ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এবিএম খায়রুল হক

অবসরের পর বিস্তারিত রায় লেখা-একটি প্রতিষ্ঠিত আইনী রীতি

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ১১ মার্চ ২০১৬

অবসরের পর বিস্তারিত রায় লেখা-একটি প্রতিষ্ঠিত আইনী রীতি

(সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের বক্ষ্যমাণ নিবন্ধটি ১০ মার্চ জনকণ্ঠের সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত হয়। শেষাংশ আজ চতুরঙ্গে প্রকাশিত হলো) এভাবে উক্ত মামলার শুনানি ১৯৫২ সালের ডিসেম্বরে আরম্ভ ও প্রথমবার শেষ হয়ে তা চূড়ান্তভাবে শেষ ও রায় হতে ৩০ (ত্রিশ) মাস প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই বিলম্বের জন্য বাদী-বিবাদী বা আমেরিকার বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ বা অন্য কারও কোন বিরক্তিভাব প্রকাশ করতে শোনা যায়নি। তারা একে স্বাভাবিকই ধরে নিয়েছিলেন যদিও দুই ভাগে প্রদত্ত উক্ত রায় ও আদেশের উপরেই লক্ষ লক্ষ আফ্রিকান-আমেরিকান শিক্ষার্থীদের ভাগ্য নির্ভর করছিল। উল্লেখ্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতিগণ আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করতে পারেন। ২০১১ সালের মার্চ মাসে আমাদের আপীল বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে কয়েকজন বিচারপতি কানাডার সুপ্রীমকোর্টের কার্যক্রম দেখতে গিয়েছিলেন। রায় প্রদান করতে কতদিন সময় লাগে এই প্রশ্নের উত্তরে কানাডার প্রধান বিচারপতি তাঁদের বলেছিলেন যে, শুনানি অন্তে সাধারণভাবে অন্তত ৬ (ছয়) মাস প্রয়োজন হয়। উপরের তথ্যগুলো বর্ণনা করবার অর্থ এই নয় যে, আমাদের আদালতসমূহেও বিলম্বে রায় প্রদানের অজুহাত সৃষ্টি করা, বরঞ্চ বাস্তবতাকে তুলে ধরে রায় প্রদান সংক্রান্ত ভুল বোঝাবুঝি দূর করবার চেষ্টা করা। এই সঙ্গে এটাও বাস্তবতা যে, অনেক বিচারপতি ঘোষণাকৃত রায় চূড়ান্ত করতে বছরের বছর পার করে দেন। এটা অত্যন্ত অন্যায়। সকল বিচারপতির এ ব্যাপারে অবশ্যই তৎপর হওয়া উচিত। অলসতার কারণে রায় চূড়ান্ত করতে বিলম্ব করা অবশ্যই পরিহার করতে হবে। তবে এই অলসতার সঙ্গে অবসর গ্রহণের কোন সম্পর্ক নেই। যারা অলস তারা অবসরের আগে পরে সব সময়ই অলস। যাই হোক, সকল বিচারপতির কার্যক্রমের প্রতি ঃধপঃভঁষষু সড়হরঃড়ৎ করা প্রধান বিচারপতির অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে যে, আপীল বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে ঈড়ফব ড়ভ ঈরারষ চৎড়পবফঁৎব-এর রায় প্রদান সংক্রান্ত বিধান প্রযোজ্য হবে কিনা? সে প্রশ্ন ওঠে না। কারণ, আপীল বিভাগ সংবিধানের সৃষ্ট একটি বিভাগ। আপীল বিভাগ কিভাবে পরিচালিত হবে এ সম্বন্ধে সংবিধান বা অন্য কোন আইনে কিছু বলা নেই। এ বিভাগের সকল পদ্ধতিগত কার্যক্রম চলবে আপীল বিভাগ রুলস অনুসারে। বাংলাদেশ সংবিধানের ১০৭ অনুচ্ছেদের ১ দফা অনুসারে এই রুলস প্রণয়ন করা হয়েছে বিধায় ইহা দেশের আইন এবং পূর্ববর্তী সকল আইন, এমনকি সুপ্রীমকোর্টের রায়ে বর্ণিত নির্দেশের উপরে স্থান পাবে, যতক্ষণ পর্যন্ত অন্য কোন যথাবিহীত রুলস বা আইন ইহাকে ংঁঢ়বৎংবফব