ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পাট ব্যবহার আইনের সফল বাস্তবায়নে ৪১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা প্রদান

হাত পেতে নয়, বিশ্বে মর্যাদা নিয়ে চলব আমরা ॥ প্রধানমন্ত্রী -পাটকে কৃষিজাত পণ্য ঘোষণা

প্রকাশিত: ০৮:৩৩, ৭ মার্চ ২০১৬

হাত পেতে নয়, বিশ্বে মর্যাদা নিয়ে চলব আমরা ॥ প্রধানমন্ত্রী   -পাটকে কৃষিজাত পণ্য  ঘোষণা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাটকে কৃষিজাত পণ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, নিজেদের যে সম্পদ আছে তা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। কারও কাছে হাত পেতে বা ভিক্ষা করে নয়; নিজেদের মর্যাদা নিয়ে বিশ্বসভায় চলব আমরা। এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমরা দেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। সোনালী আঁশ পাট আমাদের দেশের সমৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাট শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত ও আধুনিকায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বর্তমান সরকার। আর পাট কৃষিজাত দ্রব্য। অন্য সব পণ্য, যার সঙ্গে কৃষির একটু সম্পর্ক সেগুলো কৃষিপণ্য হিসেবে বিশেষ সুবিধা পায় আর পাট পায় না, এটাতো বোঝান যায় না। তাই আমি একটা ঘোষণা দিতে চাই যে, আমাদের পাট পণ্য এবং পাটকে আমরা কৃষিজাত পণ্য হিসেবেই বিবেচনা করব। রবিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০ এর সফল বাস্তবায়ন উপলক্ষে সম্মাননা প্রদান এবং তিন দিনব্যাপী বহুমুখী পাটপণ্য মেলার উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এ ঘোষণা দিলে সারাদেশ থেকে আগত পাট শিল্পের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তারা তুমুল করতালি দিয়ে পুরো মিলনায়তন মুখরিত করে তোলেন। ‘বাংলার পাট- বিশ্বমাত’ শিরোনামে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, পাটমন্ত্রী মুহাঃ ইমাজ উদ্দিন প্রমাণিক, প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী পাটকে কৃষিজাত পণ্যে হিসেবে ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানালে শেখ হাসিনা তাঁদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে এ ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে পাটের তৈরি ঘিরে কালারের শাড়ি, পাটের স্যান্ডেল এবং ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে অনুষ্ঠানে যোগ দেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেই এ বিষয়টি জানালে হলভর্তি দর্শকরা তাঁকে করতালি দিয়ে অভিনন্দিত করেন। অনুষ্ঠানে বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দেশের পাটকলগুলো বিএনপি বন্ধ করে দিয়েছিল এমন অভিযোগ করে বলেন, ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআই) প্রতিষ্ঠা করেন। পাটজাত পণ্য উৎপাদন ও রফতানি সংস্থা ‘বিজেএমসি’ গঠন করা হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যার পর পাটখাতে নেমে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়। তিনি বলেন, সরকারি হিসাবে একসময় দেশে ৮৭টি পাটকল থাকলেও আশির দশক থেকে এগুলো বেসরকারিকরণের নামে ‘নামমাত্র’ মূল্যে বিক্রি করে দেয়া শুরু হয়। ৬০টির বেশি পাটকল এভাবে বেসরকারিকরণ করার মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়েছে। সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদের পর খালেদা জিয়ার শাসনামলে কীভাবে পাটখাতকে ধ্বংস করা হয়েছে তার বিবরণ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একটা চুক্তি করেছিল যে, বাংলাদেশে পাটকলগুলো বন্ধ করে দেবে এবং গোল্ডেন হ্যান্ডশেখের মাধ্যমে শ্রমিকদের বিদায় দেবে। একই সময় ভারতের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের চূক্তি; সেটা ছিল ভারত নতুন পাটকল তৈরি করবে এবং আড়াই লক্ষ বেল পাট তারা এদেশে রফতানি করবে। ওই সময় পার্লামেন্টে পাটকল বন্ধের বিরোধীতা করে বিষয়টি তুলে ধরি। ক্ষোভ প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের সোনালী আঁশের দেশ হলেও আমাদের দেশে বন্ধ হতে থাকে পাটকলগুলো। ২০০২ সালের ৩০ জুন এশিয়ার সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী জুটমিল বন্ধ করে দেয় বিএনপি। এতে মিলের হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, একটি প্রতিষ্ঠান লাভজনক হবে কি হবে না, সেটা নির্ভর করে কীভাবে সেটা পরিচর্যা হয়। সেই জায়গায় না গিয়ে সেগুলো বন্ধ করে দেয়া, ধ্বংস করে দেয়া এটা কখনোই দেশের স্বার্থে মঙ্গলজনক নয়। আমাদের সোনার দেশের সোনালী আঁশকে কেন ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে হবে? আমাদের পাট স্বাধীনতা আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকের বাংলাদেশ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পাট রফতানির অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হতো। ছয় দফা ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক বৈষম্যের ক্ষেত্রে পাটের এ বিষয়টি তুলে ধরেন। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পোস্টারে পাট গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল। সর্বশেষ ২০০৯ সালের নির্বাচনের আগেও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে পাট শিল্পকে অধিক গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টিও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। বর্তমান সরকারের আমলে পাট শিল্পকে রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আমরা পাঁচটি পাটকল ও দুটি বস্ত্রকল পুনরায় চালু করেছি। পাট শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত ও আধুনিকায়নের উদ্যোগ আমরা নিয়েছি। এছাড়া পাট জাগ দেয়া থেকে ভাল আশ ছাড়ানোর ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও শুরু হয়েছে। মিল মালিকদের উদ্দেশ্যে করে তিনি বলেন, আমরা আরও পাটকল চালু করব। তবে এসব পাটকলগুলো পুরনো মেশিনে চলবে না। এখন অনেক আধুনিক মেশিন নেমেছে। সেসব এনে পাটকে বহুমাত্রিক ব্যবহারের মাধ্যমে নানা পণ্যে উৎপাদন করতে হবে। পাট উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের পরিবেশ-আবহাওয়া পাট উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। পাট এমন একটি সম্পদ যার পাতা থেকে খড়ি সবকিছু থেকেই পণ্য তৈরি হয়। কিন্তু এ পণ্যটাকে ধ্বংস করার একটা ষড়যন্ত্র আমরা দেখেছি। পাটের উন্নয়নে তাঁর সরকারের উদ্যোগে পাটের জিনোম আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গবেষণায় আরও এগিয়ে যাব আমরা। আর এখন পরিবেশ নিয়ে বিশ্বে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু পাটের চেয়ে পরিবেশ বান্ধব পণ্য আর কোনটাই হতে পারে না। বিশ্বব্যাপী সিনথেটিক থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাট সব থেকে প্রাকৃতিক তন্তু। কাজেই এটাকে আমাদের আরও উন্নত করতে হবে। আর পাটের সঙ্গে কৃষক ও শ্রমিকের ভাগ্য জড়িত। আর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এদেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষেরই সংগঠন। শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর জন্য মজুরি কমিশনেরও ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি শুধু পাটকল বন্ধ করেনি, শ্রমিকদেরও গুলি করে হত্যা করেছে। সার চাওয়ার অপরাধে ১৮ জন কৃষককে গুলি করে হত্যা করেছে। এটাই হলো তাদের আসল চরিত্র। প্রধানমন্ত্রী দেশী ও আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য, পোশাকসহ পাট থেকে বিভিন্ন পণ্য তৈরি এবং ব্যবহারের কথা তুলে ধরেন এবং পরিবেশসম্মত এ পণ্যের ব্যবহার ও উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে বলেন, এখন একশ’টিরও বেশি পণ্য পাট থেকে উৎপাদিত হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও এখন ২৫ লাখ বেল পাটের চাহিদা রয়েছে। তাই আমি চাইব, আমাদের এ সম্পদটাকে যে কোনভাবেই হোক রক্ষা করতে হবে। আর এ পণ্য রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। এ সময় প্রধানমন্ত্রী পাট শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখতে প্রতিদিন অন্তত একটি কলা খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, পাটকলে কাজ করার সময় দেশের মধ্যে অনেক ধুলা-বালি প্রবেশ করে। তবে একটি অন্তত কলা খেলে ওইসব ধুলাবালি পরিষ্কার হয়ে যাবে, শরীর অসুস্থ হবে না। তাই শ্রমিকদের খাবারের মেন্যুতে যেন একটি করে কলা থাকে সে ব্যাপারে মন্ত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম এ ব্যাপারে দ্রুত একটি সার্কুলার জারির করা হবে বলে প্রধানমন্ত্রীকে জানান। বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী মুহাঃ ইমাজ উদ্দিন প্রমাণিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের শুরুতেই ‘বাংলার পাট বিশ্বমাত’ শিরোনামে একটি থিম সঙ্গ ও প্রমাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়। এতে পাটশিল্পের বহুমুখী ব্যবহারের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী ছাড়াও শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব শহীদুল্লাহ খন্দকার। এরপর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ১৩ ক্যাটাগরিতে ৪১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা তুলে দেন এবং শেষে ঘুরে ঘুরে তিন দিনব্যাপী শুরু হওয়া পাটপণ্যে মেলা ঘুরে দেখেন। পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন বাস্তবায়নে সহায়তার জন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশ, র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান (র‌্যাব), ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশনকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের সভাপতি নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান, এফবিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ, পুলিশের পক্ষে মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক এবং র‌্যাবের পক্ষে অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে সম্মাননা গ্রহণ করেন।
×