ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তোফায়েল আহমেদ

নিরস্ত্র বাঙালীর সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তর

প্রকাশিত: ০৩:১১, ৭ মার্চ ২০১৬

নিরস্ত্র বাঙালীর সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তর

বছর ঘুরে সাতই মার্চ এলেই মনে পড়ে ইতিহাসের মহামানব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। কিভাবে দীর্ঘ সংগ্রামের রক্তাক্ত পথ পেরিয়ে ধাপে ধাপে তিনি একত্রিত করেছিলেন সমগ্র জাতিকে। ১৯৭১-এর সাতই মার্চ, এমন একটি দিনের জন্যই বঙ্গবন্ধু নিজেকে, আওয়ামী লীগকে সুদীর্ঘ ২৩টি বছর ধরে প্রস্তুত করেছিলেন এবং বাঙালী জাতিকে উন্নীত করেছিলেন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে। ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়যুক্ত হয়ে প্রমাণ করেছিলেন বাঙালী জাতির তিনিই একমাত্র বৈধ রাজনৈতিক প্রতিনিধি। দলের সামান্য একজন কর্মী হিসেবে আমার ঠাঁই হয়েছিল তাঁর নৈকট্য লাভের। খুব কাছ থেকে এই মহান নেতাকে যতটা দেখেছি তাতে কেবলই মনে হয়েছে আমরা যারা রাজনীতি করি তাদের কত কিছু শেখার আছে বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে। সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে আওয়ামী লীগ দলটিকে গড়ে তুলেছিলেন নিজ পরিবারের মতো। শ্রেণী নির্বিশেষে দলীয় প্রতিটি নেতাকর্মীকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন তিনি। সকলের প্রতি ছিল প্রগাঢ় আস্থা, অকুণ্ঠ ভালোবাসা। সকলেই তাঁর প্রতি স্থাপন করেছিল গভীর বিশ্বাস। বিশেষ করে দলের কর্মীদের তিনি আপন সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। তাদের দুঃখ-কষ্টে, বিপদে-আপদে সহমর্মী হতেন। শুধু তাই নয়, এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পর্যন্ত বিশেষভাবে সম্মান প্রদর্শন করতেন। কখনও কারও মনে আঘাত দিয়ে কোন কথা বলতেন না। অহংকার আর দাম্ভিকতা ছিল তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল সময়ের চাহিদা অনুযায়ী নিজস্ব অবস্থান কোথায় হওয়া উচিত সেটি যেমন বুঝতেন, তেমনিভাবে কে কোথায় যোগ্যতর আসনে অধিষ্ঠিত হবেন তাঁকে সে জায়গাটিতে বসিয়ে দিতে ভুল করতেন না মোটেই। ’৭১-এ তাঁর অনুপস্থিতিতে মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানের গুরুভার অর্পণ করেছিলেন জাতীয় চার নেতাকে এবং তাঁরা সে দায়িত্ব সফলভাবে সম্পন্নও করেছিলেন। খুব কাছ থেকে দেখেছি অসহযোগ আন্দোলনের সময় ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনাকালে সবসময় পাশে রাখতেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমেদকে। সকলকে সম্মানিত করতেন বলেই বাংলার সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি পেয়ে হয়েছেন ‘জাতির জনক’। বাংলার মানুষের মনের মণিকোঠায় যেমন স্থান পেয়েছেন, তেমনি জনসাধারণও তাঁর চেতনায় ছিল দেদীপ্যমান। টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত পল্লীতে পিতা-মাতার পাশেই শায়িত বঙ্গবন্ধুকে খুব বেশি মনে পড়ে, চেতনায় সততই বিরাজ করে। মনে পড়ে তাঁর বজ্রকণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অগ্নিঝরা সাতই মার্চের ঐতিহাসিক নির্দেশাবলী ও তৎপরবর্তী অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোর কথা। রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের রক্তঝরা পথে আত্মত্যাগের অপার মহিমায় ভাস্বর সে দিনটি ছিল জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সুউচ্চ ধাপ। সেজন্যই এদিনে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছিল ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভের পর। বিজয়ী দল সরকার গঠন করবে, শাসনতন্ত্র তৈরির জন্য অধিবেশনে মিলিত হবে এই ছিল জাতীয় অভিলাষ। কিন্তু জনমনে কাক্সিক্ষত এরকম একটি গণঅভিপ্রায়কে সমাধিস্থ করে ১ মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে পূর্বঘোষিত ৩ মার্চ ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করেন। মুহূর্তের মধ্যে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে সারাদেশ। দাবানলের মতো আগুন জ্বলে ওঠে চারদিকে। বিশেষ করে ঢাকার মানুষ ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। শত-সহস্র মিছিলে জনসমুদ্রে পরিণত হয় পল্টন ময়দান। বিকাল ৩টায় পল্টন ময়দানে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রতিবাদ সভায় জনসাধারণকে আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাই। