগুলোতে যেসব নারী বোর্ড সদস্য হিসেবে রয়েছেন তাদের অধিকাংশই পারিবারিক ব্যবসা থেকে এসেছেন। কর্পোরেট সিস্টেমে উঠে আসা নারীদের সংখ্যা অনেক কম। তাই এখানে নারীর অংশগ্রহণ জরুরী। প্রতিটি কোম্পানিতে ন্যূনতম একজন নারী বোর্ড পরিচালক থাকা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। প্রবন্ধ উপস্থাপক আরও বলেছেন, কোম্পানিতে নারী পরিচালক থাকার ক্ষেত্রে এশিয়ায় বাংলাদেশ শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে। যে কথাটি সেমিনারে নারীরাই বলেছেন সেই কথাটি অন্যত্র অন্য কারও পক্ষে বলা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। বিষয়টি হচ্ছে যোগ্যতা ও দক্ষতা। আজকাল বাণিজ্যিক, ব্যবসায়িক ও শিল্পক্ষেত্রে একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে এবং তা ঘটছে অনেকের অজান্তেই। খবরের কাগজে দেখি দেশে লক্ষাধিক কোম্পানি রয়েছে। কোম্পানি হচ্ছে প্রাইভেট কোম্পানি, পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি নয়। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির সংখ্যা খুব বেশি নয়। যেগুলো আছে তার বেশিরভাগই ঢাকা এবং চট্টগ্রাম স্টক একচেঞ্জে তালিকাভুক্ত। এর বাইরে রয়েছে হাজার হাজার প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। এর মধ্যে বিপুলসংখ্যক কোম্পানি চুটিয়ে ব্যবসা করছে। উল্লেখ্য, এসব কোম্পানির পরিচালকের তালিকার দিকে তাকালে দেখা যাবে এদের প্রায় সিংহভাগই নারী। প্রচুর ক্ষেত্রে নারীরাই এসব কোম্পানির চেয়ারম্যান। সোনালী ব্যাংকের ‘পার্টি’ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। কুখ্যাত ‘হলমার্কের’ চেয়ারম্যানও কিন্তু নারী, যিনি এখন জামিনে বেরিয়ে এসে তাদের কারখানা চালু রাখার চেষ্টা করছেন। যে কোন ব্যাংকের ঋণ বিভাগে খোঁজ নিলেই দেখা যাবে এসব প্রাইভেট কোম্পানিতে সাধারণভাবে দুই থেকে পাঁচ-সাতজন পরিচালক থাকেন। এদের মধ্যে মূল মালিকের স্ত্রী, পুত্র-কন্যারা তো আছেনই, আছেন অন্য আত্মীয়স্বজন ও বিশ্বস্তরা। এদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক কোম্পানি আবার ‘গ্রুপ অব কোম্পানির’ অধিভুক্ত। এটা আবার আরেক দিক। আমাদের বেসরকারী খাতের ব্যবসায়ীরা আয়কর এবং অন্যান্য দৃষ্টিকোণ থেকে ডজন ডজন কোম্পানি তৈরি করেন। একেক ব্যবসার জন্য একেক কোম্পানি করে এগুলোকে একসঙ্গে নাম দেন ‘গ্রুপ অব কোম্পানিজ’, যদিও গ্রুপ অব কোম্পানিজের কোন আইনী বৈধতা নেই। ঋণ দেয়া হয় নির্দিষ্ট কোম্পানিকে। মামলা-মোকদ্দমা হলে হবে কোম্পানি ও কোম্পানির পরিচালকের নামে। শুধু কোম্পানি নয়, আমাদের ‘রেজিস্ট্রার জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ এ্যান্ড ফার্মের’ নিবন্ধিত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ‘পার্টনারশিপ’ও