ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মাত্র চার ঘণ্টা ঘুমিয়েও বড় স্বপ্ন নাইটগার্ডের

স্ট্রিট লাইটের আলোয় পরীক্ষার প্রস্তুতি হার না মানা জীবন

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৯ মার্চ ২০১৬

স্ট্রিট লাইটের আলোয় পরীক্ষার প্রস্তুতি হার না মানা জীবন

মোরসালিন মিজান ॥ রাতের বাংলা মোটর। দশটার বেশি বাজে। ভিআইপি সড়কে ঘন যানবাহন। একেকটি গাড়ি পারলে উড়ে চলে যায়। যেহেতু পারছে না, হর্ন বাজিয়ে তুলকালাম অবস্থা করছে। পাবলিক বাসের হেল্পারদের কারণে-অকারণে চিৎকার। মোটরসাইকেলগুলো যথারীতি ফুটপাথে উঠে এসেছে। ফুটপাথে আরও আছে বিড়ি- সিগারেটের দোকান। লোকজন বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আড্ডা, গল্প জমাচ্ছে। সব, সবকিছু খুব কাছ থেকে দেখছে আহসান হাবীব। আবার দেখছে না। সব রকমের শব্দ তার কানে আসছে। আবার আসছে না। সে নিজের মতো ব্যস্ত। একটি ইলেকট্রনিক পণ্যের তালাবদ্ধ শোরুমের সামনে টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসে আছে। গায়ে ইউনিফর্ম। হ্যাঁ, সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি। খোলা আকাশের নিচে বসে শোরুম পাহারা দিচ্ছে। একই সঙ্গে ব্যস্ত লেখাপড়ায়! জীবনযুদ্ধ এবং এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে সমানতালে। না, প্রথম দেখায় এসবের কিছুই বোঝা যায় না। দেখার সুযোগই কম আসলে। মূল রাস্তায় নতুন লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই আলোর পুরোটা টেবিল পর্যন্ত এসে পৌঁছে না। গাড়ির হেডলাইটের বড়সড়ো আলো কখনওসখনও গায়ে এসে পড়ে। আর তখন মনে হয় কোন সিকিউরিটি গার্ড অলস বসে সিনে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছে। প্রকৃত ঘটনা বুঝতে কিছু সময় সেখানে অবস্থান করতে হয়। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয় গল্পটা। এখানে ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে এলজি বাটারফ্লাইয়ের একটি শোরুম। শোরুমের সামনে ছোট্ট টেবিল-চেয়ার পেতে বসে পড়ছে আহসান হাবীব। মূল সড়কের দিকে মুখ করেই চলছে লেখাপড়া। বিব্রত বা বিরক্ত না করতে এই প্রতিবেদক গত বৃহস্পতিবার রাতে সতর্ক পায়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ান। কিন্তু টের পাওয়ামাত্র নড়েচড়ে বসে ছেলেটি। হাত দিয়ে মুখ আড়াল করে রাখে। এ অবস্থায় পরিচয় গোপন রেখে দু’একটি কথা বলা সম্ভব হয়। ততক্ষণে ঠিকই বিব্রত বোধ করে সে। তার বয়সী সবাই ঘরে বসে পড়ে। সে বই খুলে বসেছে ফুটপাথের ওপর। এ জন্য কিছুটা যেন লজ্জা। এমনকি নিজের নামটি জানাতে দ্বিধবোধ করে। দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় জানা