ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোবাইল ফোনে প্রতারণা জড়িত বিদেশী চক্র ॥ জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৮ মার্চ ২০১৬

মোবাইল ফোনে প্রতারণা জড়িত বিদেশী চক্র ॥ জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য

শংকর কুমার দে ॥ বিদেশ থেকে একটি গিফট বক্স এসেছে। এর জন্য পরিবহন ব্যয় বাবদ ৫৬ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে। কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিনিধির নাম ভাঙ্গিয়ে এই কথাগুলো মোবাইল ফোনে বলেছেন এক চিকিৎসককে, যার সঙ্গে কিছু দিন আগে বন্ধুত্ব হয়েছিল এক বিদেশীর। বিদেশী বন্ধুর পাঠানো গিফট পেতে ওই চিকিৎসক কুরিয়ার সার্ভিসের প্রতিনিধির নাম ভাঙ্গানো ব্যক্তির কথায় বিশ্বাস করে ৫৬ হাজার টাকা পাঠান, ১০ ফেব্রুয়ারি। তার পরের দিন ১১ ফেব্রুয়ারি। কুরিয়ার সার্ভিসের এক শাখা থেকে মোবাইল ফোনে আবার চিকিৎসককে জানানো হয়, গিফট বক্সের এক্সরে স্ক্যান রিপোর্টের তথ্যে দেখা যায় যে, গিফট বক্সে ডায়মন্ডের (হিরা) গয়না আছে, যার মূল্য ২ কোটি টাকা। গিফট বক্সটি সংগ্রহ করতে হলে তাকে পাঠাতে হবে ২ লাখ ৬২ হাজার ৯০০ টাকা, একটি বেসরকারী ব্যাংক শাখার দেয়া হিসাব নম্বরে। দু’দিন পর, ১৪ ফেব্রুয়ারি ওই চিকিৎসক নির্ধারণ করে দেয়া একটি বেসরকারী ব্যাংকের হিসাব নম্বরে নির্ধারিত টাকা পাঠান। ব্যাংক হিসাব নম্বরে সকালে টাকা পাঠানোর পর বিকেলে ওই চিকিৎসককে জানানো হয়, গিফট বক্সের ভেতরে অনেক মূল্যবান জিনিস থাকায় তাকে আরও ১০ লাখ ৮৩ হাজার টাকা পাঠাতে হবে। বিদেশী বন্ধুর পাঠানো মূল্যবান গিফট বক্সের আশায় দুই দফায় টাকা পাঠিয়ে প্রতারিত হওয়ার পর তৃতীয় বারে গিয়ে বিষয়টি সন্দেহ হয় ওই চিকিৎসকের। জানানো হয় গোয়েন্দা পুলিশকে। গোয়েন্দা র‌্যাব, পুলিশ তদন্ত করে দেশী প্রতারক চক্রের সহায়তায় বিদেশী প্রতারক চক্র এভাবে একের পর এক প্রতারণা করে যাওয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য উদঘাটন করেছে। তদন্তের স্বার্থে ও প্রতারিত চিকিৎসকের নাম প্রকাশ করা নিষেধ থাকার কারণে তাদের নাম প্রকাশ করা গেল না। গোয়েন্দা পুলিশ র‌্যাব সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, বিদেশী প্রতারক চক্রের নানা ধরনের অপরাধ করার নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিচ্ছে বাংলাদেশ। গত এক মাসে অন্তত অর্ধশত বিদেশীকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদে এই ধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্য উদঘাটন করেছে র‌্যাব ও পুলিশ। গ্রেফতারকৃত বিদেশীদের কাছ থেকে ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল সেট, দেশী টাকা ও বিদেশী মুদ্রা উদ্ধার করা হয়। আধুনিক ও উন্নত ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে প্রলোভনের টোপে ফেলে নানা পেশার মানুষজনের টাকা পয়সা হাতিয়ে নিয়ে ফতুর করছে তারা। কার্ড জালিয়াতি, জাল মুদ্রা-ডলার তৈরি, নারী পাচার, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে বিদেশী প্রতারক চক্র। র‌্যাব ও পুলিশ সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সূত্র জানায়, গত এক মাসে যে ৩০ বিদেশীকে গ্রেফতার করা হয়েছে তার মধ্যে আছে ২১ জন নাইজিরিয়া, কেনিয়া ও উগান্ডার এবং ৪ শ্রীলঙ্কার নাগরিক। বাংলাদেশে বৈধভাবে বসবাস করার কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেনি গ্রেফতারকৃত বিদেশীরা। এ ছাড়াও ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতারণার অভিযোগে ১২ বিদেশী নাগরিকসহ মোট ১৪ জনকে আটক করেছে র‌্যাব। এদের মধ্যে নাইজিরিয়ার ৮ জন, কঙ্গোর একজন ও ক্যামেরুনের ৩ নাগরিক রয়েছেন। বাংলাদেশসহ চার দেশের নাগরিক মিলে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে শিক্ষিত ও ধনী নারীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে প্রতারণা করে চক্রটি। এদিকে এর আগে ফেসবুকের মাধ্যমে প্রতারণা করে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে তিন বিদেশীসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তারা প্রত্যেকেই নাইজিরিয়ার নাগরিক। এরা সচ্ছল ব্যক্তিদের টার্গেট করে প্রতারণা করেছেন বলে অভিযোগ পেয়েছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা। রাজধানীর বিভিন্ন ব্যাংক বুথে কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকের ২০ লাখ টাকা তুলে নেন জার্মানির নাগরিক থমাস পিওটর। তিনি দুই বছর ধরে এ দেশে অবস্থান করে একটি শক্তিশালী জালিয়াত চক্র তৈরি করে। এ চক্রে আরও কয়েকজন বিদেশীর সঙ্গে বাংলাদেশী ব্যাংক কর্মকর্তা ও বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তি জড়িত। ওই সব বিদেশীকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। আরেকজন বিদেশী নাগরিককে গোয়েন্দারা শনাক্ত করেছেন। পিওটরের এ দেশে থাকার কোন বৈধ কাগজ নেই। কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকের বুথ থেকে কী পরিমাণ টাকা তুলে নিয়েছেন, তার সঠিক হিসাব পিওটর গোয়েন্দাদের নিশ্চিত করতে পারেনি। পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, অবৈধভাবে অবস্থানকারীদের মধ্যে রয়েছে ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, চীন, কোরিয়া, আফ্রিকা, ক্যামেরুন, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, নাইজিরিয়া, ঘানা, কঙ্গো, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, আলজিরিয়া, সুদান, তানজানিয়া, উগান্ডা ও শ্রীলঙ্কার নাগরিকরা। এসব বিদেশী নাগরিকের পছন্দের এলাকা হচ্ছে গুলশান, বনানী, রামপুরা, নিকুঞ্জ ও উত্তরা। এদের বেশিরভাগই হুন্ডি, জাল ডলার তৈরি ও বিক্রি, মাদক পাচার এবং নানা ধরনের প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। এ দেশে প্রবেশ করতে বিদেশী নাগরিকরা নানা কৌশল অবলম্বন করেন। ভিসা পেতে পর্যটক, খেলোয়াড় বা কোন সভা- সেমিনারে অংশগ্রহণ কিংবা স্বেচ্ছাসেবক সংস্থার কর্মী হিসেবে তথ্য প্রদান করেন। এদের বড় একটি অংশ ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও অবৈধভাবে এখানে অবস্থান করছেন। বছরের পর বছর তারা ভিসা নবায়ন করছেন না। পুলিশের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গী সংগঠনের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরেই এ দেশে সক্রিয় আছে। এরা বেশিরভাগই পাকিস্তানের। এ ছাড়া ভারত ও বাংলাদেশের চোরাকারবারিদের বিদেশী অপরাধী চক্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। আফ্রিকান নাগরিকরা অপরাধের সঙ্গে জড়িত অনেক আগে থেকেই। সম্প্রতি ইউরোপীয়ান দেশগুলোর নাগরিকরাও অপরাধের সঙ্গে জড়িত হওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার ও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। অপরাধী সে যেই হোক তাকে আইনে সোপর্দ করা হবে। সে ক্ষেত্রে কে বিদেশী তা দেখা হবে না। এ দেশের প্রচলিত আইনে তাদের বিচার করা হবে। না হলে গ্রেফতারের পর তাদের দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে। অবৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশী যারা নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের ধরতে গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত আছে।
×