ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

মানবিক সম্পর্কের সমীকরণ ও বিশ্ব পরিস্থিতি

প্রকাশিত: ০৩:৩১, ৯ মার্চ ২০১৬

মানবিক সম্পর্কের সমীকরণ ও বিশ্ব পরিস্থিতি

মানুষের প্রতিশোধপরায়ণতা কত ভয়ঙ্কর হতে পারে তার অনেক নিদর্শন রয়েছে গ্রীক নাটক ও পুরাণে। এমন কি শেক্সপীয়ারের নাটকেও। ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ বিশেষ করে ‘টাইটাস এ্যান্ড্রোনিকাস’ এর নাম এ মুহূর্তে মনে পড়ছে। মার্চেন্ট অব ভেনিসের ইহুদী ব্যবসায়ী শাইলাকের ওপর প্রতিশোধের কথা মোটামুটি আমাদের সবার জানা। তুলনায় কম আলোচিত ‘টাইটাস এ্যান্ড্রোনিকাস’ এর বর্বরতা প্রতিমুহূর্তে লোমহর্ষক। প্রতিশোধপরায়ণ এক রোমান জেনারেলের হিংস্রতা ও বীভৎসতায় রঞ্জিত এ নাটক। এক নারীর ওপর নির্মম প্রতিশোধ নিতে জেনারেল টাইটাস এ্যান্ড্রোনিকাস ওই নারীর পুত্রদের হত্যা করে তাদের হাড়, গোড়, রক্ত, মাংস দিয়ে পাই বানিয়ে তাকে খেতে বাধ্য করে। সফোক্লিসের নাটকের ওপর ভিত্তি করে রচিত ‘মেটামরফসিস’ কাব্যের বিষয়বস্তুও বীভৎস প্রতিশোধপরায়ণতায় ভরা। সভ্যতার কেন্দ্র এথেন্সকে চারদিক থেকে ‘বর্বর’রা ঘিরে ধরলে আক্রান্ত এথেন্সের এক রাজা প্যান্ডিয়ান বর্বর থ্রেসিয়ান রাজা টেরিউসের সাহায্য চায়। টেরিউস এথেন্স রক্ষা করলে প্যান্ডিয়ান নিজের মেয়ে প্রকনিকে টেরিউসের সঙ্গে বিয়ে দেয়। পাঁচ বছর টেরিউসের সঙ্গে ঘর করার পর প্রকনি এথেন্সে নিজের পরিবার বিশেষ করে বোন ফিলোমেলকে দেখার জন্য যেতে চায়, টেরিউস সম্মত হয় না। সে জানায়, বড় জোর সে এথেন্সে গিয়ে তার বোনকে এনে দিতে পারে। প্রকনি অগত্যা তাতেই রাজি হয়। টেরিউস এথেন্সে যায় এবং ফিলোমেলকে নিয়ে ফেরার পথে তাকে ধর্ষণ করে। এ ঘটনা যাতে কাউকে বলতে না পারে সে জন্য টেরিউস ফিলোমেলের জিভ কেটে নেয়। কিন্তু কথা বলতে না পারলেও বোনের বাড়ি এসে নকশি কাপড়ে ছবি এঁকে ফিলোমেল বোনকে পুরো ঘটনা জানায়। প্রকনি ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিশোধ নিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তার এবং টেরিউসের প্রিয় পুত্র আইটিসকে হত্যা করে টেরিউসকে রেঁধে খাওয়ায়। কাহিনীর এ পরিণতিকে যে কারো কাছে লঘু পাপের গুরু দ- মনে হবে। কিন্তু এর মোরাল হচ্ছে সভ্যতার দূষণ। গ্রীক সভ্যতার কেন্দ্র এথেন্স উন্নত সংস্কৃতির ধারক। উন্নততর সভ্যতার রাজা প্যান্ডিয়ান ইতর সভ্যতার টেরিউসের সহায়তা নিয়ে প্রাথমিকভাবে এ দূষণ ঘটিয়েছে। এরপর নিজের মেয়েকে তার সঙ্গে বিয়ে দেয়ায় উন্নত রক্তের সঙ্গে ইতর রক্তের সংমিশ্রণ ঘটল। তাতেই একের পর এক মানবিক সম্পর্কের বিপর্যয় এবং বিকৃতি। টেরিউসের সঙ্গে বিয়ে মেনে নিলেও প্রকনি কখনওই ভুলতে পারেনি। তার শরীরে বইছে উন্নত সংস্কৃতির রক্ত। এত তীব্র তার জাত্যাভিমান যে বোনের ওপর সংঘটিত অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে নিজের সন্তানকে অবলীলায় হত্যা করতে বাধেনি। জাত্যাভিমানের এ ধারা প্রাচীন যুগ পেরিয়ে রেনেসাঁস হয়ে ভিন্ন ভিন্ন ধারায় সামনের দিকে প্রবাহিত হয়েছে। শেক্সপীয়ারের সময় সভ্য অসভ্য নিয়ে তর্ক চলেছে। অটোম্যান তুর্র্কীরা সে সময়ের ইউরোপের আধুনিকতম নগরী ভেনিসের কর্তৃত্ব থেকে সাইপ্রাস দখলে এ তর্ক আরও তীব্র হয়। এরপর গোটা পূর্ব ইউরোপ দখল করলে তখন পর্যন্ত জানা পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ অটোম্যানদের কর্তৃত্বে চলে যায়। ইউরোপীয়দের কাছে যা ছিল ভীতিকর। এর বিজয়াভিযানকে দেখা হয়েছিল সভ্য পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে অসভ্য বা তাদের ভাষায় বর্বর প্রাচ্যের আক্রমণ হিসেবে। আসলেই কি প্রাচ্য অসভ্য ছিল? অনেক পরে এডওয়ার্ড সাঈদ তত্ত্ব ও যুক্তি দিয়ে বলেছেন- না। প্রাচ্যকে তারা সেভাবেই দেখেছে যেভাবে তারা দেখতে চেয়েছে। প্রাচ্য আসলে যা সেভাবে নয়। রেনেসাঁসের সময় প্রবলভাবে মনে করা হতো খ্রীস্টান জগত হচ্ছে সভ্যতার কেন্দ্র আর এর সীমার বাইরের জনগোষ্ঠী হচ্ছে অসভ্য বা বর্বর। প্রাক খ্রিস্টান যুগেও এ মনোভাব ছিল। অহেলৈনীয় মাত্রই বর্বর বলে গণ্য হতো। সভ্যতার কেন্দ্র থেকে যে জনগোষ্ঠী যত বেশি দূরে তারা ততো বেশি বর্বর। তাই তাদের সঙ্গে সভ্যদের রাজনৈতিক ও সামাজিক মিশ্রণকে ভীষণভাবে দোষের মনে করা হতো। এ মনোভাবের নবায়ন দেখি উনিশ শতকের আমেরিকায় ব্ল্যাক কোড বা ‘কৃষ্ণাঙ্গ বিধান’-এর মধ্যে। গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে কৃষ্ণাঙ্গরা ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্তি পেলেও স্বাধীন মানুষ হিসেবে তাদের গতিবিধির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। শ্বেতাঙ্গদের এলাকায় তারা চাকরি, ব্যবসা বা অন্য কোন ধরনের কাজ করতে পারবে না। বাস করার তো প্রশ্নই ওঠে না। তাদের ব্যবহার করা জলাশয়, পার্ক, বাস-ট্রেনসহ অন্য যানবাহন, হাসপাতাল, কবরস্থান, ব্রোথেল ইত্যাদিতে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এ নিষেধ অমান্য করলে প্রকাশ্যে জীবিত পুড়িয়ে মারা হতো তাদের। বিশ শতকের শুরুতে আমেরিকার কয়েকটি রাজ্যের প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষকে ‘দূষিত রক্ত’ বহনের অপরাধে নির্বীর্য করা হয় এবং ভার্জিনিয়া ও ক্যালিফোর্নিয়ার মতো বড় বড় রাজ্যে এদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ রাখা হতো। অনেক গবেষক মনে করেন হিটলার ‘ঘেটো’র ধারণা পেয়েছিল এখান থেকে। কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার হরণের আরেক সূত্র সুপ্রজনন বিদ্যা। তথাকথিত এ তত্ত্বের মূল সুর হলো, প্রকৃতিতে জীবন সংগ্রামের ফলে যেমন উন্নত অভিযোজন প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতে বেঁচে থাকার সাফল্য নির্ধারণ করে, সে রকম মানুষের মধ্যেও উন্নত প্রকৃতির মানুষ তুলনামূলকভাবে নিকৃষ্ট প্রকৃতির মানুষদের জীবন সংগ্রামে পরাজিত করে উৎকৃষ্ট মানব প্রজাতি বা শ্বেতাঙ্গ মানুষ সৃষ্টি করেছে। শ্বেতাঙ্গরা অন্য বর্ণের মানুষদের থেকে উৎকৃষ্টতর- সুপ্রজনন বিদ্যার নাম করে এ তত্ত্ব তখন হার্ভার্ড, কলম্বিয়া, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নামী-দামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে ঢুকে যায়। কিছু মনস্তাত্ত্বিক ও শিক্ষাবিদ যথারীতি এ নিয়ে গবেষণায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। এসব গবেষণার সার কথা ছিল- গরিবরা, যাদের মধ্যে শতকরা প্রায় নব্বই ভাগ কৃষ্ণাঙ্গ এবং রেড ইন্ডিয়ান, গরিব কারণ তাদের বুদ্ধির বিকাশ ঘটেনি। দেখতে শুনতে এরা মানুষের মতো হলেও কিছুতেই এদের শ্বেতাঙ্গদের মতো উন্নত মানুষ করা যাবে না। এদের দিয়ে দাসত্ব করাতে না পারলে এদের বেঁচে থাকা অর্থহীন। সুতরাং এদের উন্নত করার জন্য অর্থ ব্যয় না করে এদের বংশ রোধ করাই হবে সরকারের অবশ্য কর্তব্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে সুপ্রজনন তত্ত্ব বিস্তারের শুরু, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে এ প্রচারণা তুঙ্গে ওঠে। আমেরিকান সুপ্রজনন সোসাইটি সে সময় জনাকীর্ণ বিভিন্ন জায়গায় লিফলেট ছড়িয়ে প্রচারণা চালাত, যাতে