ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শত কোটি টাকা ঢেলেও শেষ রক্ষা হলো না মীর কাশেমের

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৯ মার্চ ২০১৬

শত কোটি টাকা ঢেলেও শেষ রক্ষা হলো না মীর কাশেমের

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ লবিস্ট নিয়োগ ও দেশে-বিদেশে নানা অনৈতিক পন্থায় শতকোটি টাকা ঢেলেও শেষ রক্ষা হলো না বদর বাহিনীর অন্যতম শীর্ষ নেতা মীর কাশেম আলীর। মৃত্যুদণ্ড থেকে নিজেকে রক্ষায় সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। আপীলের রায়ে ফাঁসির দ- বহাল থাকায় তাকে ঝুলতে হবে ফাঁসির দড়িতে। প্রমাণ হলো, টাকা দিয়ে সবকিছু কেনা যায় না। কুখ্যাত এই নেতার টর্চার সেল ছিল চট্টগ্রামের ডালিম হোটেল। সঙ্গত কারণেই চট্টগ্রামে উচ্ছ্বাসের মাত্রাটাও বেশি। ইসলামী ছাত্রসংঘের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এবং পরবর্তীতে ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সুরা সদস্য মীর কাশেম আলীর বাড়ি চট্টগ্রামে না হলেও তার ব্যবসাবাণিজ্য, বিত্তবৈভব ও অবস্থান চট্টগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধকালে চট্টগ্রাম নগরীর ডালিম হোটেল ছিল তার নেতৃত্বাধীন আল বদর বাহিনীর টর্চার সেল; যেখানে মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও তাদের স্বজনকে ধরে এনে চালানো হতো নির্যাতন। সেই ‘মহামায়া ডালিম ভবন’ এখনও নির্যাতনের করুণ স্বাক্ষী হয়ে আছে। মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে রায় ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একাত্তরে নিহত ও নির্যাতিতদের স্বজনরা যোগ দেন আনন্দ মিছিলে। গণজাগরণ মঞ্চ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানারে বের হয় আনন্দ মিছিল। চট্টগ্রাম নগরীর নন্দনকাননে অবস্থিত মহামায়া ডালিম ভবন এখন জরাজীর্ণ। কিন্তু এই ভবনের দেয়ালে কান পেতে এখনও স্বজনরা শুনতে পান তাদের আগের পুরুষদের কান্না আর চিৎকারের শব্দ। এই টর্চার সেল পরিচালনার সঙ্গে আরও অনেকে থাকলেও অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন মীর কাশেম আলী। নির্যাতক হিসেবে কুখ্যাত মীর কাশেম নামটি ছিল আতঙ্ক। ‘গুডস হিল’ বলতে যেমন সাকা চৌধুরীর নামটি চলে আসে তেমনিভাবে ‘ডালিম হোটেল’ নামটি মুখে নিতেই চলে আসে মীর কাশেম আলীর নাম। লোকমুখে বেশ প্রচারিত, ‘সাকা’র গুডস হিল আর মীর কাশেমের ‘ডালিম হোটেল’। এরমধ্যে সাকার মৃত্যুদ- ইতোমধ্যে কার্যকর হয়েছে। আর মীর কাশেম আলীর চূড়ান্ত রায় ছিল অপেক্ষায়। ধনকুবের এই দুই যুদ্ধাপরাধীর বিচার শেষ পর্যন্ত হবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ও ছিল জনমনে। সাকার ক্ষেত্রে সে সংশয় দূরীভূত হয়েছে। এখন মীর কাশেম আলীর দ- কার্যকরের জন্য অপেক্ষার পালা। মীর কাশেম আলী ও ডালিম হোটেল যেন অবিচ্ছিন্ন দুটি নাম। ডালিম হোটেল বলতেই মীর কাশেমের নাম আসে। আর মীর কাশেম বলতেই বয়স্কদের মনে ভেসে ওঠে সেই ডালিম হোটেলে নির্যাতনের চিত্র। ডালিম ভবনে যত নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে তার খুব সামান্যই উঠে এসেছে প্রচার মাধ্যমে। ১৯৭১ সালে ঈদ-উল-ফিতরের পরদিন মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনকে আটক করে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা নিয়ে যায় ডালিম হোটেলে। ২৮ নবেম্বর দিনভর চলে তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন। এতে মারা যান জসিম। এর পর আরও ৫ জনের সঙ্গে তার লাশ ফেলে দেয়া