ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কেয়া চৌধুরী

সমতা রক্ষা এবং বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৩:২৮, ৯ মার্চ ২০১৬

সমতা রক্ষা এবং বাংলাদেশ

গতকাল ছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দিবসটি কারও মনগড়া নয়। এর পিছনে আছে ইতিহাস, আছে নানা ত্যাগ। বিশেষ করে এই দিবসটি উদযাপনের পেছনে রয়েছে অসংখ্য নারী শ্রমিক ও কর্মজীবীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরি-বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা। সেই মিছিলে চলে সরকারের লেঠেল বাহিনীর দমন-পীড়ন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কের সোস্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয়। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব করেন। ১৯৭৫ সালের পরবর্তী সময়ে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এরপর থেকে পৃথিবীজুড়েই পালিত হচ্ছে দিনটি নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার অঙ্গীকার নিয়ে। এবারও দিবসটি উদযাপনে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয় নানা কর্মসূচী। আন্তর্জাতিক এই দিবসকে সফল করার জন্য, সার্থক করে তোলার জন্য থাকে চমৎকার কিছু স্লোগান। যেমন : ‘নারী-পুরুষ সমতা গড়ে তোল একতা।’ নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশ সরকার দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের পাশাপাশি ছাত্রীদের শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান। এর মধ্য দিয়ে ইতোমধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার পাশাপাশি নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটছে। এতে করে নারী সমাজের মধ্যে বিস্তর আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, নারীর অধিকার রক্ষায় নারী নীতিমালা প্রণয়ন করেছে সরকার। সদ্য সমাপ্ত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নারী উন্নয়নে বহু কর্মসূূচী হাতে নেয়া হয়েছিল। তার সবকিছু বাস্তবায়ন না হলেও অনেকাংশে অগ্রগতি এসেছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদে নারীর অবস্থান বহির্বিশ্বে প্রশংসিত। নারীর মানবাধিকার সার্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে সামগ্রিক অর্থে পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত না হলেও আজকের বাস্তবতা হলো দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে নারীরা শুধু তাতে অংশগ্রহণই করছে না, বরং মূল চালিকাশক্তি হিসেবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাকাকে সচল রাখছে। এ সত্যকে মেনে নিয়েই নারীবান্ধব আওয়ামী লীগ সরকার চলতি সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা জেন্ডার ভিশনে বলছে, ‘বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ, যেখানে নারী-পুরুষের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে, হোক সেটি অর্থনীতি, সমাজনীতি বা রাজনীতি।’ বাংলাদেশের উজ্জ্বল একটি অধ্যায় হলো নারী তার ক্ষমতায়নের জন্য স্বমহিমায় এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাহসী নারী অর্থনীতির তিনটি বিশেষ প্রধান খাত গার্মেন্টস শিল্প, কৃষি, বিদেশে শ্রমদান করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে চলেছে। উনিশ-বিশ শতকে বেগম রোকেয়া বাংলার নারী সমাজকে ‘বোনেরা জেগে উঠো’ বলে আহ্বান করেছিলেন। বাঙালী নারী সমাজের জন্য রোকেয়ার আকাক্সক্ষা ফুটে উঠেছিল তার অনবদ্য রচনা ‘সুলতানার স্বপ্ন’ উপন্যাসে। বেগম রোকেয়া পর্দাপ্রথার নামে নারীর প্রতি সামাজিক বৈষম্য থেকে বের হয়ে আসার কথাই শুধু বলেননি, চিন্তা-জগতের মুক্তি এনে নিজেকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়বার তাগিদ দিয়েছেন। শিক্ষার মধ্য দিয়ে উত্তরণের পাশাপাশি প্রকৃত বাঙালীপনার চর্চা, নিজ সিদ্ধান্তে অটুট থাকার পরামর্শ তার লেখনীতে স্পষ্টত প্রতীয়মান। আজকের প্রেক্ষাপটে বাঙালী নারী অনেক দূর এগিয়ে। তারা শুধু অর্থনীতিতেই দক্ষতার স্বাক্ষর রাখছে না, বরং বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্ব করছে। সম্প্রতি ভারতের গুহাটিতে অনুষ্ঠিত ‘দক্ষিণ এশিয়া গেমসে’ বাংলার দুই ‘স্বর্ণকন্যার’ স্বর্ণপদক জয়ের দুর্লভ মুহূর্ত গোটা দেশবাসীকে আনন্দের অশ্রুজলে সিক্ত করেছে। ‘নারীর ক্ষমতায়নে দেশের ক্ষমতায়ন’-এর বাস্তবতা যেন ফুটে উঠেছে। গত ২৬ জানুয়ারি ‘পুলিশ সপ্তাহ’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘জাতীয় পুলিশ সপ্তাহ-২০১৬’ যে প্যারেডের নেতৃত্ব দেন একজন উর্ধতন নারী কর্মকর্তা, যা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে আমরা শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ ভারতকে পিছনে ফেলে এসেছি। আর এটি সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের নারীর দৃঢ় মানসিক শক্তির কারণে। কারণ বাংলাদেশের নারীরা জানে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা আমাদের পাশে রয়েছেন। যিনি নিজেও মঙ্গা, বন্যা, মহামারী, অভাবের দেশ বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করতে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ তার নিজস্ব অর্থায়নে ‘পদ্মা সেতু’র মতো বৃহত্তর সেতু নির্মাণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। ‘লোডশেডিং’ শব্দটিকে হিমাগারে পাঠাতে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প ‘রূপপুর পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্র’ স্থাপন শুরু করতে যাচ্ছে। একজন নারী রাষ্ট্রনায়ক হয়ে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বাঙালীর কাক্সিক্ষত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করে চলেছেন তিনি। নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জীবনের নিরাপত্তা ঝুঁকি মাথায় নিয়ে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে এ সফলতা অর্জন বিশ্বের সকল নারীর জন্য আনন্দের ও শিক্ষণীয়। সম্প্রতি খবরের কাগজের মাধ্যমে জানতে পারলাম, আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটের আকার হবে ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। যদি তাই হয়, উন্নয়নের মহাসড়কে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা সরকার আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে। আমরা আশা করব, এ এগিয়ে যাবার অধ্যায়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি নারী সমাজের জন্য থাকবে আরও অফুরন্ত সম্ভাবনা। ৪০ লাখ শ্রমজীবী নারীর মজুরি সমতাকে সরকার উপলব্ধিতে আনবে। বিশেষ করে গৃহকোণে নারীর শ্রমের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন আজ সময়ের দাবি। নারীবান্ধব শেখ হাসিনা সরকার তৃণমূলে নারীর ক্ষমতায়ন, মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আগামী দিনে আরও প্রসারিত হবে। তবেই আমরা ২০১৬ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘অধিকার মর্যাদায় নারী-পুরুষ সমানে সমান’ সেøাগানকে ষোলোআনা বাস্তবায়ন করতে পারব। লেখক : সমাজকর্মী ও সংসদ সদস্য
×