ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জুবাইদা গুলশান আরা হেনা

জেগে ওঠো নারী ॥ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ভাবনা

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ৮ মার্চ ২০১৬

জেগে ওঠো নারী ॥ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ভাবনা

৮ মার্চ, ১৮৫৭ সাল। মজুরি বৈষম্য, কর্মসময় নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় নেমেছিলেন। সেই ঐতিহাসিক সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণা করে জাতিসংঘ। ২০১৬ সালে আমরা যদি একটু হিসেব করি- নারী এগিয়েছে, কিন্তু কত দূর! ওয়াসফিয়া নাজরীন এবং নিশাত মজুমদারের এভারেস্ট জয়, সম্প্রতি ব্রিটেনে নির্বাচনে তিন বাঙালী নারী টিউলিপ সিদ্দিকী, রূপা হক আর রুশনারা আলী জয়লাভ করে বাঙালী নারীদের প্রত্যাশার জায়গাটা আরও ওপরে নিয়েছেন। সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, মিডিয়া, খেলাধুলাসহ প্রশাসনিক কর্মকা-ে নারী আজ উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত। দেশের বিরোধী দলের নেত্রী, স্পীকার এবং প্রধানমন্ত্রীর মতো সর্বোচ্চ সম্মানিত আসনে অধিষ্ঠিত নারী। তারা আমাদের পথ দেখিয়েছেন। কিন্তু যেতে হবে অনেক দূর। নারীদের পথ চলা কি অবস্থায় আছে? সকল ক্ষেত্রে নারীর সুযোগ রয়েছে। তাকে রাজনীতি করতে হবে এমন নয়। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, প্রশাসক, পাইলট, সামরিক, বেসামরিক সকল দায়িত্বপূর্ণ কাজের সর্ব শিখরে থাকতেই হবে এমন নয়। নারীকে সকল কাজে অংশগ্রহণ করতে হবে। একাডেমিক যোগ্যতা সবার সমান থাকে না। তাই বলে বসে থাকলে চলবে না। এর বাইরে অনেক কাজ আছে। ক্ষুদ্র ব্যবসা, জামা-কাপড় বানানো, বুটিক শপ, হাতের ফুল তৈরি, বিউটি পার্লার, ফুলের টব, নক্সীকাঁথা ছাড়াও বিভিন্ন রকমের হাতের কাজ নারীরা করতে পারেন। আমি বিশ্বাস করি বাঙালী অনেক মেধাবী। তারা কর্মকা-ে পৃথিবীব্যাপী তাদের অসাধারণ মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। একাডেমিক দিকে নারীরা পরীক্ষায় অনেক ভাল ফলাফল করে থাকেন। কিন্তু তাদের অনেকেই কর্মজীবনে আসতে আগ্রহী নয়। কিছু ভ্রান্ত ধারণাও অনেকের মাঝে কাজ করে। অফিস আদালতে কাজের পরিবেশের ব্যাপারে দক্ষ নারী অবশ্যই তার কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করে নিতে পারেন। নারীদের চলাফেরায় একটা অন্তরায় আগেও ছিল, বর্তমানে অনেকটা কম হলেও আছে। নারী পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ, কর্মজীবন প্রতিটি জায়গায় নিরাপত্তায় ভোগে। নারী নিরাপত্তার বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত করতে অনেক বছর অপেক্ষা করতে হবে। ইউরোপ, আমেরিকা ছাড়াও উন্নত বিশ্বের মতো যখন মানুষ সুশিক্ষিত হবে তখনই এদেশের নারীরা সম্পূর্ণ নিরাপত্তা পাবেন। এতদিন নিশ্চয়ই নারীরা অপেক্ষা করবেন না। অনেক নারী আছেন তারা স্বর্ণলতার মতো। গ্রামে অনেকেই স্বর্ণলতা দেখেছেন। অন্য