ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচ নারী বৈমানিক সমানে লড়ছেন পুরুষের সঙ্গে

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৮ মার্চ ২০১৬

পাঁচ নারী বৈমানিক সমানে লড়ছেন পুরুষের সঙ্গে

আজাদ সুলায়মান ॥ সাদিয়া আহমেদ, ফারিহা তাবাসসুম, জহুরা মাহজাবিন মন্দিরা, তাসনুবা ওয়াদুদ নিলমী ও গুলসেতাইন আহমেদ। তারা বৈমানিক। আকাশ যাত্রায় সাহসিক জীবন তাদের। প্রতিটি দিন-প্রতিটি মুহূর্ত কাটে নতুন অভিজ্ঞতায়। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শিহরণ জাগানো অভিজ্ঞতায় ভরপুর তাদের কর্মজীবন। তারা লড়ছেন আজ পুরুষের সঙ্গে সমানতালে। কে পুরুষ, কে নারী এ প্রশ্ন এখন তাদের কাছে মুখ্য নয়। লিঙ্গ বৈষম্যের প্রশ্ন তাদের কাছে হাস্যকর। তাদের ভাষায়, ‘মেধা, বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতাই বৈমানিকের যোগ্যতা। এ যোগ্যতা আছে তিনিই টিকবেন এ পেশায়। যোগ্যতা শুধু আকাশে উড়ার নয়-টিকে থাকারও।’ তারা পাঁচজনেই বললেন, ‘এখনও বাঙালী তরুণীদের কাছে বৈমানিক পেশা নির্ভরযোগ্য হতে পারেনি। দূরের নয়-পাশের ভারতের প্রতিটি এয়ারলাইন্সে যে হারে নারী বৈমানিক রয়েছে, তার তুলনায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। সরকারী-বেসরকারী এয়ারলাইন্সগুলোতে নারী বৈমানিকের সংখ্যা এখনও হাতেগোনা ক’জন। কত তাদের সংখ্যা ॥ গোটা দশেকও তো নয়। জাতীয় এয়ারলাইন্স বিমানে হাতেগোনা চারজন, আর বেসরকারী রিজেন্ট এয়ারলাইন্সে ৫ জন। এই তো এ সেক্টরে নারী বৈমানিকের অবস্থান। এত দৈন্যদশার মাঝে তারা পাঁচজন সত্যিই সৌভাগ্যবান। রিজেন্ট তাদের সে সুযোগ করে দিয়েছে। রিজেন্ট এয়ারওয়েজের বোয়িং ৭৩৭ এর ফার্স্ট অফিসার সাদিয়া আহমেদের ভাষায়, ‘প্রচ- ঝুঁকি জেনেও একজন তরুণী শৈশব থেকেই স্বপ্ন দেখে আকাশে উড়ার। বিমান চালানোর। এটাকে পেশা হিসেবে নেয়ার। লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে সব প্রশিক্ষণ শেষে, প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে যখন সমস্ত যোগ্যতা অর্জন করে, তখনও তার চাকরি অনিশ্চিত থেকে যায়। চাকরির জন্য ধরনা দিতে হয়। চাকরির ক্ষেত্রই বা কোথায়? বাংলাদেশ বিমানই যেন একমাত্র চাকরির জায়গা। অথচ এখানে বেশ কয়েকটা বেসরকারী এয়ারলাইন্স রয়েছে। থাকলেও সেখানে দরখাস্ত করারই সুযোগ নেই। নারী বৈমানিকের নাম শুনলেই ভ্রুক্ষেপ। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নজির গড়েছে রিজেন্ট। বেসরকারী এয়ারলাইন্সের মধ্যে তারাই প্রথম নারী বৈমানিক বা পাইলটদের সুযোগ করে দিয়েছে। মূল্যায়ন করেছে। সাদিয়া বললেন, এদিক থেকে আমরা ভাগ্যবান। রিজেন্ট আমাদের ঠাঁই দিয়েছে। যথাযোগ্য মর্যাদায় কাজের সুযোগ দিয়েছে। এখানে আমাদের মতো পাঁচজন নারী বৈমানিকের সহবস্থানই তো বলে দেয়- এখানকার প্লাটফর্মটা কতটা নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ। ফারিহা তাবাসসুম আরও