ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সম্ভাবনাময় কুটির শিল্প

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ৬ মার্চ ২০১৬

সম্ভাবনাময় কুটির শিল্প

কুটির শিল্পকে এখনও যত অবমূল্যায়নই করা হোক না কেন- এই শিল্পটিই আমাদের প্রাচীন বণিক সমাজের শৈল্পিক সূতিকাগার বলা হলেও ভুল হবে না। বিচ্ছিন্নভাবে আমাদের গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষের শৈল্পিক সৃজনী ক্ষমতার প্রতিফলন হিসেবে বিকশিত হয় কুটির শিল্প। জৌলুস হারালেও বাংলার ঘরে ঘরে সেই কুটির শিল্পের অস্তিত্ব এখনও অমলিন। সেই প্রাচীন ঐতিহ্য কুটির শিল্পের বিকাশ ঘটে বিভিন্ন উৎসব, পার্বণ ও মেলার বহুমাত্রিক আয়োজনে। অবহেলিত হলেও এই কুটির শিল্প এখন শুধুই কুটির শিল্প নয়- কুটির শিল্প এখনও সমুজ্জ্বল আর্থিক চালিকাশক্তির জোরে দেশে-বিদেশে পরিচিত করছে বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতাকে। বহুকাল থেকে আমাদের কারুশিল্পীদের উৎপাদিত কুটির ও হস্তশিল্পজাত পণ্যসামগ্রী দেশীয় বাজারসহ পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত হয়ে আসছে। দেশব্যাপী কুটির ও হস্তশিল্প খাতের প্রসারের যে ব্যাপক সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে এ খাতের শিল্প ইউনিট সংখ্যার ক্রমবৃদ্ধিই এর প্রমাণ বহন করে। ১৯৬১ সালে দেশে কুটির ও হস্তশিল্পের সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার, ১৯৯১ সালে ৪ লাখ ৫ হাজার, ২০০৫-সালে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ লাখ ৭৭ হাজার। আর বর্তমানে পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে দেশে কুটির শিল্পের সংখ্যা ৮ লাখ ৩০ হাজারের অধিক। এ শিল্পকে ঘিরে কর্মসংস্থান হয়েছে ২৯ লাখেরও বেশি মানুষের। আবার দেশজ উৎপাদনে কুটির শিল্পের অবদান প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। দেশের শিল্প খাতে অগ্রগতির পথে কুটির শিল্পের এই অবস্থান নিঃসন্দেহে শুভ লক্ষণ। বরিশালের আগৈলঝাড়ায় কচুরিপানা দিয়ে তৈরি কাগজ দেশের বিভিন্ন স্থানসহ বিদেশেও পাঠানো হচ্ছে। এ কাজে ওই অঞ্চলের দেড় শ’ অসহায়-দরিদ্র মহিলা কাজ করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। ইউরোপে যাচ্ছে বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাঁচখুর গ্রামের তৈরি তালপাতার হস্তশিল্প পণ্য। বগুড়ায় তৈরি হস্তশিল্প নজর কেড়ে নিয়েছে ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক, ইতালি, নরওয়েসহ বিভিন্ন দেশের। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেছে বাংলার কাদামাটির খাঁটি সোনাÑ বাংলার টাইলস। পোড়ামাটির সোনায় হতাশা কেটে গেছে মৃৎশিল্পীদের। আধুনিক শিল্পের একটি নতুন প্রয়াস। চোখে পড়ার মতো সাফল্য। আছে আমাদের শৈল্পিক ঐতিহ্য কুমিল্লার খাদি। এ শিল্পটাকে ঘিরে কুমিল্লায় গড়ে উঠেছে বিশাল বাজার। যমুনার চর এলাকায় সাধারণ তালপাতা ও ছনের তৈরি ডালা এবং চালুন সামগ্রী অনেক পরিবারে এনেছে সচ্ছলতা, দেশের জন্য এনেছে বৈদেশিক মুদ্রা। ‘ডালাখ্যাত’ হাঁপুনিয়া গ্রামের নাম ক’জনে জানেন। কেবল গ্রামই নয়, উপজেলার প্রায় বিশ গ্রামের কয়েক হাজার নারী-পুরুষ ডালা বা ঝুড়ি অথবা বাস্কেট তৈরির হস্তশিল্পের সঙ্গে নিজেদের ভাগ্য জড়িয়ে ফেলেছেন। আর নারীর হাতের কারিগরি ছোঁয়ায় তালপাতা ও ছনের তৈরি ওই রকমারি পণ্য আজ দেশের সীমানা পেরিয়ে সুদূর ইউরোপের দেশগুলোতেও যাচ্ছে। ঝালকাঠির শীতল পাটি দেশের অন্যতম একটি কুটিরশিল্পও গৌরবময় ঐতিহ্য। ঝালকাঠির সাচিলাপুর, রামনগর, কিফাইত নগর, ডহরশংকর, হাইলাকাঠি, সরই, বাহদুরপুর, সাংগর, নীলগঞ্জ, হেলোঞ্চ ও কাজলকাটি গ্রামের প্রায় ২০০ একরজুড়ে ছড়িয়ে আছে প্রায় ১ হাজারটি পাইত্রা বাগান। এসব গ্রামে পরিকল্পিতভাবে পাইত্রা চাষ করা হয়। আর এই পাইত্রা দিয়েই তৈরি হয় শীতলপাটি। এ জেলার প্রায় ৬০০ পরিবার সরাসরি পাটি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এক সময় আমাদের হস্তশিল্পের বাজার ছিল শুধু ইউরোপের কয়েকটি দেশে। স্বাধীনতা-উত্তর এ খাতে দেশের রফতানি আয় ছিল মাত্র শূন্য দশমিক তিন মিলিয়ন টাকা। নব্বই দশকে এই খাতের আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২১১ মিলিয়ন টাকায়। তারপর উর্ধমুখী কুটির শিল্পের রফতানি বাজার। নতুন নতুন সংযোজন এই শিল্পের সম্ভাবনাকে পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় বর্তমানে বাংলাদেশের হস্ত ও কুটির শিল্পজাত পণ্যের প্রধান বাজার হচ্ছেÑ যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, স্পেন, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফিনল্যান্ড, সুইডেন ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে। এই শিল্প বাজারের পরিব্যাপ্তি বিকাশের গতিধারা সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। শিল্প খাতে রফতানি বৃদ্ধির জন্যই দেশের কুটির ও হস্তশিল্পের প্রসার ঘটানো প্রয়োজন। স্বল্পপুঁজিতে অধিক কর্মসংস্থান, আয় ও উৎপাদন বাণিজ্যে অনেক বেশি অবদান রাখতে পারে। এজন্য ওই খাতে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে তা সমাধানের লক্ষ্যে বাস্তব ও কার্যকর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। একটি বৃহৎ পরিকল্পনায় অগ্রসর হলে এই কুটির শিল্প দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে রেনেসাঁ ঘটাবে এতে কোন সন্দেহ নেই। বৈশাখ এলেই আমরা দেখি, কুটির শিল্পের কদর শহুরে মানুষের কাছে বেড়ে যায়। কিন্তু আমরা যদি একে সবসময়ই ধারণ করতে পারি, বিদেশী পণ্যের পরিবর্তে এগুলোতে অভ্যস্ত হতে পারি, তাহলে কুটির শিল্প আর খুঁড়িয়ে হাঁটবে না। বাড়বে কর্মসংস্থান, বাড়বে রফতানি আয়। এগিয়ে যাবে দেশ। রাশেদ আহমেদ শিপলু
×