আছে। অর্থাৎ অংশীদারি ব্যবসা। এখানেও অংশীদার হচ্ছে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা। এসব কোম্পানি ও পার্টনারশিপের ব্যবসা কিন্তু প্রচুর। কিন্তু তাদের পরিশোধিত মূলধন খুবই কম। হয়ত দেখা গেল কোন একটা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন দশ লাখ টাকা; কিন্তু সেই ফার্ম ঋণপত্র খুলেছে বিশ-ত্রিশ-চল্লিশ কোটি টাকার। তার দীর্ঘমেয়াদি ঋণ আছে সমপরিমাণের। তার ‘এলটিআর’ সুবিধাও প্রায় একই পরিমাণের। আবার এও আছে আজকাল ব্যবসা করতে গেলে ইক্যুইটি (নিজের মূলধন) দেখাতে হয়। সেটাও দেখানো হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে নারীদের নামেও মূলধন দেখানো হচ্ছে, তাদের নামেও সহায়-সম্পত্তি দেখানো হচ্ছে। ফাঁকে যে কাজটি হচ্ছে ‘বাই ডিফল্ট’ স্বামী ব্যবসায়ী তার সম্পত্তির একাংশ স্ত্রীকে-মেয়েকে দিয়ে দিচ্ছেন, দেয়ার ব্যবস্থা করছেন। এতে নারীর সম্পত্তি বাড়ছে। তাদের ক্ষমতায়ন হচ্ছে কোন সন্দেহ নেই। যেভাবেই হোক এই হিসাবে দেশে বর্তমান মুহূর্তে বড় বড় ব্যবসায়ী নারীর সংখ্যা লাখ লাখই হবে। তারা প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর বোর্ডে বসছেন, সভা করছেন। তাদের ছবি নিয়মিত কাগজে ছাপা হচ্ছে। এখানে দুর্বল দিক একটা অবশ্যই আছে। আর সেটাই আলোচিত হয়েছে ‘রিং দ্য বেল ফর জেন্ডার ইক্যুইটিতে’। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নারীরা অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক সূত্রে বোর্ডে আসছেন। অথচ বিষয়টি হওয়া উচিত যোগ্যতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও মেধা। এটা না হওয়ার ফলে আমাদের দেশের কোম্পানিগুলোর ‘কর্পোরেট’ কালচার উন্নত হচ্ছে না। কোম্পানির বোর্ড তো বোর্ড নয়। বোর্ডের আলোচ্য বিষয়বস্তু থাকে, যাকে বলা হয় এজেন্ডা। এই এজেন্ডায় থাকে বিপণন, হিসাবরক্ষণ, উৎপাদন থেকে শুরু করে অনেক কারিগরি বিষয়ও। বোর্ডের আলোচ্য বিষয় এবং আলোচিত বিষয় রেকর্ড করতে হয়। বোর্ডের সভা করা, কোম্পানি পরিচালনার আইনগত দিক ইত্যাদি বুঝতে হয়। অতএব এসব ক্ষেত্রে জ্ঞানের দরকার হয়। আয়-ব্যয়, মুনাফা, কর ইত্যাদি সম্পর্কে নানা বিশ্লেষণ থাকে। সেগুলো বুঝতে হয়। পারিবারিক সূত্রে বোর্ডে ঢুকলে এসব ধারণা থাকে না। তবে মানুষ সব ধারণা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। যে ব্যবসায়ী তার স্ত্রী-কন্যাকে বোর্ডে ঢোকাচ্ছেন সব ক্ষেত্রে তার কোম্পানি ম্যানেজমেন্টের ধারণা আছে? আমি নিশ্চিত নই। একজন ব্যবসায়ী নানাভাবে টাকা বানিয়ে ফেলেন। তিনি টাকার জোরেই ‘টেকনিক্যাল নলেজ’ ভাড়া করে নেন। যেখানে যাকে দেয়ার এবং বসানোর তা তিনি করেন। অতএব এই ক্ষেত্রে শুধু নারীদের