ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভারমুক্ত শিশুর ভবিষ্যত চাই ॥ অভিমত

প্রকাশিত: ০৩:১৩, ৭ মার্চ ২০১৬

ভারমুক্ত শিশুর ভবিষ্যত চাই ॥ অভিমত

একটি শিশুর সর্বোচ্চ যতটা ওজন বহন করা উচিত তা হলো তার নিজের ওজনের দশ ভাগের একভাগ (১০%) ওজন; যাতে অন্তর্ভুক্ত তার পানির বোতল, টিফিন বক্স, আর বই তো বটেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে শিশুদের ২০% থেকে ৩০% ওজন বহন করতে দেখা যাচ্ছে, যা বিশেষজ্ঞদের মতে শিশুর মেরুদ-ে স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। শহর হোক বা গ্রাম, শিশু একটি ভারী ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে এই চিত্র এখন নৈমিত্তিক। মেরুদ-ের হাড়ের সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে; যার জন্য দায়ী স্কুলব্যাগের এই বাড়তি ওজন। দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের এই স্বাস্থ্যঝুঁকি একটি চিন্তার বিষয়। দেশের মোট শিশুর একটি অংশ ১৪ বছর বয়সের মধ্যেই মেরুদ-ের ব্যথায় ভুগে থাকে। শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে ভারী ব্যাগ নিয়মিত বহনে খুব স্বাভাবিক পরিণতি হচ্ছে এই মেরুদ- ও ঘাড়ের হাড়ের সমস্যা। বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের প্রতিনিয়ত প্রায় ১০ থেকে ১২ কেজির স্কুলব্যাগ বহন করতে হয়। ভেবে দেখুন, প্রতিদিন লাখ লাখ শিক্ষার্থী ব্যাগের ভারে ঝুঁকে পড়া কাঁধ নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এত উৎকর্ষতা সত্ত্বেও আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা এমন কোন বিকল্প খুঁজে বের করতে পারেনি যাতে শিক্ষার্থীদের এত ভারী ব্যাগ বহন করতে না হয়। সুতরাং, এটি কোন আশ্চর্য বিষয় নয় যে, বাচ্চারা এখন পিঠব্যথা, কাঁধব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে কিংবা পাবে। যখন স্কুলব্যাগটি বেশি ভারী হয় তখন শরীর অভিকর্ষ বলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য সামনের দিকে ঝুঁকে যায়। এর ফলে শিশুর শরীরের অঙ্গবিন্যাস বদলে যায় এবং মেরুদ-ের হাড়ের ওপর চাপ পড়ে। ব্যাগের ওজনের চাপে কাঁধের পেশিও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে শিশু সম্ভাব্য ব্যথা, অস্বস্তি বা চাপ অনুভব করতে পারে। টিস্যুর ক্ষয়ে সবসময়ই ব্যথা অনুভব নাও হতে পারে, যার অর্থ অনেক সময় এটি বোঝার আগেই ক্ষয় ধরতে পারে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ সময় পরে অঙ্গবিন্যাসে অসামঞ্জস্যতা দেখা দিতে পারে, যা নার্ভাস সিস্টেমের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। যখন মেরুদ-ের হাড়ের বিন্যাসে অসামঞ্জস্যতা হয় তখন ব্রেইন ও শরীরের যোগাযোগের ওপরও ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। সেদিন বছর পঁচিশের এক যুবকের সঙ্গে কথোপকথনে শুনছিলাম যে, দশ-বারো বছর আগে ভারী স্কুলব্যাগ বহন করার কারণে তাকে এখনও মেরুদ-ের হাড়ের