ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

ভেঙ্গেছে দুয়ার, এসেছে জ্যোতির্ময়

প্রকাশিত: ০৩:১৩, ৭ মার্চ ২০১৬

ভেঙ্গেছে দুয়ার, এসেছে জ্যোতির্ময়

কেমন ছিল পঁয়তাল্লিশ বছর আগের সেই ৭ মার্চ। নেতা-জনতারা মিলিত মাহেন্দ্রক্ষণটুকুতে কেমন করে যেন মিশে গিয়েছিল বাঙালীর সবটুকু সত্তা। একটি দ-ে পুরো জাতি এসে দাঁড়িয়েছিল দ্বিধাহীন নিঃসঙ্কোচে দুর্বিনীত স্পর্ধায়। তখন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল সেই সুর-‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ/ কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে/ সে কোলাহলের আমি পাই রেশ/ জলে ও মাটিতে ভাঙনের বেগ আসে।’ সারা বাংলাদেশ তখন উত্তাল গর্জনে কাঁপছিল জনতার পদভারে কম্পিত মাটি আর বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল জয়ধ্বনি। ঝিনুক যেমন নীরবে সয়ে যায়, তেমনি নীরবে থাকা জাতি বাঙালী এমন সগৌরবে সরবে সর্বত্র সম্মিলিত কণ্ঠে তুলেছিল ধ্বনি, জয় বাংলা। একাত্তরের ৭ মার্চ দিনটি ছিল রোববার। দিনটি সাপ্তাহিক ছুটির দিন হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছিল ব্রিটিশ কাল থেকেই। কিন্তু বাংলায় তখন চলছে অসহযোগ আন্দোলন। অফিস, কলকারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আদালত ছেড়ে মানুষ তখন রাজপথে। মুক্তির আবেগে জীবনবাজি রেখে স্বাধীনতার স্বপ্নকে হাতের মুুঠোয় নিয়ে আসার প্রাণপণ কসরতে মত্ত জাতি। জান্তা শাসকদের শাসন-শোষণ উপড়ে ফেলে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ছিনিয়ে আনার লক্ষ্যে লড়াকু মনোভাব নিয়ে অগ্রসরমান তখন পুরো জাতি। শতসহস্র বছরের নীরবতা ভেঙ্গে এক নতুন স্বপ্নের মোহনায় দাঁড়িয়ে বাঙালীর স্বতন্ত্র সত্তার ভেতর নিজেকে আবিষ্কার করতে পেরেছিল একাত্তরের মার্চেই। বাঙালী সেদিন তার আরাধ্য নেতাকে পেয়ে সাহসের বরাভয় নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। নেতার অঙ্গুুলি নির্দেশে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামক প্রদেশটি মুছে গিয়ে বাংলাদেশ নামক প্রসবোন্মুখ দেশে পরিণত হয়েছে। নেতার নির্দেশে চলছে দেশ। সাড়ে সাত কোটি প্রাণ তখন একাত্ম। নিজেদের বাঙালী ভাবতে, বুঝতে শিখে ফেলেছে ততদিনে। সহস্র বছরের পরিক্রমায় জাতিটি তার দীর্ঘদিনের শাসন শোষণ আর উপনিবেশকতার দরোজা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার জন্য একাত্তরে সমবেত। এমন জাগরণ অতীতে দেখেনি কেউ কখনও। এমন বিদ্রোহ আর আসেনি এই উপমহাদেশ তথা বিশ্বজুড়ে। বিদ্রোহ বিপ্লবের ললাটটীকা এঁকে যাওয়ার সেই এক সময়, বাঙালীর স্বশাসিত হওয়ার এক পরমলগ্ন উৎসারিত হতে থাকে। মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগটিও ছিল না সে বাঙালীর। দীর্ঘ দীর্ঘকাল ধরে বিদেশী শাসন-শোষণে নিষ্পেষিত, জর্জরিত হতে হতে পরাজিত মানসিকতার বেড়াজাল ছিন্ন করার উপায়ত্ত ছিল না, সেই বাঙালী এক