দোষারোপ করা যায় না। প্রকৃত বিষয় হচ্ছে ইচ্ছা থাকলে বোর্ডের বিষয়, ব্যবসার বিষয় সম্পর্কে ধারণা লাভ করা কঠিন কিছু নয়। আমার মতে, ব্যবসার ক্ষেত্রে নারীকে সংশ্লিষ্ট করতে ব্যাংকাররা একটা ভূমিকা পালন করতে পারে। উদাহরণ দিই। আজকে দেশে হাজার হাজার ব্যবসায়ী, লাখ লাখ কোম্পানি ও পার্টনারশিপ ব্যবসা। ব্যাংক, বীমা থেকে শুরু করে কী ধরনের কোম্পানি এখন দেশে নেই? সবই আছে। বলুন, স্বাধীনতার পর পর কী অবস্থা ছিল? ইমপোর্ট, এক্সপোর্ট ব্যবসা কতজন বুঝত। শিল্প কিভাবে করতে হয়, লাইসেন্স কিভাবে যোগাড় করতে হয়, কারখানার জন্য জমি কিভাবে রেজিস্ট্রি করতে হয়- এসব কতজন জানত? কতজনের মর্টগেজ দেয়ার মতো জমি ছিল- অথচ ‘কোলেটারেল’ ছাড়া ঋণ পাওয়ার কোন ব্যবস্থা ব্যাংকে নেই। কোন্্ দেশে কোন্্ পণ্যের বাজার তা কয়জন জানত? এসব পুরুষ উদ্যোক্তারা কোত্থেকে শিখল? আমার ধারণা এ ক্ষেত্রে ব্যাংকারদের একটা অবদান আছে। অনেক ব্যাংকার নানা ধরনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক ব্যবসায়ীকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। তারা অনেককে শিল্প করার পুঁজি দিয়েছেন। অনেক ব্যাংকার নিয়মনীতির বেড়াজাল শিথিল করেও সাহায্য করেছেন। বলাবাহুল্য, ভাল ব্যবসায়ীও ব্যাংকারদের সৃষ্টি, খারাপ ব্যবসায়ীরাও তাদের সৃষ্টি। এমতাবস্থায় আমি সরকারকে বলব নারীকে শিল্পে ও ব্যবসায় স্থান করে দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকারদের সাহায্য নিতে। প্রতিটি ব্যাংক শাখা যদি পাঁচজন করে নারী উদ্যোক্তা চিহ্নিত করে তাহলে সর্বমোট নারী উদ্যোক্তা হবে কমপক্ষে চল্লিশ হাজার। প্রথমে এরা একা ব্যবসা শুরু করবে। আস্তে আস্তে বড় হবে। গ্রামে গ্রামে এখন বিএ, এমএ পাস করা নারী উদ্যোক্তা পাওয়া যাবে। ৪০ হাজারের মধ্যে যদি ধরি ৩০ হাজারও ঝরে পড়ে যায় তাহলেও দশ হাজার নারী উদ্যোক্তা পাওয়া যাবে চূড়ান্তভাবে। এরাই পরে প্রাইভেট কোম্পানি করবে, বড় কোম্পনি করবে। এই ক্ষেত্রে স্বামীর সাহায্য লাগতে পারে; কিন্তু স্বামীর প্রভাবাধীন থাকার প্রয়োজন নেই। স্ত্রী কিছুই জানলেন না, সই দিলেন, কোম্পানির চেয়ারম্যান হলেন, পরে জেল খাটলেন- এটা কোন কাজের কথা নয়। নিজের গুণেই উপরে ওঠা যায়। এখানে ব্যাংকারদের সহযোগিতা দরকার। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ইদানীং ব্যাংকারদের নজর বড় পার্টির দিকে। বাজার অর্থনীতির সুবাদে দেশে এখন বড় বড় পার্টি-ব্যবসায়ী হচ্ছে, ছোট ও মাঝারিরা মারা যাচ্ছে। এমতাবস্থায় নতুনদের মদদ দিয়ে গড়ে তোলার সুযোগ কোথায়? অথচ সুযোগ করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন করতে হবে, তা করতেই হবে। লেখক : ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×