ব্যথায় ভুগতে হয়। আমি বিশ্বাস করি সকল সমস্যারই কোন না কোন সমাধান আছে। আমরা কেন উন্নত বিশ্বে, যা প্রায় এক দশক আগে শুরু“হয়েছে তা অনুসরণ করি না; অর্থাৎ সকল বইয়ের পরিবর্তে ট্যাব বা কিন্ডেলের প্রচলন করি না? বর্তমান সরকার ডিজিটালাইজেশন নিয়ে অত্যন্ত আন্তরিক, যা আমাদের দেশের স্কুলগুলোর জন্য নিঃসন্দেহে খুবই প্রশংসনীয় সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগ। ডিজিটালাইজেশন এখন দেশের ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়েও পৌঁছে গিয়েছে। সে সঙ্গে আর একটি পদক্ষেপ নিয়ে আমরা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিতে পারি; অর্থাৎ তাদের আট থেকে দশটা বই না দিয়ে একটি ট্যাব (ট্যাবলেট পিসি) বা একটি কিন্ডেল দেয়া যেতে পারে। কিন্ডেল হলো একটি ছোট হাতে ধরা যায় এমন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস, যাতে বই পড়া যায়। এটি দেখতে একদম ট্যাবের মতো। এর ওজন আনুমানিক ২০০-২৫০ গ্রাম, যাতে প্রায় ১ হাজার ৪০০ বই সংরক্ষণ করা যায়। এর বিশেষ হাই-কন্ট্রাস্ট স্ক্রিনের কারণে উজ্জ্বল রোদেও এটি পড়া যায়। এর অক্ষরগুলো ও ডিসপ্লে এমনভাবে তৈরি করা যেন মনে হয় এটি একটি বইয়ের পৃষ্ঠা। এতে আছে টেক্সট সাইজ বাড়ানো বা কমানোর সুযোগ, বিল্ট-ইন ওয়াইফাই বা থ্রিজি কানেকশন। এর ব্যাটারি লাইফ হলো কমপক্ষে এক মাস, যদি ওয়াইফাই বন্ধ থাকে। এতে পৃষ্ঠা উল্টানোর উপায়টিও এমনভাবে তৈরি করা যে, পাঠকের মনে হয় সে সত্যিকার বইয়ের পাতাই উল্টাচ্ছে। এটি ল্যাপটপের মতো কখনও গরম হয়ে যায় না। কিন্ডেলে বইগুলো কালেকশন হিসেবে পৃথক করে রাখা যায়। এতে আছে অটোমেটিক আর্কাইভ ফাংশনএ আপনি একটি বই মুছে দিয়ে পরে আবার ডাউনলোড করে নিতে পারেন। ছবি, ছক বা ম্যাপ দেখার সুবিধার্থে এর স্ক্রিনকে ঘুরিয়ে নেয়া যায়। এতে সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন বা ওয়েবপেজও পড়া যায়। এর চেয়ে বেশি একজন ছাত্র-ছাত্রীর কি চাওয়া থাকতে পারে? এই একটি যন্ত্রের মাধ্যমেই শিক্ষা সংক্রান্ত অনেক কাজ করা যায়। আমি ঠিক জানি না সরকার ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের আট থেকে দশটা বইয়ের পেছনে কত টাকা খরচ করছে, তবে খরচ তো একটা আছেই। সেটাকে খানিকটা বাড়িয়ে আমরা যদি চাহিদা মোতাবেক সহজ ও সস্তা কিন্ডেল বানিয়ে নিতে পারি তাহলে কেমন হয়? ধরা যাক ৫০০ মেগাবাইট কিংবা ১ গিগাবাইট স্টোরেজসম্পন্ন ৬ ইঞ্চি মনিটরের কিন্ডেল যার মূল্য ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। অসম্ভব শোনাচ্ছে? একটু চেষ্টা করে দেখতে অসুবিধা কোথায়? আমরা যদি এটি করতে পারি তাহলে দেশের শিক্ষার্থীদের সত্যিকারের ডিজিটাল বিশ্বের স্বাদ দেয়া সম্ভব হবে। আবার একই সঙ্গে তাদের এত ভারী ব্যাগ বহনের কষ্ট লাঘব হবে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত অনুরোধ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে ভেবে দেখার। লেখক : শিক্ষাবিদ
×