ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রথম স্বীকৃত ৪১ বীরাঙ্গনা ভাতা পাচ্ছেন এ মাসে

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৮ মার্চ ২০১৬

মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রথম স্বীকৃত ৪১ বীরাঙ্গনা ভাতা পাচ্ছেন এ মাসে

মশিউর রহমান খান ॥ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর দেশে প্রথমবারের মতো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া ৪১ বীরাঙ্গনাকে ভাতা প্রদান করছে সরকার। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের আগে যে কোন সময় এ ভাতা প্রদান করা হবে বলে জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল এমপি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গত ৮ মাসের ভাতা একসঙ্গে প্রদান করা হবে। এ হিসেবে প্রতি মাসে ৮ হাজার টাকা করে গত বছরের জুলাই মাস থেকে গত ৬ মাসে প্রতি বীরাঙ্গনা ৪৮ হাজার টাকা পাবেন। আর এ বছরের প্রথম ২ মাসে পাবেন ১০ হাজার টাকা করে মোট ২০ হাজার টাকা। প্রতি বীরাঙ্গনাকে একসঙ্গে সর্বমোট ৬৮ হাজার টাকা করে প্রদান করা হবে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ভাতা প্রদান কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বীরাঙ্গনাদের সরকার ভাতা প্রদানের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আজ পর্যন্ত সরকার ঘোষিত সকল সুবিধা প্রদান করা হবে। এছাড়া দুস্থ বীরাঙ্গনাদের বিশেষ সহযোগিতা করতে বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে সরকার। যা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করবে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে স্বীকৃতি পাওয়া ৪১ বীরাঙ্গনার মধ্যে গত বছরের জুলাই থেকে প্রতি মাসে ৮ হাজার টাকা করে ৬ মাসের ভাতা ও পরবর্তী ২ মাসে ১০ হাজার টাকা করে প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড় করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ অর্থ সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের অনুকূলে ছাড় দিয়ে তা বীরাঙ্গনাদের মধ্যে বিতরণের জন্য প্রস্তুতি নিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নির্দেশ দেয়া হয়েছে। স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ৪১ বীরাঙ্গনার মধ্যে সিরাজগঞ্জে ১৩ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১১, ঠাকুরগাঁওয়ে ৬, কুষ্টিয়ায় ৪, ময়মনসিংহে ৪ জন এবং রংপুর, সিলেট ও হবিগঞ্জে একজন করে। গত বছরের ১২ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এসব বীরাঙ্গনাকে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। গেজেট অনুযায়ী বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধারা হলেন, সিরাজগঞ্জের সর্বোচ্চ ১৩ জন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে রয়েছেন- ফকিরপাড়া গ্রামের আয়মনা, চুলিয়াহাতির আছিয়া বেগম, রহমতগঞ্জের মোছা. সূর্য বেগম, বিন্দুপাড়া দত্তবাড়ির কমলা বেওয়া, তেঁতুলিয়া পশ্চিমপাড়ার মোছা. জয়গন, পিটিআই স্কুলপাড়ার ছুরাইয়া খাতুন, সয়াধনগাড়া পূর্বপাড়ার মাহেলা বেওয়া, কান্দাপাড়ার ফকিরপাড়ার হামিদা বেওয়া, কান্দাপাড়ার হাসনা বেগম, চাঁদপুর ঝাউলের শ্রীমতি রাজুবালা দে, চককুবদাশ পাড়ার রহিমা বেওয়া, সদরের ছামেনা খাতুন ও সয়াধনগাড়ার শামসুন্নাহার বেওয়া। চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্বীকৃতি পাওয়া ১১ বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হলেন, গোমস্তাপুর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের নরশিয়া গ্রামের রাবিয়া বেগম, একই গ্রামের রেণু বেগম ও রাহেলা বেগম, লক্ষ্মী নারায়ণপুর গ্রামের এন্তাজ আলীর স্ত্রী হাছিনা বেগম, শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের চৌকামনাকষা গ্রামের মালেকা বেগম, লালাপুর গ্রামের জলো বেগম, বড় বানেশ্বরপুর গ্রামের