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের রক্তঝরা প্রতিটি দিনের কর্মসূচী নির্ধারণ হতো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। ২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয় এবং তাঁর নির্দেশে কলাভবনে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় স্বাধীন বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলিত হয়। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ও উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পল্টনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। ৪ মার্চ সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। ৬ মার্চ ঢাকাসহ সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। এদিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙ্গে ৩৪১ জন কারাবন্দী পলায়নকালে পুলিশের গুলিতে ৭ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হয়। সংগ্রামী বাংলা সেদিন ছিল অগ্নিগর্ভ, দুর্বিনীত। কারও চাপিয়ে দেয়া অন্যায় প্রভুত্ব মেনে নেয়ার জন্য, কারও কলোনী বা করদরাজ্য হিসেবে থাকার জন্য বাংলার মানুষের জন্ম হয়নি। বাংলার অপরাজেয় গণশক্তি সেদিন সার্বিক জাতীয় মুক্তি অর্জনের ইস্পাত-কঠিন শপথের দীপ্তিতে ভাস্বর প্রিয় নেতাকে দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ প্রদান করে উচ্চকিত হয়েছিল এই সেøাগানে, ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’, ‘বঙ্গবন্ধু এগিয়ে চলো আমরা আছি তোমার সাথে’, ‘তুমি কে আমি কে বাঙালী বাঙালী’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘স্বাধীন করো স্বাধীন করো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান-আবহমান বাংলার বাসন্তী সূর্য আর উদার আকাশকে সাক্ষী রেখে-নির্ভীক নেতা এবং বীর বাঙালীর কণ্ঠ একই সুরে বেঁধে দিয়েছিল। সকলের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল স্বাধীনতার অমোঘ মন্ত্র ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ দিগন্ত কাঁপিয়ে নিযুত কণ্ঠে ধ্বনি ওঠে ‘জয় বাংলা’। দিনটি ছিল রবিবার। সকাল থেকেই ধানম-ির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাসভবনটি আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্রনেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সরগরম। পূর্বঘোষিত সময় অনুযায়ী বেলা ২টায় সভা শুরু হওয়ার কথা। জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দসহ আমাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করে বঙ্গবন্ধু জনসভার উদ্দেশে যাত্রা করেন। রেসকোর্স ময়দানে তখন মুক্তিকামী মানুষের ঢল। আকারের বিশালত্ব, অভিনবত্বের অনন্য মহিমা, আর সংগ্রামী চেতনার অতুল বৈভবে এই গণমহাসমুদ্র ছিল নজিরবিহীন। চারদিকে লক্ষ মানুষের গগনবিদারী কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে ‘জয় বাংলা’। কার্যত ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই ‘জয় বাংলা’ সেøাগানটি ছিল বাঙালীর রণধ্বনি। বীর বাঙালীর হাতে বাঁশের লাঠি এবং কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ সেøাগান যেন প্রলয় রাত্রির বিদ্রোহী বঙ্গোপসাগরের সঘন গর্জন। রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের মহাসমাবেশ ঘটেছিল সার্বিক জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের পরবর্তী কর্মসূচী সম্পর্কে পথনির্দেশ লাভের জন্য। আমরা যারা সেদিনের সেই জনসভার সংগঠক ছিলাম, যারা আমরা মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর পদতলের পাশে বসেÑ ময়দানে উপস্থিত পুরনারী, অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কচি-কিশোর, তরুণ-যুবক, কৃষক-শ্রমিক-জনতার