ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকাইয়া ব্যাঙ- আবিষ্কার করলেন তরুণ বিজ্ঞানী সাজিদ

দেড় শ’ বছর পর দেখা মিলল নতুন প্রজাতির বন্যপ্রাণীর

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ৬ মার্চ ২০১৬

দেড় শ’ বছর পর দেখা মিলল নতুন প্রজাতির বন্যপ্রাণীর

আনোয়ার রোজেন ॥ সময়টা ১৮৬০ এর দশক। ম্যালাকোলজিস্ট (শামুক প্রজাতির প্রাণী বিশেষজ্ঞ) এবং ন্যাচারালিস্ট হিসেবে ততদিন বেশ বিখ্যাতই হয়ে উঠেছেন উইলিয়াম থিওবল্ড। বার্মার (বর্তমানে মিয়ানমার) বিভিন্ন জলাধার ও ঘন জঙ্গলে নতুন নতুন প্রাণীর অনুসন্ধান পর্ব শেষে জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার এই কর্মকর্তা তখন ঢাকায়। ঢাকা তখন গাছপালা, জলাধার, ঘন ঝোপজঙ্গলে ঢাকা। ব্রিটিশ ভারতের সেই ঢাকায় নাম না জানা অনেক বন্য প্রাণীরই বসবাস ছিল। থিওবল্ড নেমে গেলেন অনুসন্ধানে। কিছুদিনের মধ্যেই ঢাকার একটি জলাধার থেকে আবিষ্কার করলেন নতুন প্রজাতির শামুক। এরপর দেড় শ’ বছর পেরিয়ে গেছে। ঢাকা এখন পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ মেগা সিটি। জঞ্জাল আর ঝঞ্জাটের শহর ঢাকা। দূষণে দূষণে প্রাণের প্রতিকূল এই মেগা সিটি। আর পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ সেই শহরেই মিলল নতুন প্রজাতির বণ্যপ্রাণী। ভিনদেশী কেউ নন, দেড় শ’ বছর পরে ঢাকায় নতুন প্রজাতির কোন বন্যপ্রাণী আবিষ্কার করলেন ঢাকারই এক সন্তান। তরুণ প্রাণী বিজ্ঞানী সাজিদ আলী হাওলাদার। সম্প্রতি নতুন প্রজাতির আরও একটি ব্যাঙ আবিষ্কার করেছেন তিনি। তার এই আবিষ্কারের কথা প্রকাশ করেছে বিশ্বজুড়ে খ্যাতনামা বিজ্ঞান চর্চার প্লাটফরম পাবলিক লাইব্রেরি অব সায়েন্সের (প্লস) উন্মুক্ত জার্নাল ‘প্লস ওয়ান’। ২ মার্চ প্লস ওয়ানের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ‘অ ঘবি ঝঢ়বপরবং ড়ভ ঋৎড়ম (অহঁৎধ: উরপৎড়মষড়ংংরফধব) উরংপড়াবৎবফ ভৎড়স ঃযব গবমধ ঈরঃু ড়ভ উযধশধ’ শিরোনামে সাজিদ আলী হাওলাদারের নতুন গবেষণা কর্মের রিভিউ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর অন্যতম বাংলাদেশের ঢাকা থেকে ‘জাকেরানা’ গণপর্বের একটি নতুন প্রজাতির ব্যাঙ আবিষ্কৃত হয়েছে। যদিও নতুন প্রজাতিটি দৃশ্যত ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশে প্রাপ্ত ব্যাঙ দলের অনুরূপ। আমরা দেখতে পেয়েছি, অঙ্গসংস্থানগত চরিত্র, স্বরের ভিন্নতা, মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএর গঠনের দিক থেকে এটি অন্যান্য ব্যাঙের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। ফেসবুকে সাজিদ আলী জানান, ঢাকার নামে ব্যাঙটির নামকরণ করা হয়েছে ুধশবৎধহধ ফযধশধ. আর বাংলায় এর নাম ‘ঢাকাইয়া ব্যাঙ’ রাখার প্রস্তাব করেছেন সাজিদ। তিনি জানান, ুধশবৎধহধ ব্যাঙের একটি গণ, যা উরপৎড়মষড়ংংরফধব পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা কাজী জাকের হোসেনের প্রতি সম্মান দেখিয়ে এই গণের নাম ‘জাকেরানা’ রাখা হয়েছে। সাজিদ জানান, ব্যাঙের