ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

৮ রানের জয়ে বাছাই পর্ব শুরু মাশরাফিদের

টাইগারদের ঘাম ঝরাল ডাচ্

প্রকাশিত: ০৬:০১, ১০ মার্চ ২০১৬

টাইগারদের ঘাম ঝরাল ডাচ্

মিথুন আশরাফ, ধর্মশালা থেকে ॥ ধর্মশালার অপরূপ রূপে যেন পাগল হয়ে গেলেন বাংলাদেশ দলের ব্যাটসম্যানরা। সব বলই যেন পাঠাতে চাইলেন স্টেডিয়ামের বাইরে। এমনও মনে হয়েছে, যেন টার্গেট বল ছক্কা মেরে বরফে ঘেরা পাহাড়ে পাঠানো। এমন টার্গেট নিয়েই কী বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা নেমেছিলেন? তা না হলে কেন এতটা বিশ্রী অবস্থা হল্যান্ডের মতো বোলিং লাইনআপের সামনে হবে! স্কোর দেখাচ্ছে, বাংলাদেশ ১৫৩। কিন্তু এ স্কোরটির ধারে কাছেও হয়ত বাংলাদেশ দল যেতে পারত না, যদি তামিম ইকবাল ব্যাট হাতে হল্যান্ড বোলারদের না শাসন করতেন, না অপরাজিত ৮৩ রানের দুর্দান্ত ইনিংসটি খেলে দিতেন। তার এ ইনিংসে ভর করেই ৮ রানে জিতে হল্যান্ড আতঙ্ক দূর করে দিয়েছে বাংলাদেশ। টি২০ বিশ্বকাপের শুভসূচনাও করেছে। উইকেট দেখেই মনে হয়েছে রান হবে। ঘাস ছিল ঠিকই। তবে পেসারদের জন্য যতই মনে করা হোক উইকেট সহায়ক, বুধবার তা দেখা যায়নি। না হয়েছে বাউন্স। না বলে গতি দেখা গেছে। এরপরও বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরা ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে! টি২০ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের প্রথম ম্যাচেই এমন দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাটিং চিন্তাতেই ফেলে দিয়েছে। যদি বাংলাদেশ সুপার টেনে খেলে, তাহলে পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে খেলতে হবে। তখন কী হবে? তবুও ম্যাচটি জেতা গেছে। তামিম যে ৫৮ বলে ৬ চার ও ৩ ছক্কায় ৮৩ রানের ইনিংসটি খেলে দিয়েছেন। তার এ দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ শেষপর্যন্ত ৭ উইকেটে ২০ ওভারে ১৫৩ রানের স্কোর গড়েছেও। তখনই মনে হয়েছে ম্যাচটি বাংলাদেশ জিততে যাচ্ছে। তবে ভয়ও ছিল। হল্যান্ড যে সবসময়ই ‘আতঙ্ক’ যুক্ত দল। যতই রান তাদের সামনে দাঁড় হোক, যেদিন দলটির ক্রিকেটাররা বিধ্বংসী হয়ে ওঠেন, সেদিন কোন দলই টিকতে পারে না। বিশেষ করে টি২০ বিশ্বকাপে। ইংল্যান্ডকে দুইবার হারিয়ে দিয়েছে হল্যান্ড। বাংলাদেশের সঙ্গে এর আগে ২০১২ সালে দুই ম্যাচের টি২০ সিরিজে এক ম্যাচে জিতেছেও। যখন বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো হল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ, একটা আতঙ্কও কাজ করে। সেই আতঙ্ক অবশ্য দূর করে দেন