ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ৮ মার্চ ২০১৬

ঢাকার দিনরাত

আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারী দিবস কি শুধুই নারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ? তা নয়, বরং নারীর সমান্তরালে নারীভুবন সম্বন্ধে পুরুষদের সচেতনতার একটি সুযোগ নিয়ে আসে এই নারী দিবস। নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণ কেমন তার ওপরেও নির্ভর করে নারী দিবসের সার্থকতা ও বিফলতা। নারী-পুরুষের স্বাভাবিক সহাবস্থান, সমানাধিকার এবং সমমর্যাদার বিপক্ষে অবস্থান করতে পারে পুরুষের পাশাপাশি নারীও। একথা নারীবাদীরা হয়ত মানবেন না। তারা সব কিছুর পেছনেই দায়ী করেন পুরুষতন্ত্রকে। পরিবারে নানা অবস্থানে অবস্থানকারী নারীদের ভেতর (বউ-শাশুড়ি-কন্যা-ননদ) সম্পর্কের দ্বান্দ্বিকতার নেপথ্যে পুরুষতন্ত্র ও অর্থনীতি ক্রিয়াশীল থাকে- এটা অমান্যের কিছু নেই। কিন্তু কট্টর নারীবাদীরা কিছুতেই মানতে নারাজ যে নারীরও মানসিক উন্নতি ও সহৃদয়তা জরুরী পারিবারিক সম্পর্কগুলো সুশোভন রাখার প্রয়োজনে। যাহোক, নারী দিবসে ঢাকার নারী সমাজ নিয়ে দুএকটা কথা বলার জন্যই এই গৌরচন্দ্রিকা। সাধারণভাবে ঢাকার বহিরঙ্গের জীবনে বা সোজা কথায় রাস্তাঘাট অফিস-আদালতে যেসব নারী আমরা দেখি তারা তো সম্পর্ক সূত্রে আমাদের তথা পুরুষের অচেনা ও পরিচিত, স্বজন ও সহকর্মীও বটে। সবচেয়ে বড় কথা তারা সহনাগরিক। একথা আমরা স্বীকার করি আর নাই করি, ঢাকার নারী সমাজ সাধারণভাবে অগ্রসর ও সপ্রতিভ। এক অর্থে তারা পুরুষের পাশাপাশিই চলেছেন। কার্যালয়ে পুরুষের সঙ্গে সহযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই কর্মপরিবেশ বজায় রাখছেন, পেশাদারিত্বের স্বাক্ষর রাখছেন। নারী-পুরষেভেদ টেনে যারা নারীর এই সমকক্ষতায় প্রতিবন্ধক হয়ে উঠছেন, সেই গুটিকতক পুরুষ যেমন নারীর প্রতিরোধের সম্মুখিন হচ্ছেন, তেমনি পুরুষ সহকর্মীদের অনেকেও প্রতিবাদ করছেন। অর্থাৎ বলতে চাইছি, নারী একদিকে সরব হচ্ছেন, অপরদিকে পুরুষদেরও মানসিকতার পরিবর্তন ঘটছে। গণপরিবহনের মহিলা আসনের উদাহরণ টানা যাক। বাসে ছ’টি বা নয়টি আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হলেও কোন নারী বাসের বাদবাকি যে কোন খালি আসনেই বসার অধিকার রাখেন- এই সহজ কথাটি বহু পুরুষই বুঝেন না। বাসে মহিলা সিট খালি থাকলে কোন মহিলা যদি সংরক্ষিত ওই আসনে না বসে সবার জন্য উন্মুক্ত অন্য যে কোন আসনে বসতে যান, তখন দু একজন পুরুষ অবশ্য আপত্তি তোলেন। সে সময় দেখেছি বাসের অন্য পুরুষ যাত্রীদের কেউ তার প্রতিবাদ করছেন। এটা অবশ্যই ইতিবাচক দিক। ঢাকার পথেঘাটে আগের তুলনায় বেশি সংখ্যক