করে। আপীল বিভাগ ইহার কোন রায়ের মাধ্যমে কোন রুল বিবেচনায় নিয়েও তা বাতিল বা সংশোধন করতে পারে। ততক্ষণ পর্যন্ত রুলসটি বহাল ও বাধ্যকর থাকবে। একটি বিষয় কেউই খেয়াল করেন না যে, অবসর গ্রহণের পর রায় লেখার জন্য কোন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক কোন ভাতা পান না বা অন্য কোন অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা পান না। তারা নিজেদের সুখ-শান্তি, অবসরকালীন আরাম-আয়েশ হারাম করে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা সত্ত্বেও অবসর গ্রহণের শেষ সময় পর্যন্ত মামলার রায় ঘোষণাকরত অবসরের পরে বিস্তারিত রায় লেখেন, শুধুমাত্র ন্যায়বিচার করার তাগিদ হতেই, অন্য কোন কিছু প্রাপ্তির আশায় একেবারেই নয়। এতকাল পরে প্রশ্ন উঠেছে আপীল বিভাগের রায় ঘোষণার পর যদি কোন বিচারক অবসরে চলে যান, তিনি রায় ঘোষণার (ঢ়ৎড়হড়ঁহপবসবহঃ) ধারাবাহিকতায় বিস্তারিত রায় লিখতে পারেন কিনা অথবা কর্মরত অন্য কোন বিচারকের লিখিত বিস্তারিত রায়ে ‘ও ধমৎবব’ বা ‘ আমি একমত’ লিখতে পারেন কিনা। উপরে বর্ণিত আপীল বিভাগের রুলস এর ১০ আদেশের ১ রুল আপীল বিভাগের যে কোন রায় উন্মুক্ত আদালতে ঘোষণার (ংযধষষ ঢ়ৎড়হড়ঁহপব) যেমন সধহফধঃড়ৎু বিধান রেখেছে তেমনি উক্ত রুল বা অন্য কোন রুল বিস্তারিত রায় লেখার বিষয়ে কোন প্রকার বাধ্যবাধকতা আরোপ করেনি, বরঞ্চ সংশ্লিষ্ট বিচারকগণের বিবেচনার উপরেই ছেড়ে দিয়েছে, যাতে সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার করা সম্ভব হয়। ংঢ়রৎরঃ টিই আসল, খোলসহীন ভড়ৎস নয়। কারণ, রুলসটি স্বর্গ থেকে প্রণয়ন করে পাঠানো হয়নি, আপীল বিভাগের রুলস আপীল বিভাগের বিজ্ঞ ও বহু বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিচারকগণই প্রণয়ন করেছিলেন। তাঁরা প্রাথমিক রায় ঘোষণা (ঢ়ৎড়হড়ঁহপব) ও বিস্তারিত রায় লেখা সংক্রান্ত সমস্যা সম্বন্ধে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল ছিলেন এবং ওয়াকিবহাল ছিলেন বলেই ইচ্ছাকৃতভাবে এবং সম্পূর্ণ সচেতনভাবেই এ সম্পর্কে কোন প্রকার বাধ্যবাধকতা আরোপ করেননি। আপীল বিভাগের ১৯৮৮ সালের রুলসটি প্রণীত হয়েছিল আপীল বিভাগের নিম্নলিখিত বিজ্ঞ বিচারপতিগণ কর্তৃক : ক) বিচারপতি জনাব এফ কে এম এ মুনিম (বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি) খ) বিচারপতি জনাব বদরুল হায়দার চৌধুরী (পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি) গ) বিচারপতি জনাব সাহাবুদ্দিন আহমেদ (পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি) ঘ) বিচারপতি জনাব এম এইচ রহমান (পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি) ঙ) বিচারপতি জনাব এ টি এম আফজাল (পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি) একইভাবে ২০০৮ সালে প্রণীত রুলসটি প্রণীত হয়েছিল নিম্নলিখিত বিচারপতিগণ কর্তৃক : ক) বিচারপতি জনাব মোঃ রুহুল আমিন (বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি) খ) বিচারপতি জনাব মোহাম্মদ ফজলুল করিম (পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি) গ) বিচারপতি জনাব এম এম রুহুল