ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অগ্নিঝরা মার্চ

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১০ মার্চ ২০১৬

অগ্নিঝরা মার্চ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ আজ অগ্নিঝরা মার্চের দশম দিন। একাত্তর সালের আরও একটি উত্তাল দিন। অগ্নিগর্ভ বিক্ষুব্ধ বাংলায় বিদ্রোহ-বিক্ষোভের তরঙ্গ প্রবহমান ছিল টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত। দেশজুড়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকা অসহযোগ আন্দোলন চলছে। কোর্ট, কাছারি, অফিস-আদালত ছিল বন্ধ। সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলনের পাশাপাশি চলছে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি। একাত্তরের এদিন সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বাসভবনে একদল বিদেশী সাংবাদিকের কাছে বলেন, ৭ কোটি বাঙালী আজ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। যেকোন মূল্যে তারা এ অধিকার আদায়ে দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত বাঙালীরা অনেক রক্ত দিয়েছে। এবার আমরা রক্ত দেয়ার পালা শেষ করতে চাই। এদিকে পুরো বাংলাদেশ পরিচালিত হচ্ছিল জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অঙ্গুলি হেলনে। ঘরে ঘরে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। বাংলাদেশের অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানেও। আন্দোলনের তীব্রতা বুঝতে পেরে পশ্চিম পাকিস্তানের পত্রিকাগুলো তাদের সুর পাল্টে ফেলে। তারা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে চাপ দিয়ে নিবন্ধ প্রকাশ করে। ইংরেজী দৈনিক ‘দি পিপল’ পত্রিকায় সেদিন ভুট্টোর কার্যকলাপের সমালোচনা করা হয়েছিল। সেখানে অতিসত্বর জনপ্রতিনিধিদের কাছে শাসনভার বুঝিয়ে দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়। দেশমাতৃকার এ সঙ্কটময় সময়ে লেখক-শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীরা সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে। কবি কথাশিল্পী হাসান হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে ঢাকায় কবি, সাহিত্যিকরা গঠন করেছিলেন ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’। শিল্পী সংস্কৃতিকর্মীরাও পিছিয়ে ছিলেন না। অগ্নিঝরা মার্চের প্রথম থেকেই বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র- সব মাধ্যমের শিল্পীই অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়ে মিটিং, মিছিল, গণসঙ্গীতের অনুষ্ঠান করে আসছিলেন। বিভিন্ন শিল্পী সংস্থা থেকে প্রতিনিধি নিয়ে গঠন করা হয়েছিল- ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ।’ এসবের পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের দামাল ছেলেরা সংঘবদ্ধ হচ্ছিল কঠিন সময় মোকাবেলা করতে। ঘরে ঘরে তখন একই সুর ‘তোমাদের ঘরে যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো’- এ স্পন্দন বাঙালী ছেলেদের মনেপ্রাণে উদ্দামতা এনে দেয়। বঙ্গবন্ধুর আহ্বান তাদের নতুন পথের দিশারী। একাত্তরের এই দিনে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল উত্তাল। দেশের এমন কোন প্রান্ত নেই যেখানে পাক হানাদারদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে স্বাধীনতার জন্য মিছিল-মিটিং-সমাবেশ হচ্ছিল না। তবে মুক্তিপাগল বাঙালীর একই দৃষ্টি- ধানম-ির ৩২ নম্বর থেকে বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে পরবর্তী নির্দেশ কী আসে। শুধু আন্দোলনই নয়, পাক হানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধেরও প্রস্তুতি চলছিল দেশের বিভিন্ন স্থানে। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর অফিসার-জওয়ানদের জড়ো করে মুক্তিপাগল দামাল ছেলেরা হাতে-কলমে গ্রহণ করতে থাকে সামরিক যুদ্ধের কলা-কৌশল। স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের এক বিবৃতিতে বাঙালী সৈন্য, ইপিআর ও পুলিশবাহিনীর সদস্যদের প্রতি পাকিস্তানী ঔপনিবেশবাদী সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা না করার আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিতে বাংলাদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিককে স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজে নিয়োজিত প্রতিটি মুক্তিসেনাকে সব ধরনের সাহায্য করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। একাত্তরের অগ্নিঝরা এই দিনে নারায়ণগঞ্জ জেলখানা ভেঙ্গে ৪০ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। জেল পালানোর সময় কারারক্ষী ও কয়েদিদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে ২৭ জন আহত হন। রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ আগের দিন রাজশাহী শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য জারি করা ৮ ঘণ্টার নৈশ কার্ফু প্রত্যাহার করে নেয়।
×