ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সোনালি আঁশে মাতোয়ারা বাহারি পাটপণ্যের মেলা

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৮ মার্চ ২০১৬

সোনালি আঁশে মাতোয়ারা বাহারি পাটপণ্যের মেলা

কাওসার রহমান ॥ বাহারি পাটপণ্যের পশরা বসেছে বহুমুখী পাটপণ্য মেলায়। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের প্রবেশপথ পার হলেই রকমারি পাট দিয়ে মনোরমভাবে সাজানো একটি ঘর। সেখানে রয়েছে পাটের সোফা। সোফার সামনে টি-টেবিলে সাজানো নানা রকম পাটের তৈরি খেলনা। রয়েছে পাটে ঘেরা ঝাড়বাতি। ঘর আলোকিত করেছে পাটের ল্যাম্পশেডও। পাশেই পাটের তৈরি ডাইনিং টেবিল। টেবিলের পাশে ঝুলছে পাটের জ্যাকেটও। যেন সোনালি আঁশে বন্দী নান্দনিক এক ঘর। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রবেশ কররেই সোনালি আঁশের মোহমায়া আপনাকে মোহনীয় করে তুলবে। পাট দিয়ে এতো টেকসই, দৃষ্টিনন্দন পণ্য তৈরি সম্ভব! কি নেই পাট মেলায়? পাটের তৈরি শাড়ি, স্যুট, সোফা, জামা, জুতা, বিছানার চাদর, ফুলদানি, ব্যাগ, মেয়েদের পার্স, কুশন, খাট, দেয়ালের চিত্রকর্ম, ভেড়া, হরিণ, কচ্ছপ, ঘোড়া, আরও কত কি? সেই পাট পণ্যের সঙ্গে পরিচিত হতেই সোমবার বহুমুখী পাটপণ্য মেলায় ভিড় জমিয়েছেন নগরবাসী। মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি স্টলেই রয়েছে ক্রেতা-দর্শনার্থীর ভিড়। বাহারি সব রং আর ডিজাইনের তাক লাগানো পাটপণ্য দিয়ে সাজানো মেলার প্রতিটি স্টল। স্টল ঘুরে ঘুরে পাটের তৈরি জিনিসপত্র দেখছেন দর্শনার্থীরা। সেইসঙ্গে পছন্দের পণ্যটি সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছেন। মেলার প্রধান ফটক পার হয়ে সোনালি আঁশ লিমিটেডের স্টলেও পাটের সোফা, বেডশীট, কুশন, মেঝেতে শতরঞ্জি, জানালার পর্দা ও জ্যাকেট শোভা পাচ্ছে। একটি পুরো ঘর পাটের পণ্যে কতটা মনোরম দেখাতে পারে সেটাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এ স্টলে। তবে এসব পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। এগুলো ইউরোপ ও আমেরিকায় রফতানি করা হয়। স্টলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারি বলেন, ‘জ্যাকেট, সোফা ও বেডশীটসহ অন্যান্য পণ্য আমরা দেশের বাইরে বিক্রি করে থাকি। সাধারণত ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে বিক্রি করা হয়।’ পাটের তৈরি লাঞ্চ ব্যাগ, শপিং ব্যাগ, লেডিস ব্যাগ, ট্রাভেল ব্যাগ, লেডিস পাউসসহ বাহারি ডিজাইনের ব্যাগ নিয়ে মেলায় হাজির হয়েছে পাটপণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান নেচারটেক। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী বোরহান উদ্দিন জানান, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (বিসিক) থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ছোট পরিসরে ব্যবসা শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে ব্যবসার পরিধি বেড়েছে। প্রথমবারের মতো কোন মেলায় তিনি অংশ নিচ্ছেন। মেলায় বিক্রিও হচ্ছে ভালই। সেইসঙ্গে তিনি বেশকিছু পণ্যের অর্ডারও পেয়েছেন। নানা ধরনের পাট পণ্যের পশরায় সেজেছে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্টল। পাটের তৈরি ঢেউটিন, পাটের পাতার পানীয়, পাটের তৈরি ব্যাগ, কাপড়সহ ওই স্টলে রয়েছে নানা পণ্য। পাটের শাড়ি, টেবিল ম্যাট, শতরঞ্জি, বাস্কেট, ল্যাপটপ ব্যাগ, জুতা, গিফট আইটেমসহ প্রায় চারশ’ রকমের পাটজাত পণ্য প্রস্তুত ও বাজারজাত করছে জারমাটজ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইসমাত জেরিন খান বলেন, আমরা নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করি। জার্মানি, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে আমাদের পণ্য রফতানি হয়। এ ধরনের মেলা পাট শিল্পের সোনালি যুগ ফিরিয়ে আনবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। মেলার প্রবেশ মুখে রয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পাটের তৈরি বিশাল চিত্রকর্ম। মেলার ভেতরেও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পাটের তৈরি চিত্রকর্ম রয়েছে। মেলায় প্রবেশের পরই হাতের ডানে রয়েছে সোফা সেট, টি টেবিল, ফুলদানি, কুশন। আর বাঁয়ে কিছু শো’ পিস, ব্যাগ, দোলনা, ল্যাম্প স্ট্যান্ড। একটি দাবার কোট সাজানো আছে। এর মধ্যে মনে হয় একটি জীবন্ত ভেড়াও বসে আছে। আর এর সবই পাটের তৈরি। মেলায় সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে ব্যাগ। একেকটি ব্যাগের দাম কয়েকশ’ টাকা থেকে কয়েক হাজার টাকা পর্যন্ত। আরেকটু এগোলে হাতের বাঁয়ে চোখে পড়বে একটি দেয়াল ঘড়ি। কাঠ আর পাট দিয়ে তৈরি এ ঘড়ি। এরপর একটি সাজানো গোছানো কক্ষের মতো চোখে পড়বে। এখানে আছে পাটের তৈরি জুতার তাক, বিছানার চাদর, বালিশের কভার। সামনে এগোলে হাতের ডানে চোখে পড়বে একজন নারী পাটের তৈরি শাড়ি আর একজন পুরুষ পাটের তৈরি স্যুট পরে হ্যাট মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন। এরপর হাতের বাঁয়ে বিভিন্ন সামগ্রীর সঙ্গে চোখে পড়বে পাটের তৈরি কচ্ছপ, ঘোড়া। পাটের তৈরি ছোট গাছ। আরেকটু এগোলেই চোখে পড়বে পাটের ব্যাগে ফুলের টব, পাটের তৈরি দৃষ্টি নন্দন ব্যাগ, জুতা। পাটের তৈরি জুতা শুধু দেশে নয় বিদেশেও রফতানি হয়। এগুলোর দাম ২০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা। সোনালি আঁশ ইন্ডাস্ট্রির ইকবাল হোসেন জানান, রফতানি হওয়া এসব জুতার দাম ৫ ডলার থেকে ৩৫ ডলার পর্যন্ত। নানা ধরনের ব্যাগ, টি টেবিলসহ ঘরোয়া বিভিন্ন তৈজসপত্রের পাশাপাশি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী আইটেম পাটের তৈরি সম্পূর্ণ একটা খাট নিয়ে এসেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাজশাহী নঙ্ঘির। ছোট বড় দুই ধরনের খাট রয়েছে এখানে। দামও খুব বেশি নয়, ৫ হাজার টাকার মধ্যে। মেলায় দৃষ্টিনন্দন বিভিন্ন সামগ্রীতে চোখ জুড়িয়ে যাবে। দৃষ্টি কেড়ে নেবে পাটের তৈরি ফতুয়া, ওড়না, দরজা-জানালার পর্দার কাপড়, শো’পিস, পাপোস, পাটের কাগজ দিয়ে তৈরি কার্ড, কার্পেট, টিস্যু বক্স, ঝুড়ি, সুতা, পুতুল, ছোটদের খেলনা, দেয়ালের চিত্রকর্মসহ নানা ধরনের সামগ্রী। পাট দিয়ে তৈরি বাহারি পণ্য দেখে মুগ্ধ দর্শনার্থীরাও। দর্শনার্থীরা জানান, পাটের তৈরি পণ্য এতোটা নিখুঁত এবং সুন্দর হয়- তা আসলেই দেশের মানুষের কাছে অজানা। পাটপণ্যের যথাযথ বিজ্ঞাপন হলেই এসবের প্রতি আকর্ষণ আরও বাড়বে। শুধু পরিবেশ প্রেমিকরাই নয়, গুণগত মান ও নান্দনিক সৌন্দর্যের কারণে দেশী-বিদেশী যে কারও মন কাড়বে এসব পণ্য। বাহারি জিনিসের পাশাপাশি হাজারও নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে পাট। তাদের মধ্যে অন্যতম গোল্ডেন রূপ এবং ইয়ং উইমেনস খ্রীস্টান এ্যাসোসিয়েশন। ২০১৪ সালে নিজেই গোল্ডেন রূপ নামের প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু করেন মোবাশ্বেরা রহমতুল্লা। এখন প্রায় শতাধিক নারী কর্মসংস্থান খুঁজে পেয়েছে তার গোল্ডেন রূপে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বসেছে তিন দিনব্যাপী বহুমুখী পাটজাত পণ্যের এ মেলা। রবিবার মেলার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত চলবে এ মেলা।
×