হয় কর্ণফুলী নদীতে। মামলায় আনীত এ অভিযোগ আপীলেও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ-ের রায় বহাল রাখা হয়েছে। এছাড়া এই হোটেলে স্থাপিত টর্চার সেলে নির্যাতনে রণজিৎ ও টুন্টু দে নামে আরও দুজন খুন হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও কতজন যে নির্যাতিত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন তার সঠিক হিসাব নেই। ডালিম হোটেলে অকথ্য নির্যাতনের শিকার আরেক মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে রক্ষা পান। আপীলে ফাঁসির দ- বহাল থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, মীর কাশেম আলী তার বিচার বন্ধের জন্য বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ ও নানা অনৈতিক পন্থায় অঢেল অর্থ ব্যয় করেছে। সে টাকা দিয়ে আইন-আদালত কিনতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। তিনি বলেন, তার পুত্র আমার কাছে টাকা নিয়ে এসেছিল। চেয়েছিল অর্থের বিনিময়ে আমাকে সাক্ষ্যদান থেকে বিরত রাখতে। কিন্তু নিরীহ মানুষকে এভাবে ধরে এনে যে নির্যাতন করেছে তার বিরুদ্ধে শত বাধা এলেও আদালতে সাক্ষী দেব বলে জানিয়ে দিয়েছি। তিনি বলেন, মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- কার্যকর হলে ডালিম হোটেলে নির্যাতিত হয়ে মৃত্যুবরণকারীদের আত্মা শান্তি পাবে। ন্যায্যবিচার হওয়ায় তিনি সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম আরও জানান, ১৯৭১ সালের ২২ অথবা ২৩ নবেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর মাদারবাড়ি এলাকায় কারফিউ ঘোষণা করে বাসায় বাসায় ঘেরাও দিয়েছিল বদর বাহিনী। বাড়ি থেকে তাকে এবং তার ছোট ভাই প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা দস্তগীর চৌধুরীসহ (পরে বিএনপি নেতা) আরও কয়েকজনকে ধরে বেঁধে ডালিম হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। নির্যাতনের মুখেও বলেছিলাম ‘জয় বাংলা’। সেদিন আমার মায়ের চোখের জল তাদের মনকে গলাতে পারেনি। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে ডালিম হোটেলের দিকে এগিয়ে যান। তারাই আমাকেসহ অনেককে মুক্ত করে আনেন। ডালিম হোটেলে নির্যাতনের আরেক সাক্ষী তৎকালীন বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা সাইফুদ্দিন খানের স্ত্রী নারীনেত্রী নুরজাহান খান। মীর কাশেম আলীর বদর বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে যান সাইফুদ্দিন খানকে। তার ওপরও চলে অকথ্য নির্যাতন। নুর জাহান খান বলেন, ফাঁসির দ- বহাল থাকায় যারা স্বজন হারিয়েছেন ও যাদের স্বজনরা নির্যাতিত হয়েছেন তাদের দীর্ঘদিনের মনোকষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে। তিনি জানান, ১৯৭১ সালের ২৪ নবেম্বর নগরীর মাদারবাড়ি পোড়া মসজিদের পাশে আজিজ কলোনি থেকে বদর বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল রাজনৈতিক নেতা সাইফুদ্দিন খানকে। দীর্ঘদিন ধরে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছিল না যুদ্ধাপরাধীদের। নির্যাতিত সাইফুদ্দিন খান মারা যান ২০০৭ সালে। তিনি এ বিচার দেখে যেতে পারলেন না। এদিকে, আপীলে মীর কাশেম আলীর ফাঁসির দ- বহাল থাকায় রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই চট্টগ্রামে বেরিয়ে পড়ে আনন্দ মিছিল। সকালে নগরীর প্রেসক্লাব থেকে জামালখান সড়ক হয়ে আন্দরকিল্লা ঘুরে চেরাগী পাহাড় মোড়ে এসে সমাবেশে মিলিত হন গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক, কর্মী ও সমর্থকরা।
×