এক ধাপ এগিয়ে বললেন, ‘জাতি হিসেবে আমরা অনেক এগিয়ে। তারপরও এখনও বিভাজন করা হয় লিঙ্গ বৈষম্য দিয়ে। কর্মক্ষেত্রে কয়জন নারী, কয়জন পুরুষ এখনও এমন প্রশ্ন। এটা বিব্রতকর লাগে। তিনি উদারহরণ টেনে বলেন, ‘আমাদের যখন অসুখ হয়, তখন আমরা ভাল ডাক্তারের আশ্রয় নেই। ডাক্তার নারী না পুরুষ সেটা তখন খুঁজি না। খুঁজি ভাল চিকিৎসা কে কতটা করতে পারেন। চিকিৎসার বেলায় তো এমন প্রশ্ন বা বৈষম্য টানা হয় না। তাহলে বৈমানিকে বেলায় কেন তা হবে? রিজেন্ট এখানে সত্যিই ব্যতিক্রম। তারা আমাদের মূল্যায়ন করছেন মেধা, সাহসিকতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে। কে কতটা সাহসিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে পেশাদারিত্বের পরিচয় দিতে পারছে, সে বিবেচনাতেই মূল্যায়ন করছে। রিজেন্ট আরও নারী বৈমানিকের কাজের সুযোগ করে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। এটা অন্যদের জন্যও অনুসরণযোগ্য। সাদিয়া আহমেদ বললেন, থাইল্যান্ড সিঙ্গাপুর বা অন্যান্য দেশের তুলনা বাদ দেন। এখনও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে নারী বৈমানিকের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। ভারতের প্রতিটি ফ্লাইটের ককপিটে একজন করে নারীকণ্ঠ শোনা যায়। তার বিপরীতে এখানকার চিত্র তো খুবই হতাশার। ৮ মার্চ নারী দিবস নিয়ে তো অনেক কথা শোনা যায়, নারী এগিয়েছে অনেক ক্ষেত্রে তেমন পরিসংখ্যানও কম নয়। অথচ নারী পিছিয়ে রয়েছে এমন সেক্টরের অন্যতম হচ্ছে এভিয়েশন। জহুরা মাহজাবিন মন্দিরা বললেন, এ পেশার প্রতিটি মুহূর্ত চ্যালেঞ্জিং। এটা জেনেই তো এসেছি। যারা আসছে তারাও জেনেই আসছে। ফ্লাইট নিয়ে আকাশে ওড়ার পর থেকে অবতরণ পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তই নতুন নতুন অভিজ্ঞতার। নতুন নতুন শেখনী। পঁচিশ হাজার ফুট ওপরে ওঠার পর, আকাশে দুটো মেঘের মাঝখান দিয়ে নিরাপদ দিগন্তে উড়োজাহাজটি বের করে নিয়ে যাওয়াটা, যেমন চ্যালেঞ্জের, তেমনই উপভোগের। ককপিটে বসে সে দৃশ্য দেখা ও উপভোগ মজাটাও আলাদা। তখনকার যে শিহরণ জাগানো অনুভূতি সেটা কেবল বৈমানিকেরই। আর কোন পেশায়? তাসনুমা ওয়াদুদ নিলমী কণ্ঠে শোনা গেল আরও রোমাঞ্চকর বর্ণনা। ‘বাসা থেকে বের হওয়া থেকে ফেরা পর্যন্তই প্রতিটি মুহূর্ত থাকে নানা অজানা শঙ্কার। মধ্যাকাশের ঝড়ের মাঝে পড়েও কঠিন মনোবল আর দক্ষতার বলে উড়োজাহাজ চালানোর পর নিরাপদে ঘরে ফেরার পরই বোঝা যায় এটা কেমন পেশা। তবুও আকাশ থেকে ফিরে ঘরে এসে এই বৈমানিককে পালন করতে হয়- একজন মমতাময়ী মা, প্রিয়তম স্ত্রী কিংবা সুগৃহিণীর। এসব দায়িত্ব নিয়েই তো হয়ে একজন বৈমানিকের সফলতা। গুলসেতাইন আহমদও তার কর্ম অভিজ্ঞতা নিয়ে গর্বিত। তিনি নিজেকে নারীত্বের মাঝে সংজ্ঞায়িত করতে চান না। সাহসিকতার সঙ্গে মুক্ত বিহঙ্গের মতো আকাশে বিচরণ করতে পারাটাই তার কাছে জীবনের সফলতা বলে বিবেচিত। এমনটি জেনেই তো এ পেশায় আসা।
×