ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কার্ড জালিয়াতির পর রিজার্ভ হ্যাকিং

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১০ মার্চ ২০১৬

কার্ড জালিয়াতির পর রিজার্ভ হ্যাকিং

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে অত্যাধুনিক কারিগরিপন্থায় গ্রাহকদের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ডলার (৮শ’ কোটি টাকার সমপরিমাণ) বিদেশী হ্যাকারদের মাধ্যমে লোপাট হয়ে যাওয়ার ঘটনা দেশের আর্থিক সেক্টরকে বড় ধরনের শঙ্কিত করেছে। ঘটনা যাই হোক, ব্যাংকের অর্থ সঞ্চয় করার ক্ষেত্রে এক ধরনের সন্দেহ দানা বেঁধেছে সাধারণ গ্রাহকদের মাঝে। প্রসঙ্গত, এমনিতেই দেশের তফসিলী ব্যাংকগুলোতে সঞ্চয়ী আমানতের বিপরীতে সুদের হার ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং এতে করে গ্রাহকদের বড় একটি অংশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে রয়েছে। এ অবস্থায় এটিএম বুথগুলো থেকে বিদেশী জালিয়াত চক্রের সহায়তায় অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা এবং এর পর পর বাংলাদেশ ব্যাংকের নামে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভে থাকা এ্যাকাউন্ট থেকে ৮শ’ কোটি টাকা সুইপ্ট কোড ব্যবহার করে হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। এটিএম বুথ জালিয়াতির ঘটনার কোন সুরাহাই এখনও হয়নি। এক বিদেশীসহ কয়েক ব্যাংক কর্মকর্তা গ্রেফতার হওয়া ছাড়া কার্যকর কোন সফলতা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে অর্জন করা এখনও সম্ভব হয়নি। এ ঘটনায় কিছু বেসরকারী ব্যাংক, মানি এক্সচেঞ্জারসহ বেশ কয়েকটি পক্ষ জড়িত থাকতে পারে বলে প্রাথমিক বক্তব্য দিয়ে সংশ্লিষ্টরা তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে বলে প্রতীয়মান হলেও গ্রাহক কূলে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮শ’ কোটি টাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ব্যাংক থেকে লোপাট হয়ে যাওয়ার ঘটনার খবর সচেতন মহলকে ভূমিকম্পের মতো নাড়া দিয়েছে। এ পর্যন্ত এ ঘটনা নিয়ে যেসব তথ্য এবং মন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য এসেছে তাতে সমতার বিষয়টি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত বলেই প্রতীয়মান। ব্যাংকিং সেক্টরের বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, দেশের ইতিহাসে বিদেশী ব্যাংকে রক্ষিত বাংলাদেশের এত বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা এই প্রথম। ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি স্বীকার করার পর অতি দ্রুততম সময়ে লোপাট হওয়া অর্থের একটি অংশ নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে দাবি করা হলেও এর পরিমাণ কত এবং তা কিভাবে আনা হলো এ নিয়ে সবিস্তারিত কোন ব্যাখ্যা এখনও মেলেনি। ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর পর অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল এ ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়নি। যদি তাই হয় তাহলে প্রশ্ন ওঠে এত বড় জালিয়াতি ঘটনার পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে অর্থমন্ত্রীকে তা জানানো হলো না কেন? এরপর লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, অর্থ লোপাট হয়ে যাওয়ার অভিযোগটি অস্বীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ঘটনায় অর্থমন্ত্রী এখন বলছেন ফেডারেল রিজার্ভ তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারবে না। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে মামলা করা হবে। কিন্তু সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভে রাখা বাংলাদেশী এত বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট হয়ে যাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কেন দীর্ঘ সময় ধরে চাপা দিয়ে রেখেছে? তবে গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংক এ্যাকাউন্টে রক্ষিত স্থিতি হ্যাকড হয়েছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে কি পরিমাণ স্থিতি হ্যাকড হলো, কখন হলো, এ ব্যাপারে তারা কি ব্যাখ্যা পেয়েছে এর কিছুই উৎসুক মহলকে রহস্যজনকভাবে জানতে দেয়া হচ্ছে না। এসব ঘটনা নিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরসহ অভিজ্ঞ বিভিন্ন সূত্রে জানানো হচ্ছে, এটিএম বুথ থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নেয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভে রাখা বাংলাদেশী ৮শ’ কোটি টাকা সরিয়ে নেয়ার ঘটনাবলী পুরো ব্যাংকিং সেক্টরকে বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে। এ দুটি ঘটনার পর সরকার ও ব্যাংক সেক্টরের পক্ষ থেকে যে ধরনের কার্যকর ভূমিকা উৎসুক মহল আশা করেছিল তা না মেলায় সংশ্লিষ্টদের মনে বড় ধরনের হতাশা নেমে এসেছে। এদিকে, দেশের তফসিলী ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকদের রক্ষিত আমানতের বিপরীতে সুদের হার একেবারে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। অগ্রিম প্রচার চলছে এ হার নাকি আরও হ্রাস পাবে। ফলে সংশ্লিষ্ট আমানতকারীরা সঞ্চয়ের কোন্ পথে অগ্রসর হবে এবং এর নিশ্চয়তার হার কি তা নিয়ে শঙ্কিত অবস্থায় রয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে বড় বড় জালিয়াতি ঘটনার পর বিপুল অঙ্কের অর্থ খোয়া যাওয়ার ঘটনা নিয়ে কোন সুরাহাই করা যায়নি। অভিযুক্তদের গ্রেফতার, মালামাল ক্রোকসহ অন্যান্য ঘটনাবলী লোপাট হওয়া অর্থের কানা কড়ির সমানও নয়। জনগণের রক্ষিত অর্থ এভাবে লোপাট হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধেও দৃষ্টান্তমূলক কোন শাস্তি এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। অপরদিকে, ব্যাংকিং সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশের ৫৬টি তফসিলী ব্যাংকে ৮ লাখ কোটি টাকারও বেশি অলস অর্থের স্তূপ পড়েছে। তফসিলী ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ইতোপূর্বেকার চেয়ে বহুগুণে কড়াকড়ি আরোপ করায় অলস অর্থের পরিমাণ কেবলই বেড়ে চলেছে বলে জানা গেছে। তবে যে সমস্ত কর্পোরেট হাউস ও শিল্পপতি, শিল্পোদ্যোক্তা ও বড় অঙ্কের অর্থের আমদানি-রফতানির সঙ্গে জড়িতরা যেভাবেই হোক প্রতিনিয়ত ব্যাংকিং ঋণ বলতে যেটা বোঝায় সেটা ঠিকই যোগাড় করে নিচ্ছে। কিন্তু এর পরও বাজারে আর্থিক লেনদেনের গতি ইতোপূর্বেকার তুলনায় বহুগুণে হ্রাস পেয়ে আছে। আর এ কারণেই ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে সুদের হারও কেবলই কমেছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, তফসিলী ব্যাংকগুলো আমানতের বিপরীতে সুদের হার কমালেও ঋণের সুদের হার কমাতে তত তৎপর নয়। আর এ কারণে বছর শেষে তফসিলী ব্যাংকগুলো শত শত কোটি টাকা মুনাফা করার তথ্য প্রচার করে নিজেদের যোগ্যতা ও অগ্রযাত্রার নানা দিক প্রচার করতে দ্বিধাবোধ করছে না। ব্যাংকের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, এসএমই ব্যাংকিংয়ের ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা ছাড়া দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে অগ্রগতি সাধন কোন অবস্থাতেই সম্ভব নয়। বড় বড় শিল্পপতি ও শিল্পোদ্যোক্তারা, ব্যবসায়ী গ্রুপ অবাধে যেভাবে ব্যাংক ঋণ পেয়ে থাকে সে তুলনায় সাধারণ ব্যবসায়ীরা তার ধারে কাছেও নেই। যে কারণে ছোট ছোট ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটাতে ব্যর্থ হচ্ছে, যা দেশের আর্থিক সেক্টরের জন্য বড় ধরনের প্রতিবন্ধক হয়ে আছে। এসব বিষয় নিয়ে চট্টগ্রামের বড় বড় বাণিজ্যপাড়ার ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা অভিন্ন সুরে বলেছেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অঙ্কের ডিজিটে আনা না গেলে আর্থিক সেক্টরের কাক্সিক্ষত উন্নতি কখনও আসবে না। গ্রাহকদের আমানতী সুদের হার যেভাবে কমানো হয়েছে অনুরূপভাবে ব্যাংক ঋণের সুদের হারের পরিমাণের দিকটিও বিবেচনা করতে হবে। এসব অবস্থা চলতে থাকার প্রেক্ষাপটে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের মন্দাভাব বিরাজ যে করছে তা অস্বীকার করার জো নেই। ঠিক সে সময়ে ব্যাংকিং সেক্টরে এটিএম বুথ জালিয়াতি করে গ্রাহকদের অর্থ লোপাট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রিজার্ভ ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮শ’ কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাওয়ার ঘটনা দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে নানাভাবে নানাদিক দিয়ে বেকায়দায় ফেলেছে। এর উত্তরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর ভূমিকা ও এর প্রয়োগ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে ব্যাংক সেক্টরের অভিজ্ঞ সূত্রে মত ব্যক্ত করা হয়েছে।
×