ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিভিল এ্যাভিয়েশনের গাফিলতিকে দায়ী করেছে যুক্তরাজ্য

এবার বিমানের লণ্ডন কার্গো ফ্লাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞা

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১০ মার্চ ২০১৬

এবার বিমানের লণ্ডন কার্গো ফ্লাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞা

আজাদ সুলায়মান ॥ শেষ পর্যন্ত বিমানের কার্গো বন্ধ করেই ছাড়ল যুক্তরাজ্য। এবার ঢাকা থেকে বিমানের সরাসরি লন্ডনের কার্গো ফ্লাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে দেশটি। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। এর আগে অস্ট্রেলিয়াও একই কায়দায় ঢাকা থেকে সরাসরি কার্গো ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়। অস্ট্রেলিয়ার মতো যুক্তরাজ্যও একই সুরেই অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও জনবলের অভাবের জন্য দায়ী করেছে সিভিল এ্যাভিয়েশনের গাফিলতি ও অবহেলাকে। লন্ডনের কার্গো ফ্লাইট বন্ধ করায় বিমানকে বড় ধরনের মাসুল গুনতে হবে। সপ্তাহে ঢাকা থেকে চারটি ফ্লাইটে যে পরিমাণ কার্গো বহন করা হতো- তাতে মাসিক কমপক্ষে ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হতো। এখন এ আয় থেকে বঞ্চিত হবে বিমান। একই সঙ্গে নতুন শঙ্কা দিয়েছে বিমানের যাত্রীবাহী লন্ডন ফ্লাইট নিয়েও। যে কারণে কার্গো বন্ধ করা হয়েছে, সেই একই কারণে বিমানের লন্ডন ফ্লাইটও বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিমান এ বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করেছে সিভিল এ্যাভিয়েশানের রহস্যজনক উদাসীনতা ও গাফিলতিকে। কার্গো হাউসের নিরাপত্তা, যন্ত্রপাতি সরঞ্জামাদিসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত স্থাপনার তত্ত্বাবধানের একক কর্তৃপক্ষ হচ্ছে সিভিল এ্যাভিয়েশন। সিভিল এ্যাভিয়েশন যদি ব্রিটিশ অডিট টিমের পর্যবেক্ষণগুলো মেনে সময় মতো সব পদক্ষেপ নিত তাহলে এ বিপর্যয় এড়ানো যেত। এ বিষয়ে বুধবার সাংবাদিকরা জানতে চাইলেও সিভিল এ্যাভিয়েশনের কোন কর্মকর্তা মুখ খোলেননি। বার বার ফোন করা হলেও চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল সানাউল হক কথা বলেননি। জানতে চাইলে জনসংযোগ কর্মকর্তা রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। এদিকে বুধবার বিমানের রফতানি কার্গোতে গিয়ে দেখা যায় সেখানকার কর্মরত জনবলের মাঝে চরম হতাশা নেমে এসেছে। সারি সারি কার্গোর স্তূপ জমে গেছে ওই হাউসে। কি কারণে যুক্তরাজ্য এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে জানতে চাইলে বিমানের কোন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা মুখ খুলতে রাজি হননি। তবে য্ক্তুরাজ্য গত তিন মাস ধরেই অজুহাত খুঁজছিল ঢাকা থেকে সরাসরি বিমানের কার্গো বন্ধ করার। শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবারই এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেয় যুক্তরাজ্য। বুধবার এ নিয়ে বিমান ও সিভিল এ্যাভিয়েশনে শুরু হয়েছে নেপথ্য কারণ বের করার অনুসন্ধান। প্রাথমিকভাবে যুক্তরাজ্য যেসব কারণ উল্লেখ করেছে তার মধ্যে রয়েছে কার্গো ভিলেজের অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা, দক্ষ লোকবলের অভাব ও বহিরাগতের অবাধ প্রবেশ। জানা যায়, শুধু বাংলাদেশ বিমানই নয় কার্গো বহনের নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে কাতার, কুয়েত, সৌদিয়া, এমিরেটস, সিঙ্গাপুর, ক্যাথে প্যাসিফিক ও মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সসহ বেশ কয়েকটি বিদেশী এয়ারলাইন্স। যুক্তরাজ্য ঢাকা থেকে সরাসরি কার্গো বন্ধ করায় এখন এ বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলোকে গুনতে হবে বড় ধরনের মাসুল। যেমন ঢাকা থেকে আবুধাবি হয়ে ইতিহাদের ফ্লাইট যুক্তরাজ্য যেতে পারত। এখন ঢাকা থেকে কার্গো নিতে হলে আবুধাবিতে সেই কার্গো আবার নতুন করে স্ক্যান করতে হবে। এই পদ্ধতিতে অন্যান্য এয়ারলাইন্সের মতো বিমানও পরোক্ষভাবে কার্গো নিয়ে যেতে পারবে যুক্তরাজ্যে। যা খুবই ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। কাজেই যুক্তরাজ্যের এই সিদ্ধান্তের দরুন শুধু বিমান নয় বিদেশী এয়ারলাইন্সেও বিপর্যয় নেমে আসবে। এতে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়বে তৈরি পোশাক, সবজিসহ রফতানিমুখী বেশকিছু পণ্য। সামগ্রিক দৃষ্টিতে এর প্রভাব পড়বে বিমান ছাড়াও গার্মেন্টস খাতে। এ ছাড়া বিমানের কার্গো কমপ্লেক্সের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়ায় গত তিন মাসেও অস্ট্রেলিয়া তাদের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি। গত ডিসেম্বর থেকে দেশটি বিমানে কার্গো নিচ্ছে না। এতে প্রতি দিন গড়ে অর্ধশত কোটি টাকার ব্যবসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যুক্তরাজ্য এ্যাভিয়েশন গোয়েন্দা দল তাদের সর্বশেষ রিপোর্টে বিমানের ঢাকা-লন্ডন সরাসরি যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থায় সন্তোষ প্রকাশ করলেও কার্গো পণ্য পরিবহনে সিভিল এ্যাভিয়েশনের গাফিলতি ও অবহেলা দেখে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে। যার মাসুল দিতে হচ্ছে বিমানকে। গত মাসে দাখিলকৃত ওই প্রতিবেদন সম্পর্কে জানা যায়, কার্গো রফতানি ভিলেজে ব্রিটিশ গোয়েন্দা দল যা প্রত্যক্ষ করেছে তাতে তারা এখানকার নিরাপত্তা নিয়ে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করে। যেমন ওই টিম বার বার তাগিদ দিয়েছিল, কার্গো স্ক্যানার ও এক্সপ্লোসিভ টেস্ট ডিটেকশন (ইটিডি) দক্ষতার সঙ্গে অপারেট করার জন্য। কিন্তু সিভিল এ্যাভিয়েশন ইটিডি বসালেও দক্ষ অপারেটর নিয়োগ করতে পারেনি। ব্রিটিশ টিমের ভ্যালিডেটর ওয়াইনি রেইন শো নিজে কার্গো হাউসে দাঁড়িয়ে পর পর তিন দিন যে চিত্র দেখলেন তাতে তিনি আঁতকে ওঠেন। তিনি দেখলেন- ইটিডির মাধ্যমে কার্গো বক্স ঠিকই পরীক্ষা করা হচ্ছে। মেশিনে একদিক দিয়ে ঢুকিয়ে অন্যদিক দিয়ে বের করা হচ্ছে। কিন্তু ওই কার্গোতে কোন ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য আছে কিনা সেই রিপোর্ট তাৎক্ষণিক বের করা যাচ্ছে না। তিনি তখন অপারেটরের কাছে জানতে চান ইটিডির রিপোর্ট কোথায়? জবাবে অপারেটর কিছুই বলতে পারেননি। অর্থাৎ ইটিডির জন্য দক্ষ কোন অপারেটর নেই সিভিল এ্যাভিয়েশনে। এ সম্পর্কে সিভিল এ্যাভিয়েশনকে বার বার তাগিদ দেয়া হলেও কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এতে বিস্মিত হন ব্রিটিশ গোয়েন্দা দলের সদস্যরা। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে বিমানের কার্গো রফতানি হাউসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করানো হচ্ছে বহিরাগত জনবল দিয়ে। এ ধরনের জনবল মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। রফতানি টার্মিনালে কর্মরত ৩০০ জনবলের মধ্যে মাত্র ৬০ জন বিমানের নিজস্ব। বাকিরা বিভিন্ন সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট ও বহিরাগত। এদের মধ্যে চোরাচালানসহ বিভিন্ন মামলার আসামিও আছে। নামমাত্র স্ক্যানের পর এরা টার্মিনালে প্রবেশ করছে। একইভাবে স্ক্যান ছাড়াই অবাধে পণ্যসামগ্রীও বিভিন্ন এয়ারলাইন্সে ওঠানো হচ্ছে। এ অবস্থায় কার্গো পণ্যের সঙ্গে বোমা বা অন্য কোন এক্সক্লুসিভ বিমানের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়ার মতো আশঙ্কার কথাও বলা হয়েছে যুক্তরাজ্যের রিপোর্টে। নিরাপত্তা শিথিলতায় কার্গো ফ্রেইটগুলো যেসব দেশের বিমানবন্দরে যাচ্ছে সেখানে বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কাও আছে। নিজস্ব জনবলের বিষয়টি নিয়ে বার বার বলা হলেও সেটা বাস্তবায়ন করতে পারেনি বিমান। অথচ নিরাপত্তা নির্বিঘœ করতে শাহজালাল বিমানবন্দরের জন্য ২৫০ সদস্যের জনবল নিয়োগ দিলেও সরকার কার্গো (রফতানি) শাখায় নিজস্ব জনবল নিয়োগ দেয়নি। খোদ বিমান বোর্ডের প্রভাবশালী আমলারা জনবল নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ফলে যুক্তরাজ্যের সুস্পষ্ট নির্দেশনার পরও বিমান কর্তৃপক্ষ কার্গো রফতানি শাখায় জনবল নিয়োগ দিতে পারেনি। পরিণতিতে যা হওয়ার তাই হয়েছে। এ সম্পর্কে বিমানের একজন পরিচালক জনকণ্ঠকে বলেন, শর্ত সাপেক্ষে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে সরাসরি কার্গো রফতানি করতে প্রয়োজনীয় সনদ ‘এয়ার কার্গো সিকিউরিটি-৩ (এসিসি)’ ও ‘রেগুলেশন এজেন্ট-৩ (আরএ)’ সনদ নবায়ন করা হয়েছে। গত জানুয়ারিতে ৩ মাসের জন্য বিমানকে এই সনদ দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কার্গো কমপ্লেক্সের জনবল কাঠামো ঠিক না হলে মার্চের পর তারা আর এই সনদ নবায়ন করবে না। এতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে সব ধরনের রফতানি কার্যক্রম। গত ১৯ ডিসেম্বরের পর বিমানের কার্গো ভিলেজ থেকে শুধু মরদেহ ও ২ গ্রাম ওজনের কূটনৈতিক ডকুমেন্ট ছাড়া অন্য কোন পণ্য অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে না। এ কারণে কার্গো রফতানি টার্মিনালে অস্ট্রেলিয়াগামী রফতানিযোগ্য পণ্যের স্তূপ জমে গেছে। বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ীরা অন্য পথে তাদের পণ্য পাঠানোর চেষ্টা করছেন। এতে অধিকাংশ ব্যবসায়ীকেই লোকসান গুনতে হচ্ছে । এ দিকে তৈরি পোশাক খাতের একাধিক সূত্র জানায়, আকাশ পথে অস্ট্রেলিয়ায় প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস ও নমুনা পাঠানোর সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিকল্প পথে অন্য দেশের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন সময় নষ্ট হচ্ছে তেমনি আর্থিক ব্যয়ও বাড়ছে। এখন ইইউ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় বিপদে পড়েছে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবল এলাইট প্রোডাক্ট এক্সপোর্টার এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মনসুর আহম্মেদ জানান, বর্তমানে বছরে ১ হাজার থেকে ১৫শ’ কোটি টাকার বেশি সবজি রফতানি হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। এর অধিকাংশই যাচ্ছে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এই মুহূর্তে যদি যুক্তরাজ্য সবজি নেয়া বন্ধ করে দেয় তাহলে দুই শতাধিক ব্যবসায়ী হুমকির মুখে পড়বে।
×