ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শাহজাহান মিয়া

মা হত্যাকারী হলে সন্তান নিরাপদ কোথায়?

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ৮ মার্চ ২০১৬

মা হত্যাকারী হলে সন্তান নিরাপদ কোথায়?

ওরা শিশু। কোমলমতি। নিষ্পাপ। পবিত্র। ফেরেশতার মতো। ওরা কেন পৈশাচিক হত্যার শিকার হচ্ছে তাও ওদের জানা নেই। তারপরও ওদের ওপর নির্মমতা-নৃশংসতা চলছে নানাভাবে। ভয়ঙ্কররূপে বীভৎসতা চলছে ওদের ওপর। মনে হয় আমরা একদম ভুলে যাচ্ছি শিশুরাই জাতির ভবিষ্যত। শিশু হত্যা তাই দেশের ভবিষ্যতকেই ভয়াবহ অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ওদের প্রতি সমাজের সবার দায়িত্ব রয়েছে। কর্তব্য রয়েছে। বাবা বা মায়ের পরকীয়া, পারিবারিক কলহ, বিত্ত-বৈভব, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ এবং অপহরণের পর অন্যায়ভাবে পরিবারের কাছে চাঁদা দাবি করে না পেয়ে প্রাণ হারাচ্ছে অসহায় শিশুরা। আরও নানা পাষ-তায় জীবন হারাচ্ছে নির্দোষ শিশুরা। বিকৃত আচরণের বলি হচ্ছে ওরা। প্রতিটি ঘটনাই হৃদয়বিদারক ও পৈশাচিক। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বাবা-মায়ের হিংস্্রতার কাছেই যদি ওদের প্রাণ হারাতে হয় তাহলে ওরা নিরাপদ থাকবে কোথায়! মায়ের সঙ্গে শিশুর সম্পর্ক স্বর্গীয়। আর সেই মা-ই যদি হয়ে ওঠে বুকের ধন, আদরের মানিকের সর্বনাশী হন্তারক তাহলে তো আর কোন কথাই থাকে না। রাজধানী ঢাকার বনশ্রীতে মায়ের হাতে দুই সন্তানের মৃত্যু এবং পরেরদিনই কুমিল্লায় এক শিশুর লাশ উদ্ধার মানুষের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সমাজের মানুষ কি পশুর চেয়েও অধম হয়ে গেল? কেন ঘটছে শিশু হত্যার মতো এমন ভয়াবহ ও বীভৎস ঘটনা? মানুষের ক্রোধ কি সব পড়ছে গিয়ে অসহায় নিরপরাধ শিশুদের ওপর। ওরা আজ পারিবারিক বিরোধের মর্মান্তিক শিকার হচ্ছে। নিজের নিরাপদ বাসস্থানেও যে শিশুরা নিরাপদ নয় বনশ্রীর দুই ভাই-বোনের মর্মান্তিক মৃত্যু চোখে আঙ্গুল দিয়ে সে সত্যটিই দেখিয়ে দিয়েছে। ‘সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। এ কারণে ওদের হত্যা করি।’ দুই শিশু সন্তানের হত্যার কারণ হিসেবে প্রদত্ত মাত্র এ দুটি বাক্যের বক্তব্যে এখনো অনড় ঘাতক মা মাহফুজা মালেক জেসমিন। প্রথমে র‌্যাব এবং পরে পুলিশকে একই বক্তব্য দিয়েছেন মাহফুজা। তবে তার এ বক্তব্য বিশ্বাস করার কোন যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পত্রিকার রিপোর্ট এবং বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রদর্শিত তার চেহারা দেখে বোঝা যায় তার মুখাবয়বে কি যেন লুকিয়ে আছে। সেটা কি তা বের করার প্রয়োজন আছে। পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ সে বিষয়টি নিশ্চয়ই বের করার প্রাণান্ত চেষ্টা চালাবেন। পাষাণ হৃদয় এই ঘাতক মা মাহফুজার আচার-আচরণ মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। নিজ হাতে দু’টি শিশু সন্তানকে মারার পর এতটা ভাবলেশহীন থাকে কি করে! দেশের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিকারুন্নেসা নূন স্কুলের চৌদ্দ বছরের নির্দোষ সুন্দর সুশ্রী নিজের নাড়িছেঁড়া মেয়ে অরণীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে নিশ্চিত করে পরক্ষণেই ফুলের মতো নিষ্পাপ ছয় বছরের অবুঝ ছেলেটিকে একইভাবে হত্যা করা কতটা পশুত্বে¡র প্রমাণ দেয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও ইতোমধ্যে কথা উঠেছে নিজের এক সন্তানকে হত্যা করে একই সময়ে আরেকটি সন্তানকে হত্যা করা একজন মেয়ে মানুষের পক্ষে কতটা বাস্তবসম্মত। তাই অনেকের কাছেই মা মাহফুজার বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে আরও কেউ জড়িত থাকতে পারে এই খুনের সঙ্গে, যা কৌশলে লুকানো হচ্ছে। র‌্যাব-পুলিশের কাছে