জাতিতে পরিণত হয়ে একটি ভূখ-কে আপন সত্তায় বেঁধে নিয়েছিল শিক্ষা-দীক্ষা, জীবন-জীবিকায় পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জীবনে আলোড়ন তুলে সমাজ বাস্তবতাকে সামনে এনে উপস্থিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর আরেকটি নাম হয়ে শেখ মুজিব তখন বাংলায় দেদীপ্যমান মানবে পরিণত হয়ে উঠেছিলেন। নির্যাতিত দেশের মাঝে জনগণের নৌকা তিনি তখন বেয়ে চলেছেন। বাঙালী জাতির স্বজাত্যবোধের বিকাশ ঘটাতে আবির্ভূত হলেন তিনি। স্বদেশের সকল জাতীয় বীরের সাহস ও শৌর্য-বীর্যকে আত্মস্থ করে হয়ে ওঠেন ততদিনে সম্মিলিত আকাক্সক্ষায় পূর্ণ প্রতীকরূপে। শতবর্ষেরও আগে রবীন্দ্র্রনাথ তাঁর ‘ভারতবর্ষীয় সমাজ’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, ‘স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে আমরা উপলব্ধি করিতে চাই। এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হইবেন তাকে অবলম্বন করিয়াই আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি করিব, সেবা করিব। তাহার সঙ্গে যোগ রাখিলেই সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ রক্ষিত হইবে।’ বঙ্গবন্ধু তার স্বজাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে ধাপে ধাপে বের করে নিয়ে এসে অহিংস এবং সহিংস উভয় পথ ধরে এগিয়ে গিয়েছিলেন। চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য প্রয়োজন সহিংস হয়ে ওঠার মন্ত্রটা তাঁর মধ্যে ঘুুরপাক খেত- এটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। একদিকে তিনি গণতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন এবং অপরদিকে নেতাজী সুভাষ বসুুর রণনীতিকে অবলম্বন করে প্রশিক্ষিত গোষ্ঠী গড়ে তোলার পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। ছাত্ররা তখন সমাজকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখতো, তাই তারা সর্বাগ্রে এগিয়ে এসেছিল, পাকিস্তানী সামরিক জান্তা গোষ্ঠীর শাসনে নিপীড়িত, নিষ্পেষিত ও দমিত ছাত্র সমাজ সংগঠিত হয়ে উঠেছিল দেশজুড়ে। সংখ্যায় বেশি অশিক্ষিত বাঙালী সমাজে তখন শিক্ষিত ও শোষিত ছাত্ররা জনতার কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছিল। গণদাবি ছাত্র সমাজের দাবিতেও পরিণত হতে হতে এক সময় পুরো দেশবাসীর দাবিতে পরিণত হলো। যে স্বাধিকারের জন্য ছাত্র-শ্রমিকরা আন্দোলন করে আসছিল, সেই স্বাধিকারকে তখন স্বাধীনতার দিকে ধাবিত করেছিল বাঙালী জাতি তার আরাধ্য নেতার নেতৃত্বে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সেইসব জাতি ভাগ্যবান, যারা সবসময় স্বদেশকে দেশের ইতিহাসের মাঝেই খুঁজে পায়।’ বাঙালী সেই স্বদেশের সন্ধানে যাত্রা শুরু করেছিল মার্চেই। ছাত্রসমাজ সেই পথ ধরেই এগিয়ে গিয়েছিল, তাদের ডাকে সে সময় দেশবাসী সাড়া দিয়েছিল। ব্যাপক জনগণকে পাকিস্তানীরা শিক্ষাবঞ্চিত রেখেছিল নিপীড়ন ও শোষণের ক্ষেত্র বহাল রাখার লক্ষ্যে। সমাজজুড়ে কুৎসা ও রটনা ছড়ানো হতো এমনভাবে যে, জনগণ তাতে কখনও সখনও বিভ্রান্তির চোরাবালিতে হাবুডুবু খেতে বাধ্য হতো। ধর্মকে বর্ম বানিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার কাজে ধর্ম ব্যবসায়ীরা পৃষ্ঠপোষকতা পেত জান্তা শাসকদের কাছ থেকে। তারাই হয়ে ওঠে শাসকদের বরকন্দাজ। বাঙালীর স্বাধিকার ও স্বাধীনতা লাভের স্পৃহা যে ধর্মবিরোধী, তা প্রমাণ করার জন্য নানা কিসিমের জজবা তোলা হতো। পাকিস্তানী জান্তারা বাংলায় তাদের বশংবদ গোষ্ঠী তৈরিতে পারদর্শী ছিল। নানা লোভ টোপ, উপঢৌকন, পদ-পদবী, খেতাব ইত্যাদি নানাভাবে তাদের করায়ত্ত করে বাঙালীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করে আসছিল। জান্তাদের শক্তিমত্তার পেছনে ছিল শক্তিশালী মারণাস্ত্র। প্রশিক্ষিত এই বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধটা শেষ পর্যন্ত বাঙালীকে লড়তেই হয়েছে। বীরের জাতি বাঙালী এবং তাকে ২৩ বছরের পরও পর্যুদস্ত করে রাখা যাবে নাÑ এই উদ্ভাস মার্চের সেই সময়ে প্রতিভাত হয়েছিল। এই যে নিরস্ত্র থেকে একটি জাতির সশস্ত্র হয়ে ওঠা, তা তো আর হঠাৎ হয়নি। এর একটা পূর্বপ্রস্তুতিও ছিল। সেই সব পরিস্থিতি মোকাবেলা করে করে ঘটনার ঘনঘটা পাড়ি দিয়ে শেষপর্যন্ত একটি স্থানে এসে দাঁড়িয়েছে বাঙালী এবং পরস্পর কাঁধে কাঁধ রেখে শত্রু হননের শপথে বলীয়ান। এই যে হেরে যাওয়া, পরাস্ত হওয়া গণহত্যাকারী হানাদার পাকিস্তানী সেনাদের, যারা নয় মাস ধরে বাংলায় বীভৎস ও নারকীয় অপকর্মে লিপ্ত ছিল। সাড়ে সাত কোটি মানুষের অভিশাপে জর্জরিত হানাদারদের সেই সব অপকীর্তি ইতিহাসের পাতায় পাতায় রয়েছে। যে যেভাবেই মূল্যায়ন করুক না কেন, বর্বরতার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছিল সেদিন ইসলামের ধ্বজাধারী প্রশিক্ষিত বাহিনীটি। ৭ মার্চ এসেছিল বাঙালীর জীবনে এক নয়া উন্মোচনের বার্তা নিয়ে, যার প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছিল সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পর। লাঞ্ছিত নিপীড়িত বাঙালী জাতি চেয়েছিল তার ভোটে নির্বাচিতরা সরকার গঠন করবে, শাসনতন্ত্র তৈরির জন্য সংসদ অধিবেশনে মিলিত হবে। জন্মলগ্নের এই আকাক্সক্ষাকে পদদলিত করার কাজটি ১ মার্চ করা হয়। বাঙালীকে সেদিন অপমান করা হয়েছিল। জাতীয় সংসদের পূর্বঘোষিত ৩ মার্চের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করায় বাঙালী বুঝে নিয়েছিল; পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী জনসাধারণের প্রদত্ত সুস্পষ্ট নির্বাচনী রায়কে দলিত মথিত করা হচ্ছে। ইয়াহিয়া খানের এক ঘোষণায় সারাবাংলা আগুনের ফুলকির মতো ঝলসে ওঠে। দাবানলের মতো আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষোভে বিক্ষোভে ফেটে পড়া বাঙালী ঘর ছেড়ে রাজপথে নেমে পড়ে। মিছিলে মিছিলে সয়লাব দেশ। মুক্তির পথপরিক্রমায় বাঙালী বুঝে নিয়েছে আরও যে, তাদের নির্বাচনী বিজয়ের