ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ জগলুল কবির

জীবন থেকে নেয়া

প্রকাশিত: ০৭:৩৯, ৭ মার্চ ২০১৬

জীবন থেকে নেয়া

মানুষ কি চায়? মানুষ চায় সফলতা, সুখ আর প্রভাব। এর জন্যই সবাই দৌড়-ঝাঁপ, চেষ্টা-তদ্বির করে থাকে। বিভিন্ন কাজ-কর্ম করতে থাকে। সফলতা বলতে প্রধানত আর্থিক সচ্ছলতাকে বুঝায়, তার চেয়ে ওপরের ধাপ হলো বড় পোস্ট-পজিশন। কারণ বড় পোস্ট-পজিশন আর্থিক সচ্ছলতাও এনে দেয়। কিন্তু জীবনের সফলতা একদিনেই চলে আসে না। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়েই সফলতা আসে। বার বার চেষ্টা করে অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়। সফলতার আগে অনেক ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা নিজের ঝুলিতে পুরে নিতে হয়। প্রবাদ আছে, ‘ফেইলিউর ইজ দ্য পিলার অব সাক্সেস’ ব্যর্থতাই হলো সফলতার খুঁটি। এই বাক্য আমার কাছে মনে হয় জীবনেরই উপলব্ধি। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই। একবার ওপরে ওঠে আবার নিচে নামে এতেই এর সৌন্দর্য প্রকাশ পায়। মানুষ বিশাল সমুদ্রের পাড়ে বসে জ্যোৎস্না রাত বা রাতের অন্ধকারে ঢেউয়ের গর্জন শুনতে ছুটে যায়। সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে ঢেউয়ের, ওপরে ওঠা আবার নিচে নামার দোলা গায়ে মেখে আনন্দ অনুভব করে। জীবনও এমন, ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সফলতার শেখরে উঠতে হয়। শেখ সাদি (র) বলেছেন, ‘আমাদের শিক্ষা পরিপূর্ণ হয় না, কারণ আমরা জীবন থেকে শিখি না।’ তাই জীবনটা একটা শিক্ষাক্ষেত্র। সেজন্য বলা হয় জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষকে শিখতে হয়। মানুষের জীবনে প্রেম আসে, ভালবাসা আসে আবেগ থেকে যৌবনের আবেদন থেকে। এর আসল পূর্ণতা আসে বিয়ে-সাদির বন্ধনে। আবার আমাদের সমাজে বিয়ে-সাদি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। এটাই হলো মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় বন্ধন। বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবার মাঝে যখন এক যুবক-যুবতী পূর্ব পরিচিত বা অপরিচিত হোক, বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তখন থেকেই তাদের মধ্যে একটি আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। নিজেরা নিজেদের পরম আত্মীয় হিসেবে ধারণ করে নিতে চেষ্টা করে। তবে সবার দাম্পত্য জীবন একইভাবে শুরু হয় না। কেউ ছোট চাকরি করে, কেউ বড় চাকরি শুরু করলেও অল্প বেতন দিয়ে আরম্ভ হয়, অনেকে ছোট ব্যবসা করে বা কেউ কেউ পরিবারের ব্যবসার হাল ধরে। আবার কারও বাবা-মা প্রতিষ্ঠিত থাকে, কারও বা বাবা-মা প্রতিষ্ঠিত থাকে না। তাই দাম্পত্যের সুখ-আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে একেকজনের জীবনের উপলব্ধি কিন্তু ভিন্ন ধাঁচের হয়। ২৫-৩০ বছরের যুবক-যুবতী বাস্তব জীবনের অনেক কিছু বুঝে উঠার আগেই অনেক কিছুকে মেনে নেয়ার মধ্যে পড়ে যায়। স্বামী বা স্ত্রী উভয় উভয়কে বুঝে উঠা, মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনের কাছে নতুনভাবে নিজেকে তুলে ধরা, কর্মজীবনের অল্প অল্প অভিজ্ঞতা, কর্মক্ষেত্রে অনেক কিছুর ব্যবস্থাপনা করা একসঙ্গে অনেক কিছুই মাথার ওপরে এসে পড়ে। ওইসব মানুষ অনেক ভাগ্যবান, যারা তাদের জীবনে সত্যিকারের অভিভাবকের দিকনির্দেশনা পেয়ে থাকে। নিজের জীবনের ভাল-মন্দ শেয়ার করতে পারে এবং সৎ দিকনির্দেশনা পায়। সাধারণত মানুষের মনে জীবনের ওইসব ঘটনারই দাগ কাটে যা তার নিজের জীবনে ঘটে। যে পথে মানুষ না হাঁটে সে পথ সম্বন্ধে কখনই কোন পরিষ্কার ধারণা আসে না। একটা কল্পনা থাকে যা বাস্তবতার চেয়ে ঠিক উল্টোই হয় অর্থাৎ থিউরিটিক্যাল আর প্রাকটিক্যাল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেজন্য অভিভাবক বিশেষ করে বাবা-মায়ের সঠিক দিকনির্দেশনা সন্তানদের জীবনকে সহজ করে দেয়। বাবা-মায়ের তো জীবনকে দেখার সুযোগ বেশি হয়েছে। বাবা-মায়ের কথা তাই অন্তরে উপলব্ধি করার চেষ্টা করা আর বাবা-মাকেও সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন। তাতে সন্তান সহজভাবে বাবা-মায়ের সঙ্গে সব কিছু শেয়ার করতে দ্বিধা করবে না। সন্তানের উচিত বাবা-মায়ের কথা শুনে শুনে জীবনে এগিয়ে যাওয়া। তাতে জীবনে ভুল কম হবে, সফলতা পাওয়া সহজ হবে। এমন জীবনে সুখী হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় একজন জীবন সঙ্গী যেখানে স্বামী তার স্ত্রীর আবার স্ত্রী স্বামীর মন বুঝে বুঝে চলবে। মন বুঝে চললেই আত্মার সম্পর্ক হয়। আত্মার সম্পর্ক হলো আত্মীয়, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তার চেয়েও বেশি, কেউ তার স্বামী বা স্ত্রীকে আত্মীয় বলে না, বলে অর্ধাঙ্গিনী। তাই স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে বুঝতে না পারলে, নিজেদের সম্পর্ককে গভীর করতে না পারলে জীবন হবে অর্ধেক আর অর্ধেক জীবনে কোন পাওয়াই পরিপূর্ণতা পায় না। দুজনই দুজনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করতে হবে। একে অপরের ভাল কাজগুলোকে শ্রদ্ধার সঙ্গে নিতে হবে। দুজনকেই একে অপরের কাছ থেকে শিখতে হবে। এক চোখে না দেখে দু’চোখ দিয়ে দেখতে হবে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা একটু ভিন্ন ধাঁচের। এখানে একজন শিক্ষত মানুষ, সৃজনশীল মানুষ, বড় পোস্ট-পজিশনে থেকেও আর্থিকভাবে তার প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজন থেকে দুর্বল হতে পারে। আমরা যদি এসব ক্ষেত্রে তুলনা করতে যাই, সবার চেয়ে বেশি সচ্ছলতা, প্রতিপত্তি চাই সে ক্ষেত্রে কখনই সুখী হওয়া সম্ভব হবে না। তিক্ততা বাড়বে। সব প্রাপ্তি ম্লান হয়ে যাবে। তাই নিজের যা আছে তার মধ্যেই নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে হবে। দম্পতি একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। চলার পথ মসৃণ নয়। কংক্রিটে ঢাকা ঢের সব বক্র কাজ রেখে কর্মস্থলে হাজারো সমস্যাগুলো শেষ করে ঘরে ফেরার পরে সঙ্গে সঙ্গে নেগেটিভ কোন মন্তব্য, তিক্ত ব্যবহার পেলে জীবন হয় নরকতুল্য। আর বিপরীতে একটু সহানুভূতিশীল ব্যবহার, ভাল ব্যবহার পেলে অনেক কষ্ট সমস্যার মাঝেও কিন্তু মানসিক শক্তি ফিরে আসে। তাতে কর্ম উদ্যমতা বাড়ে, নতুন করে সফল হতে সাহায্য করে। সারাদিন কাজের পরে স্বামী বা স্ত্রী বাড়ি আসলে নেগেটিভ কোন কথা না বলে সবাই সবার সঙ্গে আন্তরিকতার সঙ্গে পজিটিভভাবে কিছু সময় পার করলে কর্মস্থলের কোন বিষণœতা থাকলেও তা চলে যায়। তারপর আস্তে-ধীরে সংসারের প্রয়োজনগুলো নিয়ে আলোচনা করে নিতে হয়। একজন আরেকজনের মুখের ওপর কোন নেগেটিভ উত্তর দিলে মনে কষ্ট হয়, এতে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কেউ কোন ভুল কথাও যদি বলে তবুও সঙ্গে সঙ্গে উত্তর না দিয়ে সময় নিয়ে পরে বললে ভুল সংশোধন করা সম্ভব হয় বা বুঝতে পারে। হঠাৎ রেগে যাওয়া এটা যুক্তিসঙ্গত বা যুক্তি ছাড়া কোন ব্যাপারে হোক তা খুবই খারাপ। এমন ব্যবহার উভয়ের কেউই একে অপরের সঙ্গে করা উচিত নয়। হঠাৎ রেগে যাওয়া মানে একে অপরের প্রতি যে কোন কারণেই ক্ষিপ্ত হয়ে থাকার বহির্প্রকাশ। এটার মূল কারণ খুঁজে বের করতে হবে। অনেক সময় সত্যিকার বিষয় না বুঝেই পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস বা ভুল মানসিকতা তৈরি হয়ে থাকে, যা দাম্পত্য জীবনে ভীষণভাবে প্রভাব ফেলে। সব ব্যাপারে সহনশীলতা প্রয়োজন। সহনশীলতা নিজের মধ্যে আনতে পারা সত্যিই মহৎগুণ। অনেক সময় দেখা যায় সন্তানের কোন প্রয়োজনে একে অপরের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে ফেলে। এমন ব্যবহারও করা উচিত নয়, মনে রাখতে হবে সন্তান দুজনেরই। দুজনই সন্তানের মঙ্গল ও সফলতা চায়। সর্বোপরি জীবনকে উপলব্ধিতে এনে, একে অপরকে বুঝে বুঝে চললে অর্থাৎ স্থান-কাল বিবেচনায় নিয়ে চলতে থাকলে জীবন সুন্দর হবে, অন্তরের সম্পর্ক ভাল হয়, সত্যিকারের ভালবাসায় জীবন পার হবে আর জীবন ভরে উঠবে সুখ ও সমৃদ্ধিতে। দাম্পত্য সম্পর্ক যাদের সুন্দর পবিত্র তারা পৃথিবীর সুখী মানুষ। ছবি : আরিফ আহমেদ মডেল : নাদিয়া ও নাঈম
×