প্রদত্ত মাহফুজার বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন তার ভাই জাকিরসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। তারা দাবি করেন মাহফুজা ভাল মানুষ এবং সন্তানদের বেশ ভালবাসতেন, তাই তার পক্ষে মেয়ে অরণী ও ছেলে আলভীকে হত্যা করা কোনমতেই সম্ভব নয়। অনেকেই মনে করছেন, জেসমিনের কথাবার্তা, কর্মকা- স্বাভাবিক মনে হলেও তিনি হয়ত অসুস্থ। তার নিজের অনুভূতিগুলো হয়ত কাজ করছে না। সে অনেকটাই নির্বিকার ও ভাবলেশহীন। কারণ, নিজের বুকের ধনদের খুন করে তার এমন স্বাভাবিক থাকার কথা নয়। তিনি হয়ত কোন তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন, যা তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের বের করতে হবে। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার ভাদেশ্বর ইউনিয়নে মাটি খুঁড়ে চার শিশুর লাশ উদ্ধারের পর সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পুলিশের মতে ঘটনার চারদিন আগে প্রতিবেশী পরিবারদের মধ্যে বিরাজমান পূর্ব শত্রুতার কারণে ঐ চার শিশু নির্মম হত্যার শিকার হয়। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি শনিবার কুমিল্লা শহরের রসুলপুরে আট বছর বয়সের মেহিদী হাসান জয় ও ছয় বছরের মেজবাউল হক মনি নামে দুই শিশুকে সৎ ভাই শফিউল ইসলাম ছোটন বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে। ঘটনার তিন দিন পর ১ মার্চ ঘাতক ছোটনকে রাজধানীর শান্তিনগর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত ৫ মার্চ শনিবার কিশোরগঞ্জে দা দিয়ে কুপিয়ে দেড় বছরের ছেলেকে হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে মা সালমা খাতুনকে। একই দিন মৌলভীবাজারে বিষ পান করিয়ে ছয় বছর বয়সের মেয়েকে হত্যা করার পর আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন পারভীন বেগম নামের এক মা। বর্তমানে সিলেটের ওসমানী মেডিক্যাল হাসপাতালে পুলিশ প্রহরায় পারভীন চিকিৎসাধীন আছেন। গত চার বছরে সারাদেশে এক হাজার ৮৫ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। গত দুই মাসেই দেশে ৫০ শিশু নানারকম নৃশংতায় প্রাণ হারিয়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে শিশুদের সুরক্ষায় দেশে তেমন কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেই। তারা বলছেন, শিশুদের নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংগঠনগুলোও তেমন কিছু করতে পারছে না। পুলিশ প্রশাসনেরও নেই কোন উল্লেখ করার মতো ভূমিকা। তাদের কার্যক্রমও দায়সারাগোছের। নির্মমতার হাত থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হলে বিভিন্নভাবে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়িয়ে সর্বাত্মক সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। দেশে শিশু আইন আছে। আছে শিশু অধিকার সনদ। আইন বলছে শিশুকে শারীরিকভাবে তো নয়ই, মানসিকভাবেও নির্যাতন করা যাবে না। এটা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। শিশুশ্রমের জন্যও কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু শিশু বিশেজ্ঞরা এর প্রয়োগের অভাবকেই দায়ী করছেন। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) তথ্য অনুযায়ী গত চার বছরে এক হাজার ৮৫ শিশু হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ২৯২ শিশু, ২০১৪ সালে ৩৬৬ জন, ২০১৩ সালে ২১৮ এবং ২০১২ সালে ২০৯ শিশু খুন হয়েছে। গত চার বছরে ধর্ষণের শিকারও হয়েছে ৯৭৬ শিশু। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে পারিবারিক কলহ, অনৈতিক সম্পর্ক, মুক্তিপণ না পাওয়া, যৌতুক, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ এবং মাদকাসক্তির কারণেই শিশু হত্যা হয়েছে। গত দুই মাসে দেশে ৫৬ শিশু খুন হয়েছে। তার মধ্যে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাবা-মায়ের হাতেই প্রাণ হারিয়েছে নয়জন। ২০১৫ সালে মা-বাবার নৃশংসতার শিকার হয়েছে ৪০ শিশু। এ সংখ্যা ২০১৪ সালে ছিল ৪১ জন। মহান আল্লাহ্তালার সৃষ্টি মানুষ আমরা কোথায় যাচ্ছি? মনে হয় মনুষত্ব বিসর্জন দিয়ে আমরা পশুর চেয়েও অধম হয়ে যাচ্ছি। দিন দিন ঘোর অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছি। সিলেটে রাজন ও খুলনায় রাকিব হত্যার বিচার দ্রুত শেষ হলেও রায় এখনও কার্যকর হয়নি। হত্যার ঘটনা বন্ধ হয়নি। বেড়েই চলেছে। হবিগঞ্জে চার শিশুর রোমহর্ষক হত্যাকা-ের পর শিশু অধিকার ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছর ৪০ শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। গত বছর মোট ২৪৩ শিশু অপহরণের শিকার হয়। এর মধ্যে ১৬৭ শিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে। ২০১৪ সালে অপহৃত হওয়া ১১৮ শিশুর মধ্যে ৫০ শিশুকেই খুন করা হয়েছিল। ৬৬ শিশুকে উদ্ধার করা হয়। ২০১৩ সালে ৪২ শিশু অপহরণের পর ১৩ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। ২০১২ সালে ৬৭ শিশু অপহৃত হয়। তবে কোন কোন বিশেষজ্ঞ বলছেন শিশু হত্যা হঠাৎ বেড়েছে এমন নয়, গণমাধ্যমের কল্যাণে এসব ঘটনা এখন দ্রুত জানা যাচ্ছে। কিছু হত্যা রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের জন্য কাউন্সিলিংও দরকার। শিশুদের প্রতি সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন করতে হবে। শিশু ও নারীরা দুর্বল বলে তাদের ওপর বেশি নির্যাতন করা হচ্ছে। সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানসিক অস্থিরতা বাড়ছে। শিশু সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপও অপ্রতুল। টিভি ও অনলাইনের ওপরও কিছু নিয়ন্ত্রণ আনা প্রয়োজন। শিশু নির্যাতন সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। শিশু নির্যাতন বন্ধে ২০১৩ সালে শিশু অধিকার আইন করা হলেও এখনও বিধি করা হয়নি। অবশ্য শিশু হত্যা, নির্যাতন প্রতিরোধ ও শিশুদের আইনী সেবা দিতে গত বছরের আগস্ট মাসে দেশের প্রতিটি থানায় শিশু বিষয়ক ডেস্ক স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিল পুলিশ সদর দফতর। এতে শিশুদের অভিযোগ তদন্তে আলাদা পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগের কথাও বলা হয়েছিল। এর আগে শিশু আইন ২০১৩-এর আওতায় প্রত্যেক থানায় শিশু ডেস্ক ও আলাদা পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগের কথাও বলা হয়েছিল। তবে আইনটি পাসের পর দুই বছর এবং পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশনা জারির ছয় মাস পার হয়ে গেলেও থানাগুলো তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। শিশু আইনে শিশুদের জন্য আলাদা ডেস্ক স্থাপনের কথা স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী শুধু ঢাকার মাত্র কয়েকটি থানায় শিশু ডেস্ক আছে বলে জানা গেছে। নিজেদের রক্ষা ও প্রতিরোধে একেবারেই অক্ষম এই অবুঝ শিশুদের ওপর দিন দিন যে সহিংসতা বেড়ে চলছে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। জীবন যাচ্ছে ওদের। সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে। শুধু বিদ্যমান আইনটির যথাযথ প্রয়োগই নয়, প্রয়োজনে বর্তমান আইনটিকে আরও কার্যকর করার জন্য কোন কোন জায়গায় এর পরিবর্তন দরকার কিনা সে বিষয়টিও ভেবে দেখা জরুরী হয়ে পড়েছে। শুধু দ্রুত বিচারই নয়, দ- দ্রুত কার্যকর করারও ব্যবস্থা করতে হবে। শিশু হত্যা ও শিশু নির্যাতনের বিচারে আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করার বিষয়টিও কর্তৃপক্ষ গভীরভাবে ভেবে দেখতে পারেন বলে অনেকেই মনে করছেন। লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
×