নতুন প্রজাতি পাওয়ার ক্ষেত্রে এটা পঞ্চম সাফল্য। ২০১১ সালে তার আবিষ্কৃত এনডেমিক প্রজাতির ব্যাঙ ভবলবৎাধৎুধ ধংসধঃর প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। পরে অবশ্য গণ বদলে এর নামকরণ করা হয় তধশবৎধাধ ধংসধঃর. এদিকে নতুন প্রজাতির ব্যাঙের আবিষ্কারের খবর জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার পর ৩ মার্চ সাজিদ তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন, সব চিন্তাকে আরেকবার ভুল প্রমাণ করে দিল এই প্রাথমিক ফলাফল। পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরেই পাওয়া গেল একটা নতুন প্রজাতির ব্যাঙ, যার পরিচয় ছিল পুরো পৃথিবীর মানুষের কাছেই অজানা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো ব্যাঙটি আবিষ্কৃত হলো গণভবন এবং সংসদ ভবন এলাকা থেকেই। এই প্রজাতির ব্যাঙের শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেও বর্ষাকালে দেখা মেলে। তরুণ এই বিজ্ঞানীর বিশ্বাস রাজধানীতে আরও অনেক নতুন প্রজাতির প্রাণী লুকিয়ে আছে। কিন্তু যেভাবে রাজধানীর যত্রতত্র আবাসিক, বাণিজ্যিক ভবন আর মার্কেট গড়ে ওঠছে তাতে এসব প্রাণীর বিলুপ্তির আশঙ্কাও স্পষ্টভাবে জানালেন সাজিদ। তিনি লিখেছেন, ব্রিটিশ ভারতের ঢাকায় অনেক গাছপালা, জলাধার এবং নাম না জানা অনেক বন্যপ্রাণীরই বসবাস ছিল। আজ ঢাকায় অনেক মানুষের বসবাস, ঢাকা এখন পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ মেগা সিটি। জলাধার, গাছপালা দিন দিন কমে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে বন্যপ্রাণী হয়ত আমাদের জানার আগেই চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর বুক থেকে। নাম না জানা সেই সব প্রজাতির বাসস্থানের ওপর গড়ে উঠছে বিভিন্ন নামের ভবন আর মার্কেট। তাই ঢাকায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বন্যপ্রাণী এবং অজানা সেই সব প্রজাতির খোঁজে আবার অভিযান শুরু হয়েছিল ২০১২ এর শুরু থেকে। এভাবেই সর্বশেষ ঢাকায় আবিষ্কৃত নতুন প্রজাতির ব্যাঙের অনুসন্ধানে নামার কারণ ব্যাখ্যা করেন এই বিজ্ঞানী। সাজিদের আবিষ্কার প্রসঙ্গে তার এক সময়ের গবেষণা সহকারী ও প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআইবি) সহকারী প্রশিক্ষক নাসিমূল আহসান জনকণ্ঠকে বলেন, চার বছর আগে গায়ে বৃষ্টি কাদা মেখে গণভবন, সংসদ ভবন এলাকায় সাজিদের সঙ্গে ব্যাঙ খোঁজাখুঁজি করেছি। আজ তার সাফল্যে আমি ভীষণ খুশি। গাছপালা, জলাধারকে খুন করে আমরা ঢাকাকে ইট-কাঠের জঙ্গল তৈরি করছি। ‘ঢাকাইয়া ব্যাঙে’র মতো আরও কত ব্যাঙ, বন্যপ্রাণী প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে- সেই খোঁজ কে রাখে! এ বিষয়ে সাজিদের ওই সময়ের আরেক গবেষণা সহকারী ও কৃষি আন্দোলন কর্মী তপু রায়হান জানান, সাজিদের এই অর্জন আমাদের গর্বিত করেছে। বিশ্বের কাছে আমাদের নতুন রূপে পরিচয় করাচ্ছে। সরকার তার জন্য কি করবে জানি না, কিন্তু সে যখন দেশে আসবে, আমরা বন্ধুরা মিলে বিমানবন্দরে তার জন্য ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব। প্রসঙ্গত, সাজিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে ২০১১ সালে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। স্নাতকোত্তর করার আগেই ফিনল্যান্ডের হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে জীববিজ্ঞান বিভাগে ব্যাঙের শ্রেণীবিন্যাস বিদ্যার (ট্যাক্সোনমি) ওপর গবেষণা করার আমন্ত্রণ জানায়। বর্তমানে ফেলোশিপ নিয়ে তিনি সেখানেই পিএইচডি করছেন। কাজের পরিকল্পনায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম ক্যান্সারের বায়োডাইভার্সিটি ইনস্টিটিউট, পর্তুগালের লিসবন বিশ্ববিদ্যালয়, ইতালির ন্যাচারাল মিউজিয়ামসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী মহলের সহায়তা পেয়েছেন। ২০০৪ সালে চবি প্রাণিবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন সাজিদ। এরপর থেকে ব্যাঙ, পাখি নিয়ে তার পথচলা। ব্যক্তিগতভাবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাঙের জীবনপ্রণালি ও বংশবৃদ্ধি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা চালান তিনি। এ সময় তিনি ব্যাঙের বংশ বৃদ্ধির জন্য হটস্পট হিসেবে পরিচিত চবির কাটাপাহাড় রাস্তার দু’পাশ থেকে বিভিন্ন ব্যাঙের নমুনা সংগ্রহ করতে থাকেন। এর মধ্যে ২০০৮ সালে একদিন পেয়ে যান বিরল প্রজাতির একটি ব্যাঙ। স্বভাব মতো সেটিকে তিনি ব্যক্তিগত সংরক্ষণাগারে নিয়ে গিয়ে এটির প্রজাতি ও প্রকৃতি উদ্ধারের কাজে লেগে যান। কিন্তু সারাবিশ্বে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত ও তালিকাভুক্ত সাড়ে ছয় শ’ প্রজাতির মধ্যেও এ ব্যাঙের অস্তিত্ব খুঁজে পাননি তিনি। তারপর শুরু হয় অন্য ধরনের গবেষণা। এ ব্যাঙের ব্যতিক্রমী ডাক ও বৈশিষ্ট্য বের করতে তিনি যোগাযোগ করেন বিশ্বের সেরা সব প্রাণী বিজ্ঞানীদের সঙ্গে। দীর্ঘদিন ধরে পর্তুগাল, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের সহযোগিতায় ব্যাঙের ডাকের সাউন্ড এনালাইসিস এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নিশ্চিত হন যে, এ ধরনের ব্যাঙের অস্তিত্ব একমাত্র বাংলাদেশেই পাওয়া গেছে। পরবর্তীতে তিনি বিশ্বের সেরা প্রাণী বিজ্ঞানীদের সম্পাদনায় প্রকাশিত বন্যপ্রাণীর শ্রেণীবিন্যাসের কাজে নিয়োজিত জার্নাল জুট্যাক্সাতে এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ পাঠান। ওই জার্নাল কর্তৃপক্ষ তার আবিষ্কারের সত্যাসত্য যাচাইয়ের পর চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি প্রবন্ধটি গ্রহণ করেন। এরপর গত ৯ ফেব্রুয়ারি জুট্যাক্সা’র ২৭৬১ ভলিউমে এটি প্রকাশিত হয়। সাজিদ ২০১৩ সালে ফিনল্যান্ডের ‘হেলসিঙ্কি কালচারাল ফাউন্ডেশন এ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। ফেসবুকে এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, আগামী বছরই পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরতে চান। কাজ করতে চান দেশে থাকা অজানা বন্যপ্রাণীর অরণ্যে।
×