চোখে-মুখে প্রতিবাদের-প্রতিরোধের যে অগ্নিশিখা দেখেছি, তা আজও স্মৃতিপটে ভাস্বর হয়ে আছে। কিন্তু তারা ছিল শান্ত-সংযত। নেতার পরবর্তী নির্দেশ শোনার প্রতীক্ষায় তারা ছিল ব্যগ্র-ব্যাকুল এবং মন্ত্রমুগ্ধ। প্রবল উত্তেজনাময় এবং আবেগঘন মুহূর্ত ছিল সেদিন। বঙ্গবন্ধু যখন বক্তৃতা শুরু করেন জনসমুদ্র যেন প্রশান্ত এক গাম্ভীর্য নিয়ে পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে ডুবে যায়। এত কোলাহল, এত মুহুর্মুহু গর্জন নিমেষেই উধাও। আবার পরক্ষণেই সেই জনতাই সংগ্রামী শপথ ঘোষণায় উচ্চকিত হয়েছে মহাপ্রলয়ের উত্তাল জলধির মতো- যেন ‘জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার’। জোয়ার-ভাটার দেশ এই বাংলাদেশ। আশ্চর্য বাঙালীর মন ও মানস! বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমরা সভামঞ্চে এলাম ৩টা ১৫ মিনিটে। কিন্তু ঊর্মিমুখর জনতার মধ্যে অধৈর্যের কোন লক্ষণ দেখিনি। নির্দিষ্ট সময়ের বহু আগেই অর্থাৎ সকাল থেকে জনতার স্রোত এসে মিলিত হতে থাকে রেসকোর্স ময়দানে। জনস্রোতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় সভাস্থল। মানুষ গাছের উপরে উঠে বসে নেতার বক্তৃতা শোনার জন্য। সেদিনের সেই গণমহাসমুদ্রে আগত মানুষের বয়স, পেশা, সামাজিক মর্যাদা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও শ্রেণীগত অবস্থানের যতই ফারাক থাকুক না কেন, সে জনতার মধ্যে আশ্চর্য যে ঐকতান ছিল তা হচ্ছে হাতে বাঁশের লাঠি, কণ্ঠের সেøাগান আর অন্তরের অন্তরতম কোণে লালিত জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির পর কালো মুজিব কোট পরিহিত বঙ্গবন্ধু যখন মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন বাংলার বীর জনতা বজ্রনির্ঘোষে তুমুল করতালি ও সেøাগানের মধ্যে তাঁকে বীরোচিত অভিনন্দন জ্ঞাপন করে। তাঁর চোখে-মুখে তখন সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী মানুষের সুযোগ্য সর্বাধিনায়কের দুর্লভ তেজোময় কাঠিন্য আর সংগ্রামী শপথের দীপ্তির মিথস্ক্রিয়ায় জ্যোতির্ময় অভিব্যক্তি খেলা করতে থাকে। আমরা হিমালয়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তন্ময় হয়ে শুনে যাচ্ছি তার সেই দুনিয়া কাঁপানো ভাষণ। এমন সাজানো-গোছানো নির্ভুল ছন্দোবদ্ধ, প্রাঞ্জল, উদ্দীপনাময় ভাষণটি তিনি রাখলেন। কী অপরিসীম আস্থা তাঁর প্রিয় স্বদেশের মানুষের প্রতি। তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না!’ এমনকি জীবনের চেয়েও প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা তাই তিনি শোনালেন। এতটাই বিচক্ষণ ও দূরদর্শী ছিলেন যে, ভাষণে তিনি একদিকে স্বাধীনতার ডাক দিলেন, অন্যদিকে সুকৌশলে চারটি শর্তের বেড়াজালে বাঁধলেন শাসকের চক্রান্তকে এবং সামরিক শাসকের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করার পাতানো ফাঁদেও পা দিলেন না। একদিকে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ যেমন বললেন; তেমনি চার শর্তের জালে ফেললেন শাসকের ষড়যন্ত্রের দাবার ঘুঁটি। বললেন, ‘সামরিক শাসন প্রত্যাহার করতে হবে; সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে; নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে; এবং গণহত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে।’ রক্তের দাগ না মোছা পর্যন্ত অধিবেশনে যোগ না দেয়ার কথাটিও বললেন। রেসকোর্স ময়দানে প্রাণের টানে বাংলার মানুষ বারবার ছুটে আসে। এর আগেও এসেছিল ’৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি। সেদিন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসির মঞ্চ উপেক্ষা করে বাঙালী সেদিন তাঁর মুক্তির জন্য রাজপথে সেøাগান তুলেছিল। মুক্তমানব শেখ মুজিবকে মুক্ত করে বাঙালী জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। ’৭০-এর ৭ জুনে শুনেছে ৬ দফার জয়নিনাদ; আর ’৭১-এর ৩ জানুয়ারি শুনেছে ৬ দফা ও ১১ দফা বাস্তবায়নে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অগ্নিশপথ। আর ৭ মার্চের রেসকোর্স বাংলার মানুষকে শুনিয়েছে স্বাধীনতার অমোঘমন্ত্র। সেদিন রেসকোর্সে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে সম্বোধন করেছেন ‘ভায়েরা আমার’ বলে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর নির্যাতিত-মুমূর্ষু-বিক্ষুব্ধ চেতনাকে নিজ কণ্ঠে ধারণ করে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘...প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ বীর বাঙালী বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি নির্দেশ পালন করে ৩০ লক্ষাধিক প্রাণ আর ৪ লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতার লাল সূর্যটাকে ছিনিয়ে এনেছিল। ১১০৮টি শব্দ সংবলিত প্রায় ১৮ মিনিটের এই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু যা নির্দেশ প্রদান করেছিলেন আমরা তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। বঙ্গবন্ধু যখন মুক্তি সংগ্রামের রূপরেখা আর চরম আত্মত্যাগের কথা ঘোষণা করছিলেন তখন তাঁর কণ্ঠ কাঁপেনি, থামেনি-গণশক্তির বলে বলীয়ান গণনায়কের কণ্ঠ বজ্রের হুঙ্কারের মতোই গর্জে উঠেছিল। ইতিহাসের আশীর্বাদস্বরূপ নেতা আর জনতার শিরদেশে যেন বসন্তের আকাশ হতে বিদায়ী সূর্যের আলোকরশ্মি ঝরে পড়ছিল। ঐতিহাসিক সেই দুর্লভ ক্ষণটিতে আমার পরম সৌভাগ্য হয়েছিল নেতার পদপ্রান্তে বসে সাড়ে সাত কোটি বঞ্চিত-অবহেলিত-নিরন্ন নর-নারীর অবিসংবাদিত নেতার অপরূপ রূপ প্রত্যক্ষ করার। সর্বাত্মক মুক্তিসংগ্রামের অগ্নিশপথে ভাস্বর, যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত সভাস্থলের প্রতিটি নিরস্ত্র মানুষ সেদিন সশস্ত্র হয়ে ওঠে; তাদের চোখ-মুখ শত্রুর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আত্মত্যাগের অপার মহিমায় আলোকিত হয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিচক্ষণ নেতা। তিনি অত্যন্ত ভেবে-চিন্তে কথা বলতেন। সাতই মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। এই দিনটির জন্যই তিনি সারাজীবন অপেক্ষা করেছেন। মূলত এদিনেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সাতই মার্চের ভাষণ নয়, যেন মহানায়কের বাঁশিতে উঠে আসা স্বাধীনতার সুর। সেই সুরে বীর বাঙালীর মনই শুধু নয়, রক্তেও সশস্ত্র স্বাধীনতার নেশা ধরিয়ে দিল। ভাষণটি বঙ্গবন্ধু নিজ সিদ্ধান্তেই দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের সহযাত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জানিয়েছিলেন, ‘সংগ্রামী জনতার উদ্দেশে তিনি কী বলবেন তাই নিয়ে ৬ মার্চ সারারাত বঙ্গবন্ধু বিচলিত-অস্থির ছিলেন।’ বেগম মুজিব বলেছিলেন, ‘তুমি যা বিশ্বাস করো তাই বলবে।’ বঙ্গবন্ধু এমন একজন নেতা ছিলেন যে, তিনি অন্তরের গভীরে যা বিশ্বাস করতেন বক্তৃতায় তা-ই ব্যক্ত করতেন। সেই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনও শিহরিত হই। নেতার বক্তৃতার শেষাংশ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ হৃদয়ে ধারণ করে সংগ্রামী জনতার দীপ্ত সেøাগানে রাজপথ প্রকম্পিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা রাজনৈতিক সংগ্রামে জয়যুক্ত হয়ে আমরা ভৌগোলিক স্বাধীনতা, ‘শহীদের রক্তে লেখা’ পবিত্র সংবিধান, গৌরবময় জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত পেয়েছি। কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম আমাদের আজও চালিয়ে যেতে হচ্ছে। সাতই মার্চ যেমন বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে ধাবিত করেছিল, তদ্রƒপ আজ ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণরায়ে বলীয়ান হয়ে জাতির জনকের খুনীদের বিচারের রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে, সংবিধানের কলঙ্ক তিলক ৫ম সংশোধনী বাতিল করে কলঙ্কমুক্ত হয়ে, ইতিহাসের মূল স্রোতধারায় জাতির বীর সন্তানদের যথাযথ মর্যাদা প্রদান করে, ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তাদের সর্বোচ্চ দ- কার্যকর করে, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ইতিহাসের কাছে আমাদের অঙ্গীকার। লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, বাণিজ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঃড়ভধরষধযসবফ৬৯@মসধরষ.পড়স
×