আমিন (পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি) গ) বিচারপতি জনাব মোঃ তাফাজ্জল ইসলাম (পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি) ঘ) বিচারপতি জনাব আমিরুল কবির চৌধুরী (আপীল বিভাগের তৎকালীন বিচারপতি) ঙ) বিচারপতি জনাব মোঃ জয়নুল আবেদিন (আপীল বিভাগের তৎকালীন বিচারপতি) চ) বিচারপতি মোঃ হাসান আমীন (আপীল বিভাগের তৎকালীন বিচারপতি) কোন মামলার রায় না হলেও যেহেতু আপীল বিভাগের বিজ্ঞ বিচারপতিগণ সর্বসম্মতিক্রমে ও পড়হংরংঃবহঃষু উপর্যুক্ত রুলস এর মাধ্যমে তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেছেন, সেহেতু তাহাই আপীল বিভাগের সিদ্ধান্ত এবং সংশ্লিষ্ট সকলের উপর তা বাধ্যকর। উল্লেখ্য যে, সকল বিচারকই উন্মুক্ত আদালতে আপীল বিভাগের রুলসের বিধান অনুসারে রায় ঘোষণা (ঢ়ৎড়হড়ঁহপব) করেন। কিন্তু পরবর্তীতে অবসরপ্রাপ্ত বিচারকগণ যদি কারণ সংবলিত বিস্তারিত রায় লেখেন তা ভ্রমাত্মক হবে না, কারণ ইহা বারিত করে আপীল বিভাগ রুলসে কোন বিধান নেই এবং সংবিধানেও এ ধরনের বারিতকরণ সংক্রান্ত কোন বিধান নেই। ধারণা করি, এ কারণেই বাংলাদেশের সুপ্রীমকোর্টের জন্ম হতে বাংলাদেশের ২০ জন প্রধান বিচারপতিসহ উভয় বিভাগের শতাধিক বিজ্ঞ বিচারপতিগণ উন্মুক্ত আদালতে প্রদত্ত রায় ঘোষণা (ঢ়ৎড়হড়ঁহপবসবহঃ) এর ধারাবাহিকতায় অবসর গ্রহণের পরে বিস্তারিত রায় প্রদানে কোন সাংবিধানিক বা আইনগত বাধা তাঁদের ‘ক্ষুদ্র’ ও ‘সীমিত’ জ্ঞানে উপলব্ধি করেননি। বিষয়টি আশ্চর্যজনক বটে। তবে বহু রায় ১৯৭২ সাল হতে আজ পর্যন্ত অনেকেই তাঁদের অবসর গ্রহণের পরেই ‘রহহড়পবহঃষু’ লিখেছেন এবং সে রায়গুলো আমাদের বিভিন্ন খধি জবঢ়ড়ৎঃ-এ মণি-মুক্তার মতো লঁৎরংঢ়ৎঁফবহঃরধষ আলোক এখনও বিতরণ করছে। সাধারণ মানুষ বা অসাধারণ মানুষ, বিজ্ঞ মানুষ বা তত বিজ্ঞ নন এমন মানুষ, কেউই এ সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপনের প্রয়োজনীয়তা এ যাবতকাল উপলব্ধি করেননি। প্রশ্নটি এখন উত্থাপিত হয়েছে। কারণ অনেকে তাদের বিজ্ঞান মনস্কতায় মনে করছেন যে, সংবিধানের ১৫৩টি অনুচ্ছেদের কোথাও না থাকলেও, বিস্তারিত রায়টি অবসর গ্রহণের পর লেখা হয়েছে বিধায় বিচারক হিসেবে তাঁদের শপথ হতে তাঁরা অব্যাহতি পেয়েছেন বা বিযুক্ত হয়েছেন; সুতরাং তাঁদের উক্তরূপ অবসর গ্রহণ পরবর্তী বিস্তারিত রায় লেখা বেআইনী। তাদের সকলের মতামতের প্রতি বিনীতভাবে সম্মান প্রদর্শন করে বলছি- যেহেতু সংবিধানের কোন অনুচ্ছেদেই এ সম্পর্কে কোন বারিতকরণ বিধান নেই, সেহেতু অবসর গ্রহণের পরে প্রদত্ত রায় সম্পূর্ণ বৈধ। এবার শপথের বিষয়টি আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পারি- অবসর গ্রহণ কোনভাবে পরবর্তীতে বিস্তারিত রায় লেখাকে বারিত করে কিনা। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রীমকোর্টের সকল বিচারপতিগণ নিম্নলিখিত শপথ গ্রহণ করেন : “ আমি..., প্রধান বিচারপতি (বা ক্ষেত্রমত সুপ্রীমকোর্টের আপীল/হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক) নিযুক্ত হইয়া সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা) করিতেছি যে, আমি আইন-অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত আমার পদের কর্তব্য পালন করিব; আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব; আমি বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান করিব; এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব।” বিচারকদের রায় প্রদানের ক্ষেত্রে উপরে বর্ণিত বাক্যগুলো, বিশেষ করে, উপর্যুক্ত শপথের নিম্নলিখিত বাক্যটি খুবই প্রাসঙ্গিক- “...আমি বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান করিব; এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহীত আচরণ করিব।” এই সম্পর্কে আমার বিনীত অভিমত এই যে, এই শপথ কোনভাবেই উন্মুক্ত আদালতে রায় ঘোষণা (ঢ়ৎড়হড়ঁহপবসবহঃ) এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময় এমনকি অবসর গ্রহণের পর লিখিত রায়ের ব্যাখ্যা বা বিস্তারিত বর্ণনা (ৎবধংড়হরহম) কে বারিত করে না। কারণ- প্রথমত, শপথে বর্ণিত ‘আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ’ অনুসরণ করে পরবর্তী সময় অবসরপ্রাপ্ত বিচারকসহ সকল বিচারক উন্মুক্ত আদালতে ‘ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে আইন অনুযায়ী যথাবিহীত আচরণ’ করত রায় ঘোষণা (ঢ়ৎড়হড়ঁহপবসবহঃ) করেন। বিস্তারিত রায়ে উন্মুক্ত আদালতে ঘোষিত রায়ের শুধুমাত্র ব্যাখ্যা (ৎবধংড়হরহম) ও আনুষঙ্গিক বিষয়াবলীর বিষদ বর্ণনা করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে শপথে বর্ণিত বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস বা আনুগত্য লঙ্ঘিত হয় না, সংবিধান ও আইন লঙ্ঘন করাও হয় না বা নতুন করে ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগবহির্ভূত অথবা বেআইনী কোন আচরণ করার কোন সুযোগ একেবারেই নেই। উন্মুক্ত আদালতে ঘোষিত রায়ে যা বলা হয়েছে বিস্তারিত রায়ে তারই কারণ ব্যাখ্যা, আনুষঙ্গিক বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করা হয় মাত্র। এখানে আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, অবসরপ্রাপ্ত বিচারক যে বিস্তারিত রায় লেখেন তা কর্মরত অন্যান্য বিচারকগণ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে নিরীক্ষণ করেন। অঁঃযড়ৎ বিচারকের কোন ভুল ভ্রান্তি বা ষধঢ়ংবং সম্বন্ধে অন্যান্য বিচারকগণ সজাগ থাকেন। কাজেই অবসরপ্রাপ্ত ধঁঃযড়ৎ বিচারকের ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগবহির্ভূত বা বেআইনী কোন আচরণ করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। ধারণা করি, শপথের এই ব্যাখ্যাই এ যাবতকাল গ্রহণকরত ১৯৭২ সাল হতে সুপ্রীমকোর্টের উভয় বিভাগের শত শত বিচারকগণ তাদের ‘সীমিত’ ধারণার মধ্য থেকে রায় প্রদান করে গেছেন। আমি আইনের একজন সাধারণ ছাত্র হিসেবে তাদের সেই ধারণাকে ভ্রমাত্মক বা বেআইনী বলে গ্রহণ করতে পারছি না। উল্লেখ্য যে, সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদের ৩ দফার বিধান অনুসারে নিশ্চিতভাবে শুধুমাত্র শপথ গ্রহণের পরেই একজন ব্যক্তি বিচারপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কিন্তু ৯৬ অনুচ্ছেদের ১ দফা অনুসারে একজন বিচারপতি