গাছের ডালে ডালে পাতায় পাতায় বেয়ে চলে। মাটির সঙ্গে কোন সংস্পর্শ নেই। কেউ এসে যে কোন সময় আগাছার মতো এদের পরিষ্কার করে ফেলে। আমি নারীদের শেকড় চাই। পরিবার থেকে হয়তো বলতে পারে বাইরে কাজের পরিবেশ নেই। কিন্তু না! নারী তুমি বের হও। নারী তুমি কনসার্টে যাও, স্টেডিয়ামে যাও কই তখন তো তোমার নিরাপত্তা বিঘিœত হয় না। অনেক মেয়েরই ধারণা পড়াশোনা করেছি তাই বলে চাকরি করতে হবে কেন? বাবার প্রচুর অর্থ সম্পদ আছে। শিক্ষিত বিত্তশালী ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে হবে নিশ্চয়ই। চাকরি করার দরকার নেই ভাল কথা, সেক্ষেত্রে একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে অনেক লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যেতে পারে। আমার পরিচিত অনেক নারীকে দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে শুধুমাত্র গৃহবধূই তার পরিচয়। অনুষ্ঠানে তারা ডিসি আন্টি, ওসি আন্টি, ইঞ্জিনিয়ার আন্টি, ডাক্তার আন্টি হিসেবে পরিচিত। ওই বিশেষণগুলো তাদের নয়, তাদের স্বামী ব্যক্তির। বাবা-মার দেয়া তার সুন্দর নামটিও এক সময় সমাজ থেকে হারিয়ে যায়। জীবনের মূল্যবান সময়গুলো কাটান রান্নাঘরে। সারা মাস অপেক্ষা করেন কোনদিন স্বামী বেচারা বলবেন রান্নাটি চমৎকার হয়েছে সেই দিনের জন্য। ঈদ, জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকীতে স্বামী সুন্দর সুন্দর শাড়ি উপহার দেন। আনন্দ করে তারই মতো গৃহিণীদের দেখিয়ে একটা অসাধারণ তৃপ্তি পান। আমার মা, আমি এবং আমার সন্তান এই তিন প্রজন্মকে তুলনা করলে খুব পরিবর্তন কিছু দেখি না। জনসংখ্যা বেড়েছে, নারীর কর্মসংস্থানও বেড়েছে। আসলে আনুপাতিক হারে কতটা বেড়েছে? নারীকে বুঝতে হবে তার অনেক কিছু করার সম্ভাবনা ও দক্ষতা আছে এবং তাকেই সেই কাজটি করতে হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীদের অনেক সুযোগ রয়েছে। পুরুষ অভিভাবকটি যে বাধার সৃষ্টি করবেন না তাতো নয়। কারণ সমাজ তো পুরুষশাসিত। অনেক পুরাতন কথা হচ্ছে, নারীর একজন পুরুষ অভিভাবক থাকতেই হবে। ছোটবেলায় বাবা, যৌবনে স্বামী, স্বামীর মৃত্যুর পরে নিজের ছেলে, আর নিজের ছেলে না থাকলে ভাসুরের ছেলে পর্যন্ত অভিভাবক হবে। এই জায়গা থেকে বের হয়ে আসার একটাই পথ হচ্ছে অর্থনেতিক মুক্তি। আর তার জন্য দরকার ব্যাপক সচেতনতা। যা শুধু সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। সরকারী, বেসরকারী, স্বায়ত্তশাসিত, সর্বোপরি স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচিত নারী জাতিকে অধিকার সচেতন করে তোলা। নারীর কাজের ক্ষেত্র ব্যাপক। ঘরে বসে শুধু রান্না করা আর স্বামীর অফিসের টিফিন বাটি সাজানোর জন্য নারীর জন্ম হয়নি। চিন্তা, চেতনা, বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা পুরুষের চেয়ে নারীর কম নয় বরং বেশি বলা যেত পারে। কর্মজীবনে না ঢুকে বিদেশী হিন্দি সিরিয়াল দেখে নিজের মধ্যে হিংসা বিদ্বেষ জন্মায়। যেটা পরবর্তী