স্পিনার ও পেসাররা মিলেই। উইকেট যে সেøা, স্পিনারদের জন্য সহায়ক তা বাংলাদেশের ইনিংসেই বোঝা যায়। তার সুফল নিতে একটুও ভুল করেননি মাশরাফি। স্পিনারদের দ্রুতই বোলিংয়ে এনেছেন। তাতে করে ২০ ওভারে ৭ উইকেটে ১৪৫ রান করতে পারে হল্যান্ড। হারেও। দলের পক্ষে মাইবার্গ ও বোরেন ২৯ রান করে করেন। হল্যান্ড এমনভাবে খেলছিল, যেন ১৫৪ রানের টার্গেট কোন বিষয়ই না। ওপেনিং জুটি যদিও ২১ রানে ভাঙ্গা গেছে, বারেসিকে (৯) আউট করা গেছে; কিন্তু এরপর মাইবার্গ ও কুপার মিলে বাংলাদেশ বোলারদের ভোগাতে থাকেন। এশিয়া কাপের মতো এখানেও আল আমিন প্রথম উইকেটটি শিকার করেন। যখন স্কোরবোর্ডে ৫৩ রান যুক্ত হয়, এমন সময়ে মাইবার্গকে (২৯) আউট করে ‘ব্রেকথ্রু’ এনে দেন নাসির। যখন ৭৭ রান হয় তখন বেন কুপারকে (২০) বোল্ড করে দেন সাকিব। ভালভাবেই আশা জাগে, বাংলাদেশের জয় মিলবে। ১০ ওভারে গিয়ে ৭১ রান যোগ করে হল্যান্ড। এরপর হল্যান্ডকে চাপে ফেলে দেয়। ১৫ ওভারে গিয়ে ১০০ রান যোগ হয়। তখন হল্যান্ডের জিততে ৩০ বলে ৫৪ রান লাগে। পিটার বোরেনকে নিয়ে খানিকটা ভয় তখনও থাকে। এ ব্যাটসম্যান যে অঘটন ঘটাতে পটু। ১৬ ওভারে বল করতে আসেন সাকিব। চতুর্থ বলে বোরেন সুইপ করে মিডউইকেট দিয়ে বাউন্ডারি হাঁকাতে চান। বল উপরে উঠে যায়। নাসির হোসেনের হাতেও যায়। কিন্তু সেই ক্যাচটি ধরতে পারেননি নাসির। মনে হয়েছিল, এটিই ম্যাচের টার্র্নিং পয়েন্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এক বল পরেই আবার সেই বোরেনই সুইপ করেন। এবার আর নাসিরের হাত থেকে বল ফসকে যেতে দেননি। ২৯ রানে বিপজ্জনক ব্যাটসম্যান বোরেন যখন আউট হয়ে যান, তখনই বলতে গেলে বাংলাদেশের জয়ও নিশ্চিত হয়ে যায়। পরের ওভারে ভ্যান ডার মারউইকে (১) মাশরাফি আউট করে দেন। ৫ উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকে হল্যান্ড। আতঙ্ক দূর হয়ে যায়। ১৭তম ওভারে বল করতে এসে মাশরাফি যে ‘জান-প্রাণ’ লাগিয়ে বল করে মাত্র ৩ রান দিয়ে ১টি উইকেট নিয়ে নেন, সেখানে ম্যাচ বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এরপর যেন ২০ ওভার শেষ হওয়ার অপেক্ষা থাকে শুধু। ১৮ বলে জিততে ৩৯ রানের প্রয়োজন থাকে। এলোপাতাড়ি খেলতে থাকেন টম ও সিলার। বাউন্ডারি হাঁকাতে যে কত চেষ্টা করেন! কোন কিছুই কাজে দেয় না। ১৮তম ওভারে রান হয় ৬। ১৯তম ওভারে এসে প্রথম বলে টমকে (১৫) আউট করে দেন আল আমিন। তবে দ্বিতীয় বলে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে দেন। উইকেটরক্ষক মুশফিকের হাতের একেবারে কাছ দিয়ে বলটি গিয়ে চার হয়। পরের বলেই ছক্কা হাঁকিয়ে