ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কক্সবাজারে কার্গো বিমান বিধ্বস্ত, পাইলটসহ হত ৩

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১০ মার্চ ২০১৬

কক্সবাজারে কার্গো বিমান বিধ্বস্ত, পাইলটসহ হত ৩

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের একটু পরেই কার্গো বিমান বিধ্বস্ত হয়ে সাগরে পড়েছে। এতে পাইলটসহ তিনজন নিহত ও একজন কো-পাইলট আহত হয়েছে। এদের সমুদ্র থেকে জেলে এবং স্থানীয় জনগণ উদ্ধার করেছে। বুধবার সকাল নয়টায় শহরের নাজিরারটেক-সোনাদিয়া পয়েন্টে মোস্তাকপাড়ার চর থেকে আধা কিলোমিটার দূরে সমুদ্রে পতিত হয় বিধস্ত কার্গো বিমানটি। নিহতরা হলেন কো-পাইলট পিটারভ ইভান, ক্যাপ্টেন কেটারভমেরাড ও ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার কুলিশ। তাছাড়া নেভিগেটর ক্যালকোলভ ভøাদিমির নামের আরেক পাইলটকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাকে বর্তমানে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেয়া হয়েছে। তারা সকলেই ইউক্রেনের নাগরিক। জানা গেছে, কক্সবাজার বিমানবন্দর রানওয়ে থেকে উড্ডয়নের একটু পরেই কার্গো বিমানটির ত্রুটি দেখা দিলে পাইলট পিটারভ ইভান যোগাযোগ রক্ষা করেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। কর্তৃপক্ষ কার্গো বিমানটিকে কক্সবাজার বিমানবন্দরে অবতরণের কথা বলেন। পাইলট ঠিকই শহরের হলিডে মোড়ের পাশ দিয়ে রানওয়েতে অবতরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। নুনিয়াছড়ার বাসিন্দা মৎস্যজীবী লীগের নেতা জয়নাল আবেদীন জনকণ্ঠকে বলেন, পাইলট নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে রক্ষা করে গেছেন বিমান বাহিনীর ঘাঁটি, চরপাড়াসহ আশপাশের হাজার হাজার জনতার জীবন ও সম্পদ। কক্সবাজার রানওয়েতে অবতরণ করলে হয়ত জনগণের জানমালের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হতো। তিনি তা বুঝতে পেরে হয়ত কার্গোটি সাগরে নিয়ে গেছেন। নিহত পাইলট গুফারিডকে উদ্ধার করা স্থানীয় সোনা মিয়া মাঝি জানান, তারা বোট নিয়ে মোস্তাকপাড়ার চর এলাকায় অবস্থান করছিল। ওই সময় সাগরে হঠাৎ দেখেন উড্ডয়নরত কার্গো বিমানটি বিকট শব্দ করে আধা কিলোমিটার দূরে পতিত হয়। তারা ১০-১২ জেলে তাদের উদ্ধারের জন্য দ্রুত বোট চালিয়ে ঘটনাস্থলে যান। ২০ মিনিটে তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছে। উদ্ধার করে পাইলটকে। এ সময় অন্য আরেকটি মাছ ধরার বোট নেভিগেটর ক্যালকোলভ ভøাদিমির নামে কো-পাইলটকে উদ্ধার করে। তারা দেখতে পান কার্গো বিমানটি প্রায় সম্পূর্ণ ডুবে গেছে। তাদের উদ্ধারের জন্য কয়েকটি স্থানীয় বোট জড়ো হয়। আহতদের উদ্ধার করে কূলে আনতে এগিয়ে আসে দমকল বাহিনী। আর উদ্ধারকৃত পাইলটদের সদর হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক একজনকে মৃত ঘোষণা করেন। ডাক্তার বলেন, দ্রুত উদ্ধার না হওয়ায় পাইলট আগেই মারা গেছেন। কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক জসিমউদ্দিন জানান, খবর পাওয়ার পরই তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে পাইলটদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসে। কক্সবাজার সদর হাসপাতালের জরুরী বিভাগের দায়িত্বরত চিকিৎসক নোবেল কুমার বড়ুয়া জনান, পাইলট পিটারভ ইভান গুফরাডকে হাসপাতালে আনার আগেই তিনি মারা যান। আর চিকিৎসা চলছে কো-পাইলটের। কক্সবাজার বিমানবন্দরের ম্যানেজার সাধন কুমার মোহন্ত নিশ্চিত করেন, কার্গো বিমানটি চিংড়ি পোনা নিয়ে যশোর যাচ্ছিল। যান্ত্রিক ক্রটির কারণে হয়ত বিমানটি বিধস্ত হয়েছে। ওই কার্গো বিমানে ৯৭২ কার্টন চিংড়ি পোনা ছিল। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন জানান, বিমানবন্দরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২ ইঞ্জিনিয়ারসহ ৪ জন ছিলেন ওই বিধস্ত কার্গো বিমানে। ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, পুলিশসহ অন্যান্য উদ্ধার কর্মীদের উদ্ধার অভিযানে নিখোঁজ দুইজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এদিকে কক্সবাজার বঙ্গোপসাগরে বিধ্বস্ত পোনাবাহী কার্গো বিমানটি উদ্ধারে অভিযান চলছে। কোস্টগার্ড ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের সঙ্গে অভিযানে নামে স্থানীয় অন্তত ৫ শতাধিক জনতা। কোস্টগার্ডের কক্সবাজার কন্টিনজেন্ট কমান্ডার নান্নু মিয়া জানান, স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় আমরা অভিযান চালিয়েছি। বিধ্বস্ত বিমানটি কূলে আনা যায়নি। উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া স্থানীয় সংবাদকর্মী মঈনুদ্দিন জানান, অত্যাধুনিক কোন যন্ত্রপাতি না পেয়ে প্রথমে আমরা সনাতনি পদ্ধতির রশি দিয়ে বিধ্বস্ত বিমানটি টেনে আনার চেষ্টা করি। তবে বিমানটি কূলে আনা সম্ভব হয়নি। কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন কমান্ডার (ভারপ্রাপ্ত) আব্দুল মজিদ জানান, নিখোঁজদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। স্পীডবোট ও স্থানীয় মাছ ধরার ট্রলার নিয়ে উদ্ধার অভিযান চলানো হয়। বুধবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শহরের নাজিরারটেক থেকে অন্তত ২ কিলোমিটার দূরে সোনাদিয়া চ্যানেলে বিমান দুর্ঘটনাটি ঘটে। নেভিগেটর ক্যালকোলভ ভøাদিমির নামে একজনকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে কর্তব্যরত চিকিৎকরা জানিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানায়, বিমানটিতে অতিরিক্ত পোনার বক্স ছিল। এমনকি ‘ইমার্জেন্সি এক্সিট’ দরজার কাছেও পোনার বক্স ঠেসে রাখা হয়। এ কারণে বিমানটি দুর্ঘটার শিকার হয়। তার মতে, বিমানটি সাগরে পড়ে গেলেও ‘ইমার্জেন্সি এক্সিট’ খোলা না পাওয়ায় আরোহীরা বের হতে পারেননি। উদ্ধার অভিযানে থাকা স্থানীয় যুবক আনসারুল করিম জানান, কার্গো বিমান ডুবে যেতে দেখে তারা মাছ ধরার বোটে করে কূল থেকে অন্তত ১ কিলোমিটার দূরে সাগর থেকে একজনকে উদ্ধার করে। পরে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের সহায়তায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। এর কিছুক্ষণ পর আরেকজনকেও হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। স্থানীয় যুবক জামশেদ, মাহবুব জানান, তারা অন্তত ২০টি মাছ ধরার ট্রলার নিয়ে উদ্ধার কাজ চালান। পরে দমকল বাহিনী, কোস্টগার্ড ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। স্থানীয় কাউন্সিলর আকতার কামাল জানান, নাজিরারটেকের অদূরে হওয়ায় বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার দৃশ্য স্থানীয় লোকজন ও জেলেদের নজরে আসে। তৎক্ষণাৎ তারা বোট নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে পাইলট ও ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে নিয়ে আসে। কক্সবাজার বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক সাধন কুমার মোহন্ত জানান, পোনা বোঝাই করে কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে রওনা দিয়ে নাজিরারটেকের অদূরে গিয়ে বিধ্বস্ত হয় বিমানটি। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিই। ফায়ার সার্ভিস কক্সবাজার স্টেশনের উপসহকারী পরিচালক মোঃ জসিমউদ্দিন জানান, স্থানীয় কাউন্সিলর আকতার কামালের দেয়া সংবাদের ভিত্তিতে আমরা সাগরে গিয়ে তাদের উদ্ধার করি। দুর্ঘটনার শিকার ‘ট্রু ভিশন’ নামের কার্গো বিমানটি যশোরের উদ্দেশ্যে সকালে কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে রওনা হয়। ওই কার্গো সার্ভিসটি পরিচালনা করতেন মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক। এই কার্গো বিমানে করে দীর্ঘ দিন ধরে কক্সবাজার থেকে খুলনা, সাতক্ষীরা, ঝালকাঠিসহ বিভিন্ন জেলায় পোনা পরিবহন করে আসছিল। কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি মোঃ আসলাম হোসেন জানান, নিহত পাইলট-ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারদের মরদেহ কক্সবাজার সদর হাসপাতালের রাখা হয়েছে। কক্সবাজার সদর হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডাঃ নোবেল কুমার বড়ুয়া জানান, আহত ইঞ্জিনিয়ারের মাথায় ও ডান পায়ে গুরুতর আঘাত রয়েছে। মাথা ও পায়ের অপারেশন করতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সমন্বয়ে মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
×