অবসর গ্রহণ করলে তার শপথ থাকবে কিনা এ সম্বন্ধে সংবিধান নিশ্চুপ। আমরা এ সম্বন্ধে শুধু আন্দাজ বা অনুমান করতে পারি মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। অবসর গ্রহণ করলেও ৯৯ অনুচ্ছেদ একজন বিচারপতির ওপর কিছুটা সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা ও নৈতিক দায়বদ্ধতা আরোপ করে। তাঁরা সাধারণ যে কোন নাগরিকের ন্যায় সব কাজ করতে পারেন না। সংবিধান অনেক সময় বারিত না করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা তাঁদের নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে অনেক লোভনীয় কাজ থেকে স্বেচ্ছায় নিজেদেরকে বিযুক্ত রাখেন। আমি স্বীকার করেই নিচ্ছি আমার আইনের জ্ঞান অতিশয় ক্ষুদ্র ও সীমিত এবং বিজ্ঞজনেরা অনেক বিজ্ঞভাবে ও নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করতেই পারেন। তাতে আমার কোন রকম বিরোধিতা নেই। বরঞ্চ অত্যন্ত বিনীতভাবে বলতে চাই যে মাননীয় প্রধান বিচারপতি, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতিগণ, বিচারপতিবৃন্দ বা বিজ্ঞজনেরা নিশ্চয়ই অন্যরকম অনেক ‘বিজ্ঞ’ ও ‘সমৃদ্ধ’ নতুন কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেই পারেন। বিনীতভাবে বলতে চাই, বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি মনে করতেই পারেন যে, অবসরের পর কোন বিচারক রায় লিখতে পারবেন না। একথা চিন্তা করবার ও তা কার্যকরী করার অধিকার তাঁর রয়েছে। কিন্তু তা হতে হবে আইন ও বিধিসম্মতভাবে। সেক্ষেত্রে আপীল বিভাগের বিধিতে এই বিধান সংযুক্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। হাই কোর্ট বিভাগের ক্ষেত্রে ঐরময ঈড়ঁৎঃ জঁষবং-এ সংযুক্ত করতে হবে। তবে আপদকালীন হিসেবে মাননীয় প্রধান বিচারপতি ইচ্ছা করলে ২০১২ সালে প্রণীত ঐরময ঈড়ঁৎঃ জঁষবং-এ বর্ণিত চৎধপঃরপব উরৎবপঃরড়হ এর মাধ্যমে হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এ সংক্রান্তে প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী প্রদান করতে পারেন। কারণ রায় লিখবেন শুধুমাত্র সুপ্রীমকোর্টের উভয় বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ, অন্য কেউই নয়। এ প্রসঙ্গে বিনীতভাবে আরও নিবেদন করতে চাই যে, অবসরের পরে রায় প্রদান বারিত করে কোন বিধান প্রণয়ন করলে হয়ত উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হবে। কারণ, সেক্ষেত্রে বিজ্ঞ বিচারকগণ তাদের অবসর গ্রহণের বেশ কিছুদিন পূর্ব হতেই মামলা নিষ্পত্তি করা বন্ধ করবেন অথবা কমপক্ষে ধীরগতিসম্পন্ন হয়ে পড়বেন। কেননা তখন তাঁরা ন্যায়সঙ্গতভাবে মনে করতেই পারেন যে, যেহেতু অবসরের পর কোন রায় লেখা যাবে না বা স্বাক্ষর করা যাবে না কাজেই সময় থাকতেই রায় প্রদানসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক সকল কাজ শেষ করা প্রয়োজন। ফলে প্রকৃতপক্ষে মামলা নিষ্পত্তির হার কমে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকবে। বিভিন্ন টক শো অনুষ্ঠানে বক্তাদের বক্তব্য শুনে ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন বক্তব্য পড়ে মনে হয় যে, যারা অবসরগ্রহণের পর