রায় ও স্বাধিকারের চেতনা নস্যাৎ করে দিতে বদ্ধপরিকর পাকিস্তানীরা। যুগ-যুগান্তরের শৃঙ্খল ভেঙ্গে জেগে ওঠা বাঙালী এই অন্যায় অপমান মাথা পেতে নেয়নি। যুদ্ধটা শুরু হয়ে গিয়েছিল একাত্তরের ৩ মার্চ থেকেই। পাকিস্তানী সোনাবাহিনী তখন গর্জে ওঠা বাঙালীর মুখোমুখি সশস্ত্র অবস্থান নিয়ে নিয়েছে। ৩ ও ৪ মার্চ চট্টগ্রামেই ১২০ জন নিহত ও ৩৩৫ জন আহত হয়। প্রতিরোধের বহ্নিশিখা তখনই উথলে উঠেছে। ৪ মার্চ সেনাবাহিনীর গুলিতে খুলনায় ছয়জন নিহত ও ২২ জন আহত হয়। ৫ মার্চ টঙ্গীতে পাকিস্তানীদের গুলিতে চারজন নিহত এবং ২৫ জন আহত হয়। খুলনায় দুজন ও রাজশাহীতে একজন নিহত হয়। ৬ মার্চ ঢাকাসহ সারাদেশে হরতাল চলাকালে সেনাবাহিনী ও জনতার মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। এদিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ৩৪১ জন কারাবন্দী পলায়নকালে গুলিতে সাতজন নিহত ও ৩০ জন আহত হয়। সম্মুখ সমরের পূর্বাভাস এভাবেই পাওয়া যায়। আর এই শহীদদের হত্যার বিচারের দাবিতে তখন উৎকণ্ঠিত শেখ মুজিব। ৭ মার্চের ভাষণেও বলেছেন, শহীদদের রক্ত মাড়িয়ে তিনি অধিবেশনে যোগ দিতে পারেন না। বিদ্রোহী বাংলা ক্রমশ দুর্বিনীত হয়ে ওঠে। ৪ মার্চ রেডিও পাকিস্তান ঢাকার নয়া নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ বেতার ঢাকা এবং টেলিভিশনের নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ টেলিভিশন ঢাকা কেন্দ্র। এই দুই গণমাধ্যম থেকে প্রচারিত হতে থাকে স্বাধীনতার সপক্ষে গান, নাটকসহ নানা অনুষ্ঠান। শেখ মুজিবের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালনে সচেষ্ট বাঙালী জাতি মুক্তি অর্জনের ইস্পাত কঠিন শপথের দৃঢ়তায় সশস্ত্র হয়ে ওঠার প্রেরণায় প্রশিক্ষিত হতে থাকে নানা স্থানে। অসহযোগ আন্দোলন বাঙালীকে প্রাণিত করেছে দুর্দমনীয় প্রতিরোধের বজ্রকঠিন সাহসে। গণসঙ্গীত ভেসে আসতে থাকে সারাদেশ থেকে। প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিরোধের আগুন জ্বলতে থাকে বাঙালীর মনে। অনেক রক্তদান করা বাঙালীকে তখন ডাকছে রণাঙ্গন। সাড়ে সাত কোটি প্রাণ এক হয়ে তখন শত্রু হননের জন্য প্রস্তুতিপর্বে নিমগ্ন ছিল। ৭ মার্চের ভাষণ কোন আকস্মিক বিষয় ছিল না। এই ভাষণের আগে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে বিভিন্ন সমাবেশে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু জাতিকে ক্রমশ স্বাধীনতার পক্ষে উজ্জীবিত করে তুলছিলেন। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের ষড়যন্ত্র এবং তা উপড়ে ফেলার জন্য করণীয়ও নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। শাসক শ্রেণী ভেতরে ভেতরে যে গভীর ষড়যন্ত্র চালু রেখেছে তা আঁচ করতে পেরে একাত্তরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণের পর শপথবাণী উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাঙালীকে দাবিয়ে রাখার শক্তি পৃথিবীতে কারও নেই। যারা সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর স্বাধিকারের দাবি বানচালের জন্য বাঙালীকে ভিখারি বানিয়ে ক্রীতদাস করে রাখছে, তাদের উদ্দেশ্য যে কোন মূল্যে ব্যর্থ করে দেয়া হবে।’ সেদিন অশ্রুভারাক্রান্ত কণ্ঠে এমনও বলেছিলেন, ‘সামনে আমাদের কঠিন দিন। আমি হয়ত আপনাদের মাঝে না-ও থাকতে পারি। মানুষকে মরতেই হয়। জানি না আবার কবে আপনাদের সামনে এসে দাঁড়াতে পারব। তাই আজ আমি আপনাদের এবং বাংলার মানুষকে ডেকে বলছিÑ চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হোন। বাংলার মানুষ যেন শোষিত না হয়। লাঞ্ছিত-অপমানিত না হয়। ...বীর শহীদদের অতৃপ্ত আত্মা আজ দুয়ারে দুয়ারে ফিরছেÑ বাঙালী তোমরা কাপুরুষ হইও না। চরম ত্যাগের বিনিময়ে হলেও স্বাধিকার আদায় কর। বাংলার মানুষের প্রতি আহ্বান, প্রস্তুত হোন, স্বাধিকার আমরা আদায় করবই।’ দৃঢ়তায় তিনি আবদ্ধ করার কাজটি সত্তরের নির্বাচনের পরই শুরু করেন। একাত্তরের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত ভাষা আন্দোলনের স্মরণ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি শেখ মুজিব বলেন, দেশ ভাগের পর আমাদের সঙ্গে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে আচরণ করা হয়েছে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের দালাল বলা হয়েছে, এমনকি ভাষা আন্দোলনকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমদানি করা হয়েছে বলা হতো। বাঙালী হিসেবে আমরা অনেক উদারতার পরিচয় দিয়েছি, তা না হলে আমরা বাংলাকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানাতে পারতাম। ...একদিন বাঙালী জাতীয়তাবাদের কথা বলা যেত না। কিন্তু আজ এই জাতীয়তাবাদ সত্য। একে রোধ করতে পারে এমন কোন ক্ষমতা নেই। এই প্রথমবারের মতো বাঙালী জাতি একতাবদ্ধ হয়েছে। নিজেদের দাবিতে বাঙালীরা আজ ঐক্যবদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর নির্ভরতা ছিল জনগণের ওপর। বলেছেনও একাত্তরের ২৯ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে, ‘গত ২৩ বছর বাংলাদেশকে শাসন ও শোষণ করা হয়েছে। সেই পরিস্থিতি অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে সনাতন ষড়যন্ত্র আজও চলছে। তবে ভরসা হচ্ছে, দেশবাসী আজ সম্পূর্ণ সচেতন ও জাগ্রত এবং ষড়যন্ত্র জালকে ছিন্নভিন্ন করে কায়েমি স্বার্থবাদকে খতম করার ক্ষমতা দেশবাসী রাখে।’ পূর্ববাংলায় সঙ্গীতশিল্পী সমাজ বঙ্গবন্ধুকে যে সংবর্ধনা প্রদান করে ২৪ জানুয়ারি, তাতে তিনি বাঙালীর সাহিত্য সংস্কৃতির রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আপনারা ভালবাসা এবং শান্তির অনেক গান গেয়েছেন। আজ বস্তির নিঃস্ব সর্বহারা মানুষের জন্য গান রচনার দিন এসেছে। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের মতো বিপ্লবী গান গাইতে হবে। মানুষের মনে প্রেরণা যোগাতে হবে। যদি এতে বাধা আসে, সেই বাধা মুক্তির জন্য সাত কোটি বাঙালী এগিয়ে আসবে। ...