ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বগুড়ার কাঁচামরিচ

দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে, কৃষকের মুখে হাসি

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১০ মার্চ ২০১৬

দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে, কৃষকের মুখে হাসি

সমুদ্র হক ॥ বগুড়ার কাঁচা পত্ত্যে। বগুড়ার কাঁচা মরিচ। বগুড়ার সবুজ কাঁচা মরিচ আর লাল মরিচের ঝালের কদর এখন দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশেও পৌঁছেছে। সবুজ এই মরিচ পেকে লাল না হতেই কার্টনে ভরে প্যাকেটজাত হয়ে উড়োজাহাজের ফ্রেইটে উঠে গন্তব্য- মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া। এবার ইউরোপ ও আমেরিকার পথেও পা বাড়িয়েছে। বগুড়ার মরিচের ঝালের কথা কার না জানা। এই মরিচ বিদেশ বিভূঁইয়ে পাড়ি দেয়ায় চাষীদের মুখে হাসি ফুটেছে। একের দেখাদেখি আরেক চাষী মরিচের আবাদ শুরু করেছে। দিনে দিনে বগুড়ার মরিচের ঝালের চোটে কৃষক লাল হয়ে যাচ্ছে। রফতানি শুরু হওয়ায় থার্ড পার্টি বিজনেস (ফড়িয়া দালাল) জেঁকে বসেছে। বগুড়ার মরিচের ঝাল ও তেজের বাস্তব একটি গল্প আছে। পঞ্চাশের দশকের শেষে কলাকোপা এলাকার একজন গৃহস্ত মরিচের আবাদ করে লাভবান হয়ে তৎকালীন সরকারের কাছে হেলিকপ্টার কিনতে গিয়েছিলেন। মন্ত্রী বলেছিলেন, দেশে যদি কখনও কোন ব্যক্তিকে হেলিকপ্টার কেনার অনুমতি দেয়া হয় তিনিই প্রথম পাবেন। সেই গৃহস্ত আর নেই। এই গল্প আজও প্রবীণ ও মধ্যবয়সীদের মুখে মুখে ফেরে। বগুড়ার মরিচের ঝাল কেমন এরও অনেক উদাহারণ আছে। চট্টগ্রামের কয়েকজন মহাস্থানগড় দেখে ফেরার পথে বগুড়ার হোটেলে খাওয়ার সময় ৪/৫টি করে মরিচ চাইলেন। হোটেল ওয়ালা বললেন, এত মরিচ খেতে পারবেন না। উত্তর ছিল ১০/১২টি করে মরিচ খায় তারা। একটি কাঁচা মরিচের পুরোটি একবারে কামড়ে মুখে নেয়ার পরই বুঝেছিলেন বগুড়ার মরিচের ঝাল কারে কয়! বহু বছর পর এই সবুজ কাঁচা মরিচ চাষীদের ভাগ্য ফিরিয়ে দিচ্ছে। ঢাকার একাধিক রফতানিকারক এখন বগুড়ার মাঠে। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ কাঁচা মরিচ রফতানি হবে। বগুড়ার গাবতলি, সারিয়াকান্দি, সোনাতলা, ধুনট এলাকার কৃষক সকালে উঠেই যাচ্ছে মরিচের ক্ষেতে। তারও আগে পাইকার ও ঢাকা চট্টগ্রামের ক্রেতারা ট্রাক নিয়ে হাজির হচ্ছে। একদিকে মরিচ তোলা হচ্ছে, আরেকদিকে কার্টনে ভরে প্যাকেটজাত করে ট্রাকে তোলা হচ্ছে। ঢাকার এক রফতানিকারক জানালেন, বছর দুয়েক আগেও বিদেশ বিভূঁইয়ে ভারতের কাাঁচা মরিচের কদর ছিল। ভারত রফতানি কমিয়ে দেয়ায় বাংলাদেশের মরিচ যেই না