লেখা থাকত ‘প্রতি পনেরো সেকেন্ডে তোমার এক শ’ ডলার ব্যয় হচ্ছে হীন বংশোদ্ভূত, হীন মানসিকতার, পাগল, অপরাধী এবং শারীরিক-মানসিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ মানুষদের রক্ষণাবেক্ষণে’। আমেরিকার সুপ্রজনন বিদ্যার সর্বোচ্চ ফলিত রূপ দেখা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসীদের ইহুদী নিধন যজ্ঞের মধ্যে। উনিশ শ’ ঊনচল্লিশ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার চার বছরের মধ্যে নাৎসিরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পঞ্চাশ লাখের বেশি ইহুদী, জিপসী ও সøাভিককে ‘দূষিত রক্ত’ বহনের অভিযোগে হত্যা করে। এ রকম বহু হত্যাযজ্ঞ বিভিন্ন সময়ে নানা নামে ‘সুসভ্য’ পাশ্চাত্য করেছে। সামাজিকভাবে আমেরিকায় যখন বর্ণবাদের সপক্ষে সুকৌশল প্রচারণা চলছে, অর্থনীতিতেও তখন চলছে নবতর সংযোজন। বাজারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া, ব্যক্তি মালিকানার অনুমোদন, অবাধ প্রতিযোগিতার নিশ্চয়তা এবং রাষ্ট্রের তথাকথিত নিরপেক্ষ ভূমিকা- এই চার মূলনীতি নিয়ে অগ্রযাত্রার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ ছক অনুযায়ী পথ চলতে শুরু করে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এগোতে এগোতে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর তা দুর্ধর্ষ গতিবেগে ছড়িয়ে পড়ে। সহস্রাব্দের শুরু থেকে এর প্রভাব মানুষকে চূড়ান্ত আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে। আত্মকেন্দ্রিকতা বা নিজের স্বার্থ পূরণের যে আদিম মনোবৃত্তি মানুষের মধ্যে সুপ্ত থাকে, প্রতি মুহূর্তে তা উস্কে দিচ্ছে বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। সূক্ষ্মভাবে মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে অহেতুক অভাববোধ। যাতে মনে হয় ভোগের যাবতীয় আয়োজন তার জন্য অপরিহার্য। একদিকে গণতান্ত্রিক অধিকার হারিয়ে সে বঞ্চিত ও শোষিত হয়, অন্যদিকে পণ্যের গ্রাহক হয়ে নিজের অজান্তে পুঁজিপতিদের মুনাফার পাহাড় গড়তে সাহায্য করে। এ ব্যবস্থা মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতাকে সযতেœ লালন করে প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে এমনভাবে উপস্থাপন করে যাতে মনে হয়, সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য স্বার্থপরতাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ মানবিক গুণ। এ মানসিকতা জন্ম দেয় বিকৃত এক প্রতিযোগিতার। যেখানে সৎ, মেধাবী, আদর্শবান কর্মঠ মানুষেরা পিছিয়ে পড়েন। প্রতিভা থাকার পরও বিত্তবান হতে না পারায় চারপাশের মানুষেরা তাদের করুণা করে। যেন বিত্ত অর্জনই প্রতিভা পরিমাপের ব্যারোমিটার। মেধা প্রতিভা জ্ঞান পণ্যের মোড়কে উপস্থাপিত না হলেই তা হয়ে পড়ে মূল্যহীন। এই ভোগপ্রবণ মানসিকতা ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা সমাজে যে অস্থিরতা সৃষ্টি করে তা থেকে বিষাদগ্রস্ততা, হতাশা ইত্যাদি নানা ধরনের মানসিক উপসর্গ ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে পড়ে। যার বিকৃত বহির্প্রকাশ ইদানীং বড় বেশি করে দেখছি আমরা। এও দেখছি আঁৎকে ওঠার মতো একেকটা ঘটনা হঠাৎ আলোচনার শীর্ষে উঠে ক’দিনের মধ্যেই হারিয়ে যায়। সবাই যে যার মতো ভুলে গিয়ে নিজ কাজে মনযোগী হয়। পুঁজিবাদের এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা যতদিন থাকবে, মানবিক সম্পর্কের বিপর্যস্ততাগুলোও ততদিন এর উপসর্গ হিসেবে নির্দিষ্ট বিরতি দিয়ে প্রকট হয়ে উঠবে।
×