যদিও জনগণ প্রাথমিকভাবে বিজয়ী হয়েছে; তবুও বিপদের আশঙ্কা এখনও দূরীভূত হয়নি। পথ এখনও কণ্টকাকীর্ণ এবং অনিশ্চিত। ...মনে রাখবেন, বিপদ আমাদের কাটে নাই। লক্ষ্য এখনও অর্জিত হয় নাই। চরম সংগ্রামের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। সেদিনের জন্য প্রস্তুত হন। ছাত্রলীগের ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে একাত্তরের ৪ জানুয়ারি দীর্ঘ ভাষণে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন দিক-নির্দেশনাসমেত গুরুত্বপূর্ণ অনেক কথা। বলেছিলেন, দেশে যদি বিপ্লবের প্রয়োজন দেখা দেয় তবে সে বিপ্লবের ডাক আমিই দেব। এমনটাও বলেছিলেন, ‘জনগণের স্বাধীনতার ফলভোগকে নিশ্চিত করার জন্য আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবে।’ ৭ মার্চের আগের ভাষণ বিবৃতি পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়Ñ ওই সব ভাষণের উপসংহার তিনি টেনেছিলেন ৭ মার্চের ভাষণে। আজকের প্রজন্ম উপলব্ধি করতে পারবে কি-না জানি না ৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানের বিকেল কেমন ছিল। আদমজী, টঙ্গী, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থেকে যেমন; তেমনি অসংখ্য মহিলা এসেছেন বাঁশের লাঠি নিয়ে। বহু মানুষ এসেছেন তীর-ধনুক নিয়ে। যেন যুদ্ধ আসন্ন। জনসভার ওপর দিয়ে পাকিস্তানী বিমান প্রদক্ষিণ দেখে ওটাতে শত্রু সেনা আছে ভেবে কেউ কেউ লাঠি ছুড়ে মারে। মনোয়ারা বিবি নামে একজন মহিলা গাইছিলেন ‘মরি হায়রে হায়, দুঃখের সীমা নাই, সোনার বাংলা শ্মশান হইল পরাণ ফাইডা যায়।’ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের তিনটি পাঠ বর্তমানে মেলে। রেকর্ডের ভাষণটি সম্পাদিত ও সংক্ষিপ্ত। সরকারের উচিত ভাষণের পুরো পাঠ প্রকাশ করা। সেদিনকার ভাষণ সম্পর্কে ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু, ‘স্বাধীনতার ইতিহাস কোনদিন মিথ্যা করতে নাই। ...৭ মার্চ স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলা বাকি ছিল! প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চ স্বাধীনতা সংগ্রাম ঘোষণা করা হয়েছিল। সেদিন পরিষ্কার বলা হয়েছিল, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ৭ মার্চের ভাষণের স্থানটি মুছে ফেলার জন্য পঁচাত্তর পরবর্তী শাসকরা অপতৎপরতার আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালের ৭ মার্চ যে স্থানটিতে বিশাল জনসভার মঞ্চে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছিলেন সংগ্রামের, সেই ঘোষণা স্থলে দেশের কয়েকজন তরুণ কবি পুষ্পমাল্য অর্পণ ও কাব্য পাঠ করেন হৃদয়ের সব অর্গল খুলে দিয়ে। সেই কবি কামাল চৌধুরী, আসাদ মান্নান, মোহাম্মদ সাদিক সাহসী ভূমিকা নিয়েছিলেন। সাংবাদিক হিসেবে তাদের সেই সাহস নিয়ে প্রতিবেদন লিখেছিলাম। সেই স্থানটি আজও সংরক্ষণ করা হয়নি। জাতি হিসেবে এটা দুর্ভাগ্যের যে, আমরা ঐতিহ্যগুলোর মূল্য দিতে জানিনে।
×