রায় লেখেন তাঁরা হয়ত চাকরি থাকা অবস্থায় রায়ই লেখেন না বা খুব কম রায় লেখেন এবং সে কারণে অবসর গ্রহণের পরে তাঁরা ধীরে সুস্থে রায় লিখতে বসেন। এ ধারণা একেবারেই সঠিক নয়। খুব অল্প সংখ্যক ব্যতিক্রম ব্যতীত বেশিরভাগ বিচারকবৃন্দই যথেষ্ট পরিশ্রমী ও নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা বিচারক থাকাকালীন সময়ে যথেষ্ট পরিমাণ রায় প্রদান করেন এবং অবসর গ্রহণের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁরা তাঁদের বিচারিক কার্যক্রম ক্রমাগত পরিচালনার মাধ্যমে বিচারপ্রার্থী জনগণকে প্রতিকার প্রদান করার প্রাণপণ প্রয়াস পান। খোঁজ নিলে দেখা যাবে যে বেশিরভাগ বিচারকই এমনকি তাঁদের বার্ষিক পধংঁধষ ষবধাব গুলো পর্যন্ত নেন না, যেন কোন ভাবেই তাঁদের নিষ্পত্তির হার কম না হয়। খুব সামান্য সংখ্যক বিজ্ঞ বিচারকগণ হয়ত অবসর গ্রহণের কথা স্মরণ করেই তাঁদের মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা ধীরে ধীরে কমাতে শুরু করেন এবং তাঁরা অবসর গ্রহণের দিনে ঝাড়া হাত পা নিয়ে চলে যেতে পারেন। তাঁদেরই শুধু অবসর গ্রহণের পরে রায় লেখার কোন প্রয়োজন পড়ে না। এখানে আরো উল্লেখ্য যে, যারা চাকরিতে থাকাকালীন বেশিসংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি করেন তাঁদের ক্ষেত্রেই দেখা যায় যায় যে অধিক সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তির কারণে সকল মামলার বিস্তারিত রায় লেখা সম্ভব হয় না। সে কারণেই অবসর গ্রহণের পর তাঁরা রায় লিখতে বাধ্য হন। অবসর গ্রহণের পরে ঘোষিত রায়ের কারণ সংবলিত বিস্তারিত রায় লিখন একটি প্রতিষ্ঠিত আইনি রীতি, যা দেশের সর্বোচ্চ বিচারাঙ্গনের বিজ্ঞ বিচারকগণ কর্তৃক বছরের পর বছর ন্যায়বিচারের স্বার্থে অনুসৃত হয়ে আসছে। ইদানীংকালে প্রকাশিত কিছু বক্তব্যে সাধারণ মানুষ হয়ত এ বিষয়ে বিভ্রান্তির শিকার হতে পারেন-এই উদ্বিগ্নতা থেকেই আমার এই বিলম্বিত রচনা। দেশের আপামর সার্বভৌম জনসাধারণ যাতে তাঁদের নিজেদের সর্ব্বোচ্চ আদালত সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা পান, তাই আমার বর্তমান লেখার মূল কারণ, অন্য কিছু নয়। সব শেষে বলবো যে, সংবিধান ও আইনের জটিল প্রশ্ন শুধু সাধারণ জ্ঞান (পড়সসড়হ ংবহংব) দ্বারা সমাধান করা যায় না, উচিতও নয়। তাঁর জন্য প্রয়োজন নির্মোহ পেশাদারী মনোভব (ঢ়ৎড়ভবংংরড়হধষরংস), ংঢ়বপরধষরুবফ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা। অন্যথায়, সমগ্র বিষয়টি ‘বাল্য বিবাহে’ পরিণত হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া, সাংবিধান ও আইনের জটিল প্রশ্নের সঙ্গে কুটিল রাজনীতি গুলিয়ে ফেললে কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনে না, বরঞ্চ কাল পরিক্রমায় (রহ ঃযব ষড়হম ৎঁহ) ভবিষ্যতে দেশ, জাতি ও বিশেষ করে বিচার বিভাগের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে যার শিকার আজ না হোক কাল সকল পক্ষই হতে পারেন। এর একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব অবশ্যই থাকবে। বিষয়টি সত্যিই জটিল। অতএব, সাধু সাবধান! লেখক : সাবেক প্রধান বিচারপতি
×