ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন প্রজন্মের জন্য

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ১০ মার্চ ২০১৬

নতুন প্রজন্মের জন্য

গৌরব জি. পাথাং নতুন প্রজন্মের মানুষ আমরা। আমাদের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের পরে। আমরা কেউই মুক্তিযুদ্ধ করিনি কিংবা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। কারও কাছ থেকে শুনেছি কিংবা বই পড়ে জেনেছি। আমি শুনেছি আমার বাবার কাছ থেকে। বাবা সমরাজ মারাক (সম্রাট রিছিল) একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী শুনেছি। তারা কিভাবে যুদ্ধ করেছেন, কিভাবে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন তা শুনেছি। নতুন প্রজন্ম যুদ্ধ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় উজ্জীবিত হতে পারে মনে করে আমার বাবার স্মরণীয় একটি যুদ্ধের বর্ণনা দিচ্ছি। বাবা যুদ্ধ করেছেন ময়মনসিংহ জেলার নকলা, তেলেখালি, কড়ইতলা, বান্দরকাঁটা রণাঙ্গনে। তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ভারতের তুরা জেলার ১৩ কিমি দক্ষিণে রংনাবাগ নামক স্থানে। যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতেন কর্নেল আবু তাহের। তার ৩নং কোম্পানিতে কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন নাজমুল হক। নাজমুল হকের মৃত্যুর পর ডা. উইলিয়াম ম্রং এই কোম্পানির দায়িত্ব নেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি উইলিয়াম কোম্পানির একজন ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তারা বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ী শিবির স্থাপন করে যুদ্ধ করতেন। ভারত বাংলাদেশ বর্ডারে গাছুয়াপাড়া বিএসএফ ক্যাম্প থেকে যুদ্ধ করতেন। একদিন বিএসএফ কমান্ডার ক্যাপ্টেন বাজিৎ সিংহ নির্দেশ দিলেন কড়ইতলী পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করার জন্য। তাই সূর্য অস্তমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেলেন। কিন্তু তাদের আগেই পাকবাহিনীরা তাদের ক্যাম্প আক্রমণ করতে লাগল। শুরু হলো দুই পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময়। রাত বারোটার দিকে ক্যাপ্টেন বাজিৎ সিংহ নিয়ে এলেন এলএমজি। তারপর শুরু হলো জীবন মরণ যুদ্ধ। সেই দিন ভোরে যুদ্ধ থেমেছিল। তার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ও বিভীষিকাময় ঘটনা হলো ৬ ডিসেম্বর। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর যুদ্ধ ঘোষণার পর সমরাজ মারাক, সুকেন ও হরমুজ আলী এই তিনজনের দায়িত্ব ছিল মিত্রবাহিনীকে গাইড করা বা পথ দেখানো। প্রত্যেক মিত্রবাহিনীর গলায় ছিল আশীর্বাদম-িত মেডেল। যুদ্ধে নামার আগে ‘বন্দে মাতরম’ উচ্চারণ করে বাংলাদেশের মাটিতে নেমে পড়লেন। তারা হালুয়াঘাট থানার নয়াপাড়া গ্রামে এসে বাঙ্কার স্থাপন করলেন। সেখানে এসে হালুয়াঘাট থানার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে থ্রি ইঞ্চি মর্টার ছুড়ে মারলেন। তখনই দুই দলের মধ্যে গুলি বিনিময় শুরু হলো। চারদিকে শুধু মর্টারের শব্দ। তারপরও তারা যুদ্ধ করতে করতে মোজাখালি গ্রামে এসে পড়লেন। ভারত থেকে তিনটি যুদ্ধ বিমান এসে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে গুলিবর্ষণ করতে লাগল। সেই দিনই শত্রুমুক্ত হলো হালুয়াঘাট থানা। বাবার মুক্তিযুদ্ধ ও সংগ্রামের অনুপ্রেরণা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে ধারণ করে আছি। আমার মতো এই নতুন প্রজন্মের মানুষ যারা, আমরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত আছি। আর সেই চেতনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে ত্রিশ লাখ শহীদের তাজা প্রাণ, হাজার হাজার নরনারীর আত্মত্যাগ ও এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। সেই স্বাধীনতাকে আমাদের এখন রক্ষা করতে হবে। স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা ও সবার জন্য স্বাধীনতা নিশ্চিত করাই হবে নতুন প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধ। কারণ এখনও আমরা মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় উগ্রতা, মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাস বিকৃতি, সাম্প্রদায়িকতা, অত্যাচারী নিপীড়ক ও কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে মুক্তি পাইনি। যারা দেশকে উন্নতির পথে বাধা দিচ্ছে, মৃত্যুকূপে পরিণত করছে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্যও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কিছু অসৎ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃতি করছে, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নেরও গরমিল দেখা যাচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের তুলনা হতে পারে না। ছেলেমেয়েরা ভুল শিখছে। পরীক্ষায় নম্বর পাওয়ার জন্য ভুল হলেও তাই লিখে দিচ্ছে। নতুন প্রজন্মের মানুষের কাছে সত্য ইতিহাস তুলে ধরা প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধা ও পিতামাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য। নতুন প্রজন্মের তরুণদেরও উচিত সঠিক ইতিহাস আবিষ্কার করা। অসত্যকে পরিহার করা। অসত্য, অন্যায় ও মন্দকে জয় করাই হবে নতুন প্রজন্মের বড় মুক্তিযুদ্ধ। রামপুরা, ঢাকা থেকে
×