যায়, সে আহসান হাবীব। গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরায়। সাতক্ষীরার ঝাউডাঙ্গা কলেজের ছাত্র। মাত্র কয়েকদিন পর ৩ এপ্রিল তার পরীক্ষা। খুব টেনশন হচ্ছে। এটুকু বলে উঠে পড়ে সে। টেবিলে বই খোলা রেখে ভেতরের দিকে চলে যায়। বোঝা যায়, অস্বস্তি বোধ করছে। তবু অপেক্ষা বাকি গল্পটা শোনার। কিছু সময় পর সে ফেরে। সামনে পরীক্ষা যে! ফিরতে হয়। এবার এ কথা সে কথা বলে বুঝিয়ে কিছুটা বশে আনা যায় তাকে। আহসান হাবীব জানায়, সে গত বছর একদফা এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। সব বিষয়ে এ গ্রেড। সমস্যা হয়েছিল ইংরেজীতে। ভাল আয়ত্তে আনতে পারেনি। প্রাইভেট পড়তে পারলে হতো। সেটা তার জন্য দুঃসাহস। অত টাকা নেই। এ অবস্থায় পরীক্ষায় বসে পাস নম্বর তোলা সম্ভব হয়নি। তাই বলে থামতে নারাজ। বলল, একবার পারিনি। পরেরবার পারব। চেষ্টা তো করতে হবে। তাই বলে এই রাতে রাস্তায় বসে? কেন? জানতে চাইলে মুখে কিছু বলার আগে চোখ তার কথা বলে ওঠে। স্ট্রীট লাইটের আলোয় দেখা যায়, চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। বলল, বাবার বয়স হয়েছে। কোন কাজ করতে পারেন না। মাকেও দেখতে হয়। পড়ালেখা যে কোন মূল্যে চালিয়ে যাব। এ জন্যও টাকা লাগবে। সব ভেবে গত বছর ঢাকায় চলে এসেছিলাম। অন্য অনেক কাজ খোঁজার চেষ্টা করেছি। পাওয়া যায়নি। পরে এক পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে গ্রুপ ফর সিকিউরিটিজে কাজ নেই। প্রতিদিন ১৪ ঘণ্টা ডিউটি। সন্ধ্যা ৭ টা থেকে শুরু। চলে পরের দিন সকাল ৯টা পর্যন্ত। লেখাপড়া করারও এই একটাই সময়। তাই বাধ্য হয়ে ডিউটি আর লেখাপড়া একসঙ্গে করতে হচ্ছে। পাশের বিল্ডিংয়ের নিচে কিছুটা গ্যারেজের মতো। জায়গাটি দেখিয়ে সে বলে, ওখানেও পড়ি। কিন্তু এখন বিদ্যুত লাইন নষ্ট। কেউ ঠিক করছে না। এই প্রতিবেদক খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হন, বিদ্যুত লাইনটি কোন এক বিশেষ কারণে ঠিক হবে না। হওয়ার নয়। তার মানে, ফুটপাথেই ছেলেটিকে পড়তে হবে। বাংলা মোটরের রাস্তায় নতুন লাইটের ব্যবস্থা করেছে সিটি কর্পোরেশন। এখন অনেক বেশি আলো। কিন্তু ফুটপাথে টেবিল পেতে বসার পক্ষে যথেষ্ট নয়। বইয়ের কাছে বেশ খানিকটা নুয়েও ছোট ছোট অক্ষর দেখা সম্ভব হয় না। অথচ আহসান হাবীব দেখে। তাকে দেখতে হয় আসলে! তার টেবিলে মোবাইল ফোনের আলো ফেলার পর দৃশ্যমান হয় বেশ কয়েকটি পুরনো গাইড বই। দু’এক পাতা উধাও হয়ে গেছে। এসব ঘেঁটে যেটুকু সম্ভব, নিজেকে প্রস্তুত করার চেষ্টা। কিন্তু শুধু গাইড বইয়ে চলবে? সাহায্য করার কেউ নেই? কোন শিক্ষক? বড় ভাই? পরিচিতজন? এত বড় শহর, পাওয়া যায়নি কাউকে? জবাবে আহসান হাবীব