নারী দেখা যায় যারা ব্যক্তিগত গাড়ি চালাচ্ছেন। মোটরসাইকেল চালক নারীর সংখ্যা অবশ্য তেমন বাড়েনি। নারীর জন্য রাজধানীতে আর আলাদা পেশা বলে কিছু নেই। সব পেশাতেই নারী তাদের কর্মদক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ সুন্দরভাবে কাজে লাগাচ্ছেন। সেদিন একটা দৃশ্য চোখে পড়ল যা আগে কালেভদ্রে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কিছু জনবিরল অংশে দেখা যেত। সেটি হলো তরুণীদের ধূমপান। ধূমপান অবশ্যই একটি মন্দ অভ্যাস। তবে পুরুষদের বেলায় এখনও এটিকে ‘ম্যানলি’ হিসেবে দেখার প্রবণতা রয়েছে। অথচ একই কাজ মেয়েরা করলে তাকে নিন্দামন্দ করার লোকের অভাব নেই। এখন অনেক তরুণী প্রকাশ্যেই ধূমপান করছেন তাদের পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে। আগে এটা আড়ালে আবডালে চলত। তার মানে হচ্ছে আজকের তরুণী ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ এমন মানসিকতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে শুরু করেছেন। পাশাপাশি পুরুষ যা করছে সেসব কাজ করাকে নিজের অধিকার বলেও ভাবছেন। ধূমপানের বেলায় নয়, সর্বক্ষেত্রেই যদি এটা তারা ভাবেন এবং প্রথা ভাংতে সমর্থ হন তাহলে এক ধাক্কায় নারী অনেকটা এগিয়ে যাবে বলে আমার ধারণা। অনেক পরিবারে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরা একটু রাত করে ঘরে ফিরলে সেটা স্বাভাবিকভাবেই দেখা হচ্ছে। ঢাকায় ইভটিজিং বহুলাংশে কমেছে। পথেঘাটে নারীর চলাচল শতভাগ নিরাপদ হয়েছে এমন দাবি করব না, তবে অবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। ফাইনাল খেলার টিকেট! সোনার হরিণ হয়ে উঠেছিল এশিয়া কাপ ক্রিকেট ফাইনালের টিকেট। সেটাই স্বাভাবিক। দেশের ষোল কোটি মানুষ না হোক, ষোল লাখ মানুষ যে খেলাটি দেখতে চাইবে এমন অনুমানের পেছনে কু-যুক্তি নেই। বাংলার বাঘেরা স্বাধীনতার মাস মার্চের শুরুতে পাকিস্তানী ক্রিকেটারদের নাস্তানাবুদ করে বিজয় ছিনিয়ে এনে ফাইনালে পৌঁছে গেছে- এটি ছিল অভূতপূর্ব আনন্দ সংবাদ। এই প্রথম বাংলাদেশ টিম টি টোয়েন্টি কোন টুর্নামেন্টের ফাইনালে গেল। প্রতিপক্ষ শক্তিশালী টিম ভারত। এই ভারতকেও তো কয়েক দফা হারিয়েছে বাংলাদেশে। গত বিশ্বকাপে আম্পায়ারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের ফলস্বরূপ ভারতের কাছে হেরে গিয়েছিল বাংলাদেশ। পরে দেশের মাটিতে পেয়ে তার মধুর প্রতিশোধও নিয়েছিল টাইগাররা ভারতকে দারুণভাবে হারিয়ে। ফলে রবিবার রাতের ফাইনালে ভারত হারতেও পারে- এমন আশা দেশের কোটি ক্রিকেটভক্তের। এমন একটি খেলায় স্টেডিয়ামের আসন সংখ্যা মাত্র ২৫ হাজার। তাই টিকেট নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়বেই- এটা জানা কথা। অজানা ছিল এই টিকেট কেনাকে ঘিরে ক্রিকেটপ্রেমীদের সঙ্গে পুলিশের হাঙ্গামা হবে। রীতিমতো তুলকালাম কা-ই ঘটে গেছে টিকেট নিয়ে। সোজা পথে টিকেট না মিললেও কালোবাজারে টিকেট বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে সামাজিক যোাগযোগ মাধ্যম সরব। এক ক্রিকেট দর্শক ফেসবুকে রবিবার সকালেই স্ট্যাটাস লিখলেন- ‘১৫০ টাকার টিকেট কাউন্টারে নাই, ব্ল্যাকারের কাছে আছে। বিক্রি হচ্ছে ৫০০০ টাকায়। অসৎ সম্প্রদায়ের হাতে পড়ে এইভাবে আমাদের দেশপ্রেম বিক্রি হয় আর ভূলুন্ঠিত হয়।’ এ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য আসতে শুরু হলে পরে দুপুরের দিকে তিনি ফের জবাবে লিখলেন- ‘...বিশ্বকাপের টিকেটও তো ঢাকায় বসে কেনা যায়। ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলি। আইডিকার্ডের নাম্বার দিয়া টিকেট ইস্যু হবে, অন লাইনে। টাকা পরিশোধ হবে বিকাশ/ক্রেডিট কার্ডে। ২৬ হাজার লোকের কাছে টিকেট পৌঁছে যাবে। বাকিরা ঘরে বসে দেখবে। টিকেটের দাম ১৫০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করলে সরকার কিছু পেত, মানুষের ভোগান্তি থাকত না। এখন টিকেটের দামটাই শুধু বাড়ছে। কয়েক স্তরের দালালের হাত ঘুরে ১৫০ টাকার টিকেট ৫০০০ হচ্ছে। ওদের দালালিটা বন্ধ হতো। সরকার এটা করছে না, কারণ এই চক্রের সঙ্গে সরকারের বা ব্যাংকের কিছু লোক আছে, তারাও চরম ‘ দেশপ্রেমী’, ক্রিকেটপ্রেমী।’ তবে সুযোগ বুঝে লোভী অসৎ কিছু ব্যক্তি টিকেট জাল করায় নেমে পড়লেন। টিকেট কেনার সময় তাই সতর্ক থাকার কথা উঠেছে। কয়েক গুণ বেশি দাম দিয়ে কিনেও যদি সেই টিকেটে মাঠে ঢুকতে না পারেন, সেটি আরও বড় কষ্টের। আসল টিকেটে লেখা ?থাকবে না ম্যাচটি ভারত বনাম বাংলাদেশ। কারণ টিকেটটি যখন ছাপা হয়, তখনও ফাইনালের দুটি দল চূড়ান্ত হয়নি। কিন্তু জাল টিকেট ছাপা হয়েছে অনেক পরে। ছাপার সময় আরও বিশ্বাসযোগ্যতা আনতে তাই সেখানে লেখা আছে ‘বাংলাদেশ বনাম ইন্ডিয়া গ্র্যান্ড ফাইনাল’। জন্মেই গোরস্তানে! গত সপ্তাহে রাজধানীর ভাটারায় একটি পারিবারিক গোরস্তান থেকে এক নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। লাশটি একটি গেঞ্জি দিয়ে মোড়ানো ছিল। নবজাতকটির হাত, নাক ও মুখের মাংস কুকুর বা অন্য কোন প্রাণীর পেটে গেছে। স্থানীয় পুলিশের ধারণা মধ্যরাতে নবজাতকটিকে গেঞ্জিতে পেঁচিয়ে কবরস্থানে ফেলে যাওয়া হয়। এই নিষ্ঠুর রাজধানীতে কিছুকাল পরপরই আমরা এমন নবজাতক হত্যার খবর শুনি। কয়েক মাস আগে মানিক মিয়া এ্যাভিনিউ এলাকার ন্যাম ভবনের ৩ নম্বর গেটসংলগ্ন নর্দমার পাশ থেকে নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। সদ্য জন্মগ্রহণের চিহ্নসহ লাশটি ছিল একটি কাগজের কার্টনে। শিশুটি পৃথিবীতে কি মৃত হিসেবেই এসেছিল, নাকি জন্মের পর মারা গেছে? মারা গেছে, নাকি মেরে ফেলা হয়েছে! এমন আরও কিছু শ্রাব্য-অশ্রাব্য কথাবার্তা কি খুব অসঙ্গত বলে মনে হবে? তারও আগের আরেকটি নবজাতক উদ্ধারের প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। সেই পরিত্যক্ত নবজাতক অবশ্য এক অর্থে ভাগ্যবান। বস্তার ভেতর থেকে বের করে কুকুরের দল শিশুটির ঠোঁট, নাক ও বাম হাতের দুটি আঙ্গুলের ডগা থেকে খানিকটা অংশ খেয়ে ফেললেও মারা যায়নি সে। ১৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পূর্ব শেওড়াপাড়ার পুরনো বিমানবন্দরসংলগ্ন রানওয়ে মাঠে চার-পাঁচটি কুকুরের সামনে থেকে ওই নবজাতককে উদ্ধার করা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্সদের আন্তরিক শুশ্রƒষায় সেরে ওঠে শিশুটি, তার নাম রাখা হয়েছে ফাইজা। পরে তার নতুন ঠিকানা হয় সমাজসেবা অধিদফতরের ‘ছোটমনি নিবাসে’। প্রতিটি নতুন শিশুর জন্মগ্রহণের নেপথ্যে রয়েছে এক জোড়া মানব-মানবী। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক, তারা জনক-জননী। অথচ তাদের অনেকেই তাদের সন্তানের জন্মক্ষণেই পরিত্যাগ করেন, তার মৃত্যুই চান! নিজেদের রক্ষার জন্য নিজ সন্তানের মৃত্যু! কিসের রক্ষা? লোকলজ্জার ভয় থেকে? এই পৃথিবীতে যত প্রজাতির প্রাণী রয়েছে সেসবের মধ্যে একমাত্র মানুষের পক্ষেই সম্ভব সদ্যজাত সন্তানকে মৃত্যুপুরিতে নিক্ষেপ করা। একটি হায়েনা কিংবা একটি কুকুর বা কোন শকুন কি কখনও তার সদ্য জন্মগ্রহণকারী শাবকটিকে ছুড়ে ফেলে! ঢাকায় নর্দমায় বা গোরস্তানে নবজাতককে ফেলে দেয়ার বিষয়টিকে আমরা উপেক্ষা করে যেতে পারি না। এটি স্বার্থপর মানুষের এক অজ্ঞাত মানসিক অবস্থা, তার চূড়ান্ত বিকার। এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কী হতে পারে! যে নগরে বা যে সমাজে মানুষ তার সদ্য জন্ম নেয়া সন্তানকে অস্বীকার ও নোংরা ন্যাকড়ার মতো পরিত্যাগ করতে পারছে, সেই নগর বা সমাজেরও কি কোন দায়ভাগ নেই এতে? কালক্রমে সদ্যমৃতের তালিকায় উঠে যাচ্ছে মানুষের বিবেক, তার মনুষ্যত্ব। সর্বশেষ রবিবার সন্ধ্যায় ঢাকায় হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি শুরু হলে বাংলাদেশ-ভারত ফাইনাল ম্যাচটি অনিশ্চয়তায় পড়ে যায়। বৃষ্টি থামার পর দেরিতে হলেও খেলা শুরু হয়। মাঠ দেখে মনেই হয়নি খানিক আগেই এমন ঝড়-বৃষ্টির কবলে পড়েছিল মীরপুর স্টেডিয়াম। যেমন পিচ, তেমন আউটফিল্ড। মাঠকর্মীদের এই দারুণ কাজের অকৃপণ প্রশংসা করি। ৬ মার্চ ২০১৬ [email protected]
×