সময় পারিবারিক কলহের সৃষ্টি করে। সংসারে অশান্তির সৃষ্টি হয়। তাছাড়াও ঘরের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পরও পরিবারের সবার কাছে স্বীকৃতি পাওয়া যায় না। বরং কতটুকু দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয়নি তার সমালোচনা হয়। অনেক নারীই খুব গর্বভরে প্রচার করে থাকেন বিয়ের পরে স্বামী-সন্তানের জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। পাশাপাশি এটা বলেন না ছুটির দিন ছাড়া স্বামীর অফিসের জন্য হটপট সাজানো আর স্বামীকে অফিসে যাওয়ার জন্য গুছিয়ে দেয়াই আমার কাজ। এমন হতে পারত দু’জনেই চাকরি করেন। ঘরের কাজে পরস্পরকে সাহায্য করেন। তাতে করে স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন সুদৃঢ় হয় এবং অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যে পরিবারকে অনেকদূর এগিয়ে নেয়া যায়। সঠিক পরিসংখ্যান আমার জানা নেই তবে হৃদরোগে নারীদের চেয়ে পুরুষরা অনেক বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। কারণ বেশিরভাগ পরিবারে সংসারের সকল বোঝা পুরুষের ওপরে থাকে। একজন দক্ষ নারী অবশ্যই সংসারের অর্ধেক বোঝা বহন করতে পারেন। তাতে করে তার স্বামী বেচারা বাড়তি চাপের হাত থেকে বাঁচতে পারেন। এছাড়াও জীবনে দৈবাৎ কোন অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা নেমে এলে, যেমন স্বামীর অকাল মৃত্যু হলে সেই নারীর জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে যায়। একেতো নিজের জীবনের আবেগীয় অবস্থার সমাপ্তি ঘটে। এছাড়াও স্বামীর মৃত্যুর পরে শ্বশুর বাড়ির কম পরিবারই আছেন যারা দায়-দায়িত্বগুলো সম্মানের সঙ্গে পালন করেন। ভাই, বোন, ভাসুর কিংবা ননদের দয়া-দক্ষিণায় বেঁচে থাকতে হয়। ছেলে-মেয়েদের এতিমখানায় পাঠাতে হয় এমন উদাহরণও অনেক আছে আমাদের সমাজে। সেই নারীকে সাদা শাড়ি পরিয়ে রাখা হয়, যেটা দামের দিক থেকে সস্তা এবং দেখতে তাকে অসুন্দর লাগে। তাদের পরিবারের কেউ এই রমণীর দিকে মধুর দৃষ্টিতে না তাকাতে পারে। আর ওই নারী দিনে পাঁচবার আয়নার সামনে নিজেকে দেখবে যে সে বিধবা। তার পৃথিবীটায় কোন রং নেই। সাদা কোন রঙ নয়। তিনি একজন মানুষ কিন্তু তার কোন বন্ধু কিংবা শুভাকাক্সক্ষী থাকবে না যার সঙ্গে নিজের সুখ দুঃখের কথা শেয়ার করতে পারবেন। মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়া নারীদের জাগরণের গান শুনিয়েছেন। নারীদের পর্দার অন্তরাল থেকে বের করে এনেছেন শিক্ষার আলোতে। এত বছর পরে আমরা কতটুকু আলোকিত হতে পেরেছি সে হিসেবটুকু করার দায়িত্ব আমার বোনদের ওপর। আমি একা আলোকিত হলে হবে না। পুরো নারী সমাজকে আলোকিত করতে হবে। আর অবশ্যই এজন্য পুরুষের আন্তরিক সহযোগিতা, প্রেরণা, পরিবার, সমাজ এবং কর্মক্ষেত্র থেকে আসা উচিত। বিদ্রোহী কবি নজরুলের কবিতার লাইন নিয়ে শেষ করছি- “...সেদিন সুদূর নয়- যেদিন ধরণী পুরুষের সঙ্গে গাহিবে নারীর ও জয়” লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×