প্রবেশ করেছে অমনি বাজিমাত। এক বছরের ব্যবধানে বিদেশীদের চাহিদা লাফিয়ে দশগুণ বেড়েছে। তারা এখন মরিচ দেখলেই বলে এগুলো বগুড়া বাংলাদেশের মরিচ কি না! কার্টনে ইংরেজীতে ‘গ্রিন চিলিজ অব বগুড়া, বাংলাদেশ’ লিখে দেয়া হয়। চাহিদা বাড়ছে, সেই তুলনায় উৎপাদন হয়নি। তবে কৃষক আশাবাদী এই ভেবে যে, সামনের বছরগুলোতে মরিচের এই চাহিদা অব্যাহত থাকলে মরিচের আবাদ বেশি হবে। বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে এ বছর বগুড়ার ১২ উপজেলায় ৮ হাজার হেক্টর জমিতে মরিচের আবাদ হয়েছে। বেশি আবাদ হয়েছে সারিয়াকান্দি, গাবতলি ও সোনাতলায়। মোট উৎপাদিত ৩২ হাজার মেট্রিক টন মরিচের মধ্যে ক্ষেতেই ২৪ হাজার মে.টন রফতানির জন্য বিক্রি হয়ে গেছে। কৃষকের কাছে একটি সুখের বার্তা দিয়েছে যে, মরিচ চাষ করে আর পিছনে তাকাতে হবে না। বগুড়ার গাবতলির জলশুকা, নারিল্যা, সুবোদ, কলাকোপা এলাকায় দেখা যায় মরিচ রফতানির অন্তত দশটি কোম্পানি খুঁটি গেড়ে বসেছে। কখনও সরাসরি জমি থেকে কিনে নিচ্ছে। কখনও যাচ্ছে আড়তে। নারিল্যার কৃষক তাজুল ইসলাম বললেন, তিনি এক একর জমিতে মরিচের চাষ করেছিলেন। এক দিনেই জমি থেকে ১শ’ মণ কাঁচা মরিচ বিক্রি করে এক লাখ টাকা পেয়েছেন। আশা করছেন চলতি মৌসুমে ৪ লাখ টাকার মরিচ বেচতে পারবেন। মৌসুমের শুরুতে মরিচের দর ছিল প্রতিমণ ২ হাজার টাকা। বর্তমানে বিক্রি প্রতিমণ এক হাজার এক শ’ টাকা দরে। তারপরও লাভ থাকছে। এই সবুজ মরিচের পাশাপাশি শুকনো লাল মরিচ কেনার সেন্টারগুলো এবার একটু অসুবিধায় পড়েছে। প্রতিবার যে পরিমাণ লাল মরিচ কিনে তারা গুঁড়া মশলা বানান। এবার তার ব্যত্যয় ঘটতে পারে। কারণ কাঁচা মরিচই এখন রফতানি তালিকায় উঠেছে। তবে এখানেও কৃষক আশাবাদী- কাঁচা মরিচই হোক আর শুকনো মরিচই হোক মরিচ চাষ করে লোকসানের দিন ফুরিয়েছে। মরিচের আড়তদার ও পাইকাররা বলছেন, বিদেশে কাঁচা মরিচ রফতানি শুরু হওয়ায় চাহিদা ও দাম দুই-ই বেেেড়ছে। আরেকদিকে মরিচ প্যাকেটজাত করার শ্রমিকরা কাজ পেয়েছে। প্রতিটি কার্টনে ৫ কেজি করে ভরানো হচ্ছে। বিশেষ ব্যবস্থায় ভরানোতে মরিচ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মরিচ সরাসরি চলে যাচ্ছে ঢাকা বিমানবন্দরে। সেখান থেকে বিদেশে। এভাবে প্রতিদিন অন্তত ৩শ’ মণ করে কাঁচা মরিচ রফতানি হচ্ছে। একজন রফতানিকারক বললেন, তারা ভাবতেই পারেনি বগুড়ার মরিচের কদর রাতারাতি এতটা বেড়ে যাবে। একটা কাঁচা মরিচের ঝালেই তারা এতটা অস্থির। মরিচ কম লাগে বলে এই মরিচই তাদের অধিক পছন্দ। আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় “এ্যার নাম বগুড়ার পত্ত্যে...।”
×