দেন। পঞ্চম বলে উইকেটরক্ষকের পেছন দিয়ে বাউন্ডারি মারেন সিলারও। এমন অবস্থা হয়ে যায়, শেষবেলায় এসে আবারও যেন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এ ওভারে ১৬ রান দিয়ে দেন আল আমিন। শেষ ওভারে জিততে ১৭ রানের প্রয়োজন থাকে। উত্তেজনা খানিক তৈরি হয়ে যায়। তাসকিন বল করতে আসেন। প্রথম বলেই ২ রান নিয়ে নেন বুখারি। পরের বলে দ্রুত রান নিতে যান। রান আউট হয়ে যান বুখারি (১৪)। শেষে ২ বলে ১১ রানের প্রয়োজন থাকে। ১ বলে যখন ১০ রানের প্রয়োজন পড়ে, তখনই জয় নিশ্চিত হয়ে যায়। শেষ বলে আরেকটি রান হয়। বুখারির শেষ বেলার বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ে ব্যবধানই শুধু কমে। উত্তেজনা বাড়ে। এছাড়া আর কিছুই হয় না। সাকিব ও আল আমিন ২টি করে উইকেট নেন। বাংলাদেশ টস হেরে ব্যাটিং যখন করতে নামে শুরুতেই সৌম্য সরকারকে (১৫) হারিয়ে বসে। একবার থার্ডম্যানে ক্যাচ আউট হওয়া থেকে বাঁচা সৌম্য আবারও শর্ট বলটি খেলতে যান। উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফেরেন। এরপর অবশ্য দ্বিতীয় উইকেটে তামিম-সাব্বির মিলে ৪২ রানের জুটি গড়েন। যা বাংলাদেশের ইনিংসের সর্বোচ্চ রানের জুটি হয়ে থাকে। যেই দলের স্কোরবোর্ডে ৬০ রান যোগ হয়, এলবিডব্লিউ হয়ে যান সাব্বির (১৫)। বাংলাদেশের দুই উইকেটের পতন ঘটে যায়। মনে করা হয়েছিল, সাকিব, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহ ও নাসিরত আছেনই। কোন বিষয়ই না। কিন্তু সবার ভেতরই আতঙ্ক ঢুকিয়ে দেন ভ্যান ডার গাগটেন। ১৮ রান স্কোরবোর্ডে যোগ হতেই বোরেনের করা শর্ট বলটিতে মারতে গিয়ে থার্ডম্যানে ধরা পড়েন সাকিব (৫)। এখন ভয় ভালভাবেই ঢোকে। যখন ১১১ রানে মাহমুদুল্লাহ (১০) ও ১১২ রানে একাধারে ব্যর্থ হতে থাকা মুশফিককে (০) আউট করে দেন গাগটেন, তখন মনে হয়েছিল ১৩০ রানও করতে পারবে না মাশরাফিরা। নাসির এসেও যখন দ্রুতই আউট হয়ে যান, ভয়ই ঢুকে যায়। কিন্তু মাশরাফি এসে ছক্কা হাঁকিয়ে একটু এগিয়ে দেন দলকে। তবে সবচেয়ে কার্যকর কাজটি করেন তামিম। নির্ভরযোগ্য সব ব্যাটসম্যানকে আউট হতে দেখেন। কিন্তু কোনভাবেই মনোবল হারাননি। অন্য কোন দিকে ধ্যান না দিয়ে নিজের ব্যাটিংটা করে যান। তাতে করে একটি করে উইকেট পড়তে থাকে ঠিক, কিন্তু তামিম ব্যাট হাতে উজ্জ্বলতাও ছড়াতে থাকেন। এমনই উজ্জ্বল ব্যাটিং করেন ৮৩ রানের ইনিংসই খেলে ফেলেন। যা দলকে বড় সংগ্রহের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সেই এগিয়ে নেয়া বাংলাদেশকে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে জয়ও এনে দেয়।
×