ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্বর্ণসূত্রের সুদিন

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ১০ মার্চ ২০১৬

স্বর্ণসূত্রের সুদিন

এক সময় স্কুল শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় রচনা লেখার একটি প্রধান বিষয় ছিল পাট। বলা হতো সোনালি আঁশ। সাহিত্য ভাষায় স্বর্ণসূত্র। তারপর গত শতকের শেষ দিক থেকে সেই সোনালি আঁশ হয়ে পড়ে কৃষকের গলার ফাঁস। পাটের ওপর রচনা লেখাও বন্ধ হয়ে যায়। পরীক্ষায়ও আর আসে না। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুতে বৈদেশিক আয় উপার্জনের প্রধান মাধ্যম এই পাট তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। সে অনেক কথা। অনেক ইতিহাস। ষাট দশকে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকদের ভুল ‘প্রাইসিং’-এর ফলেই পাট তার গৌরব হারাতে শুরু করে এবং একেবারেই তলানিতে এসে পৌঁছে। ঋণের ভারে জর্জরিত কৃষক, ঋণে পর্যুদস্ত হলো বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন এবং এশিয়ার মধ্যে সর্ব বৃহৎ পাটকল আদমজী জুটমিল বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ হলো একের পর এক পাটকলগুলো। সত্যি বলতে কি, বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিতে পাটের অস্তিত্বের কথা কৃষক ছাড়া আর সবাই ভুলতে বসেছে। সুসংবাদ যে, সেই পাট কৃষকের গলার ফাঁস হওয়া থেকে আবার সমহিমায় ফিরে এসেছে। বলা যায়, পাটের সুদিন ফিরে এসেছে। স্বদেশে যেমন, তেমনি বিশ্বজুড়ে বেড়ে চলেছে পাটজাত পণ্যের চাহিদা। দামও ভাল। ট্র্যাডিশনাল পাটের বস্তা ও সুতার চাহিদা ক্রমশ বেড়েছে। নতুন নতুন প্রযুক্তির সমন্বয়ে রূপান্তরিত পাটজাত পণ্য মন কাড়ে একালে সহজেই। এসব পণ্য যেমন শৌখিন তেমনই প্রয়োজনীয়। পরিবেশবান্ধব তো বটেই। বলা যায়, যে পাট অতীতের গৌরব হারিয়ে সোনালি আঁশ হতে এদেশের চাষীকুলের গলার ফাঁস হয়ে গিয়েছিল, তা-ই আবার বিশ্ববাজারে নিজের জায়গা করে নিচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা পাটের জেনোম কোড উন্মোচনের পর সোনালি সম্ভাবনা নিয়ে পাটের ফিরে আসার দিগন্ত প্রসারিত হয়েছে। পাটের বহুমুখী ব্যবহারের ক্ষেত্র ক্রমশ প্রসারিত হয়েছে। পাটতন্তু দিয়ে ব্যাগ, মেয়েদের শাড়ি, কোট, টিস্যুবক্স, জুতা-স্যান্ডেল, ওয়ালম্যাট, কার্পেট, গাড়ির সানরুফসহ নানা পণ্য তৈরি হচ্ছে। জুট জিও টেক্সটাইলের উৎপাদন বিস্তৃত করছে পাটের চাহিদাকে। দেশে এখন ১৩১ ধরনের পাটপণ্য তৈরি হচ্ছে। এসব পণ্য বিদেশেও যাচ্ছে। চাল, চিনি, গম, ধান, ভুট্টা ও সারের মোড়কে পাটের বস্তার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে ২০১০-এ পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক আইন করা হয়। পাটের ব্যাগের চাহিদা থাকলেও অবশ্য উৎপাদন তেমন নেই। পলিথিন নিষিদ্ধ হলেও বাজারে তার যথেচ্ছ ব্যবহার চলছে। কৃত্রিম এই তন্তুর আগ্রাসন থেকে দেশের প্রকৃতিকে বাঁচানোর লক্ষ্যে প্যাকেজিং অধ্যাদেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশেই ২০ লাখ কাঁচা পাটের অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরি করা হয়েছে। পাটশিল্পকে তার হৃতগৌরব ফিরিয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রীর চিন্তাভাবনা এবং দৃঢ় অঙ্গীকার রয়েছে বরাবরই। বর্তমানে পাটকে শুধু বহির্বিশ্বে নয়, অভ্যন্তরীণ বাজারেও ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় করে তোলার কাজে সরকারের আন্তরিক আগ্রহ বেশ সুচিন্তনীয়। তাই পাটের তৈরি সুতা তথা স্বর্ণসূত্রকে আরও নমনীয় করে উৎপাদনের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। এই সুতায় তৈরি হবে বাংলার আরেক ঐতিহ্য জামদানি শাড়ি। আর সেই শাড়ি বিক্রি হবে স্বল্পমূল্যে। তখন পাট হয়ে উঠবে সত্যিকারের সোনালি আঁশ। যা কিনা দেশের অর্থনীতিকে পরিণত করতে পারে স্বর্ণভা-ারে। পাট কমিশন ২০১১ সালে তাদের প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করেছে, তা বাস্তবায়ন করা জরুরী হয়ে পড়েছে। পাটের বহুমুখী ব্যবহারের মধ্য দিয়ে পাটের উৎপাদক চাষীরা পাবেন ন্যায্যমূল্যের নিশ্চয়তা, অতীতের মতো হতে হবে না বঞ্চনার শিকার। পাটের ভাগ্যাকাশে সম্ভাবনার যে রক্তিম আলো দেখা দিয়েছে, তা যে কোন মূল্যে ধরে রাখাই হবে কৃষি খাতে নয়া বিপ্লবের উৎস।
×