সাফেদা বেগম, একই গ্রামের আয়েশা বেগম, সাহাপাড়া গ্রামের হাজেরা বেগম, একই গ্রামের আরবী বেগম এবং সদর উপজেলার লাখেরাজপাড়া গ্রামের লিলি বেগম। ঠাকুরগাঁওয়ের ছয়জন হলেন, রাউতনগর গ্রামের সুমি বাসুগী, মনি কিসকু, হাফেজা বেগম, নিয়ানপুরের মালেকা, শিদলীর নিহারানী দাস ও নূরজাহান বেগম। ময়মনসিংহের চারজন হলেন- ফতেহপুর গ্রামের ময়মনা খাতুন, নাকাগাঁও (দক্ষিণপাড়া) গ্রামের হালিমা খাতুন, খন্দকপাড়ার জাহেরা খাতুন ও বালিচান্দার ফাতেমা খাতুন। কুষ্টিয়ার চারজন হলেন- হাসিমপুর গ্রামের এলেজান নেছা, মটমালিয়াটের মোছাম্মৎ মোমেনা খাতুন, দোলাজান নেছা ও নাতুরিয়ার মজিরন নেছা এবং সিলেটের মনতৈল গ্রামের এশনু বেগম, হবিগঞ্জের বেলঘর গ্রামের মাজেদা বেগম ওরফে মাজেদা খাতুন ও রংপুরের কাছনা তকিয়ারপাড়ার মনছুরা বেগম। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৪ বছর পর গত বছরের অক্টোবরে একাত্তরের পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে নির্যাতিত বাংলার এ বীরাঙ্গনাদের বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধে তাদের অসামান্য অবদানের বিশেষ স্বীকৃতিস্বরূপ এই প্রথমবারের মতো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নতুন করা তালিকায় নাম তুলতে বীরাঙ্গনার মৃত্যুর পর তার দাবিদাররা গেজেটে নাম প্রকাশের জন্য আবেদনের সুযোগ পাবেন। এছাড়া আগামী ৩০ জুনের মধ্যে বীরাঙ্গনা নিজে বা তার দাবিদাররা মন্ত্রণালয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির আবেদন করতে পারবেন। এর আগে কোন সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির কথা ভাবেননি। ঘোষণার পাশাপাশি ভাতা প্রদানের মাধ্যমে বাঙালী জাতির বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দীর্ঘদিনের দাবি বাস্তবায়িত হচ্ছে। বীরাঙ্গনা হিসেবে আবেদনকৃতদের মধ্যে পর্যায়ক্রমে যাচাই বাছাইয়ের পর দেশের সব বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃত দেয়া হবে। বীরাঙ্গনাদের নিয়ে সরকারের দেয়া প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০০২ (২০০২ সালের ৮ নাম্বার আইন) এর ৭(ঝ) ধারা অনুযায়ী প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের (বীরাঙ্গনা) তালিকা রুলস অব বিজনেস ১৯৯৬-এর সিডিউল-১ এর ক্ষমতাবলে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হলো। সরকার অতি গুরুত্বের সঙ্গে বীরাঙ্গনার তালিকা তৈরি করছে। সূত্র জানায়, আবেদনকারী মুক্তিযুদ্ধকালীন বীরাঙ্গনা ছিলেন কি না তা অতি সূক্ষ্মভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় প্রতিটি উপজেলায় ৩ সদস্যের একটি বিশেষ কমিটি করে দিয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রধান করে আরও ২ নারী কর্মকর্তাকে সদস্য করা হয়েছে। তবে যেসব উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তা নারী নন সেক্ষেত্রে উপজেলা নারী কর্মকর্তা ও তার সঙ্গে প্রথম শ্রেণীর নারী কর্মকর্তাকে নিয়ে বীরাঙ্গনা কি না তা যাচাই-বাছাই করবেন। চূড়ান্ত বাছাই শেষে মন্ত্রণালয়ে তা প্রেরণ করবেন। মন্ত্রণালয় তালিকা যাচাই করতে চাইলে গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতা নেবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জনকণ্ঠকে বলেন, মার্চ মাসের যে কোন দিন বীরাঙ্গনাদের একসঙ্গে গত বছরের ৬ মাসের ৮ হাজার টাকা ও ২০১৬ সালের প্রথম ২ মাসের জন্য ১০ হাজার টাকা করে সর্বমোট ৬৮ হাজার টাকা ভাতা তুলে দেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ভাতা প্রদান কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। আমরা জাতির এ বিশেষ ব্যক্তিদের সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের মতো আজ পর্যন্ত সরকার ঘোষিত পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করব। এছাড়া বীরাঙ্গনাদের মাঝে অতি দুস্থদের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিচ্ছি।
×