জানায়, ফার্মগেটের লক্ষ কোটি কোচিং সেন্টারের বেশে কয়েকটিতে সে গিয়েছিল। যোগাযোগ করেছিল। কেউ বিনে পয়সায় পড়াতে রাজি হয়নি। ‘না’ বলে দিয়েছে। ছেলেটির বাকি কথাগুলো গাড়ির বিকট শব্দে হারিয়ে যায়। আবারও কথা বলে তার রাতজাগা চোখ। রাত জাগতে জাগতে কেমন গর্তে ঢুকে গেছে চোখগুলো। সেই গর্তে খুব সহজেই পানি জমে। জমেছিল! পরক্ষণেই অবশ্য নিজেকে সামলে নেয় আহসান হাবীব। হতাশ হতে রাজি নয় সে। বলে, একবার ফেল হয়েছি। তাতে কী? আবার পরীক্ষা দিয়ে পাস করব। চেষ্টা করতে হবে না! চেষ্টাগুলোও অদ্ভুত। তার বইয়ের নিচে একটি খাতা। সেটি উল্টে দেখা গেল, কালো বলপয়েন্টে লেখা কিছু ইংরেজী প্যারাগ্রাফ। যেখানে বানান ভুল কিংবা বাক্য গঠনে সমস্যা সেখানে লাল কালি দিয়ে কাটা। কে দেখে দিয়েছে তাহলে খাতা? জানতে চাইলে আবারও অবাক হতে হয়। সে বলে, আমি নিজেই নিজের পরীক্ষা নেই। নিজে না দেখে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর লিখি। পরে নিজেই গাইড দেখে ভুল শুদ্ধ বের করি। ভুলগুলো লাল কালি দিয়ে কাটি যাতে মনে থাকে। এইচএসসির চেয়েও কঠিন আহসান হাবীবের জীবনযুদ্ধটা। গল্পের সব বলতে নারাজ সে। অনুমান করা যায়, চড়াইউৎরাই অনেক ছিল। এখনও অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সে জানায়, নাইট গার্ডের চাকরি অনেক কষ্টের। তবু তাকে করতে হচ্ছে। করতে হবে। কারণ সে হার মানতে চায় না। তার মাসিক বেতন সাড়ে ৭ হাজার। এখান থেকে ৫ হাজার টাকাই পাঠিয়ে দেয় বাড়িতে। বাবা-মায়ের জন্য। নিজের খাওয়া খরচ বাবদ যায় ২০০০ টাকা। মাসের আর যা কাজ, ৫০০ টাকায় সারতে হয়। তার খাবার নির্দিষ্ট। সকালে ভাতের সঙ্গে আলুভর্তা আর ভাজি। দুপুরে মাছ। রাতে সবজি এবং ভাজি। প্রতিদিন একই খাবার। অরুচি হয় না? এমন প্রশ্নে তার উত্তরÑ অভ্যাস হয়ে গেছে। যে ঘরে সে থাকে সেটি খুব ছোট। ছোট্ট ঘরে থাকে মোট ১২জন! শান্তি এই যে, ঘরটির জন্য ভাড়া গুনতে হয় না। কোম্পানি ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সে জানায়, রুমের সবার একসঙ্গে থাকা হয় না। কেউ ডিউটি হতে আসে। কেউ তখন ডিউটিতে যায়। এভাবে তিন-চার বা তার বেশিজনের সঙ্গে দেখা হয় না। আহসান হাবীব সকাল ৯টায় ডিউটি শেষ করে রুমে যায়। হাত-মুখ ধুয়ে নাস্তা করে পড়তে বসে। দুপুরে খাওয়ার পর ঘুম। চার ঘণ্টা মাত্র ঘুমোয়! ফের ইউনিফর্ম গায়ে চাপিয়ে বইয়ের ব্যাগটা কাঁধে নেয়। চলে আসে কর্মস্থলে। শুরু হয়ে যায় ডিউটি। লেখাপড়া চলে একইসঙ্গে। আহসান হাবীব জানায়, তার ইচ্ছা আইন বিষয়ে পড়ার। বড় ডিগ্রী অর্জন করতে চায় সে। হ্যাঁ, এইচএসসিতে একবার ফেল। মাত্র চার ঘণ্টা সে ঘুমোতে পারে। তবু স্বপ্নটা বড়। স্বপ্নটা সে দেখতে জানে!
×