ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বসন্তের ভাঁটে মুগ্ধ প্রকৃতি

পথের ধারে অনাদরে ফোটা সাদা সুগন্ধী বনফুল

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৬ মার্চ ২০১৬

পথের ধারে অনাদরে ফোটা সাদা সুগন্ধী বনফুল

মোরসালিন মিজান ॥ অন্য সময় গাছটিকে আলাদা করা যায় না। পথের ধারে বনে জঙ্গলে আপনি হয়। অনাদরে বেড়ে ওঠে। আগাছাদের সঙ্গে বাস। মিলে মিশে থাকে। তবে এই বসন্তে স্বতন্ত্র চেহারায়। একই গাছ আর সব গাছ থেকে আলাদা হয়ে ধরা দিচ্ছে। পথিক নতুন চোখে সেদিকে তাকাচ্ছেন। তাকাতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ আর কিছু নয়, এর ফুলের সৌন্দর্য। বাংলার প্রতি প্রান্তে ফোটা এ ফুলের নাম ভাঁট। যেমন দেখতে, তেমনি মিষ্টি ঘ্রাণ। অস্থানে জন্ম নেয়া সহজলভ্য ফুল হলেও, দারুণ মুগ্ধ করে রেখেছে। ভাঁটফুল একই সঙ্গে ভাঁটি নামে পরিচিত। নিজের বিভিন্ন লেখায় কবিগুরু ফুলটিকে ‘ভাঁটি’ নামে সম্বোধন করেছেন। কোন এক প্রকৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, আশপাশে ভাঁটিফুল ফুটিয়া/ রয়েছে দলে দলে...। ভাঁটফুলের আরেক নাম ঘণ্টাকর্ণ। রবীন্দ্রনাথের ‘সে’ শিরোনামে লেখা গল্পটিতে পাওয়া যায় এই ঘণ্টাকর্ণকে। গল্পের একটি চরিত্র ঘণ্টাকর্ণ। এর দুই কানে দুই ঘণ্টা। লেজও দুটি। দুই লেজে দুই হাতুড়ি। ওগুলো দিয়ে নিজেই নিজের ঘণ্টা বাজিয়ে যায়! আর রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ লিখেছিলেনÑ বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়...। হ্যাঁ, বেহুলার পায়ের ঘুঙুরকে তিনি ভাঁটফুলের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। প্রিয়তম পতি লক্ষ্মীন্দরকে সাপে কাটার পর সতী স্ত্রী বেহুলা তাঁকে বাঁচানোর সব চেষ্টা করেন। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে নেতাই ধোপানির সঙ্গে যান স্বর্গলোকেও। ইন্দ্রকে সন্তুষ্ট করতে রাজসভায় নাচতে হয় তাকে। রূপসী বাংলার কবি সেই নৃত্যরত বেহুলাকে কল্পনার চোখে দেখেন। পায়ে পরিয়ে দেন ভাঁটফুলের ঘুঙুর। এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ফুটে আছে ভাঁট। বিশেষ করে গ্রামে খুব দেখা যাচ্ছে। গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ রাস্তার ধারে, জঙ্গল বা বনের আশপাশ এলাকায় ফুটে আছে। কারও যতেœর দরকার হয় না। কেউ তেমন ঘরে তুলে নেন না। তাতে কী? নিজ উদ্যোগে বেঁচে থাকে গাছ। এর গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল। ছোট সাদা পাঁচটি পাপড়ি। চারটির মতো সাদা লম্বা কেশর। ফুলের মাঝখানে হলুদের ওপর হাল্কা মেরুন রঙের ছোঁয়া। কেশরের অগ্রভাগে আবার বেগুনি রঙের রেণু। উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মা জানান, ভাঁটের উদ্ভিদ তাত্ত্বিক নাম ক্ল্যারোডেনড্রাম ভিসকোসাম ভেন্ট। এর পাতা চার ইঞ্চি থেকে সাত ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। ডিম্বাকৃতি পাতার আগা সরু। খসখসে। বোঁটা ১ থেকে ৩ ইঞ্চি লম্বা। মঞ্জরিদ- ১২ ইঞ্চির মতো। গাছ মাটি থেকে খুব উপরে ওঠে না। এর কচি কা-। গায়ে নরম রোম হয়। ফুলের বাইরের আবরণেও রোম থাকে। ভাঁটফুলের আছে ঔষধি গুণ। সেই গুণের কথা বেশ মজা করে লিখেছেন বিপ্রদাশ বড়ুয়া। লেখাটি এরকমÑ ঘণ্টাকর্ণের বিয়ে হয়েছিল বসন্ত-বিষফোঁড়া রোগের দেবী শীতলার সঙ্গে। এই ঘণ্টাকর্ণ, ঘেঁটু বা ভাঁটে জ্বর চর্মরোগ বিছের হুল ফোটানোতে ওষুধের কাজ করে। আর কী আশ্চর্য বসন্তকালে এসব রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। এমনকি ম্যালেরিয়া জ্বরে, পা-ু রোগে, অজীর্ণে এর রস কাজ করে ওষুধের মতো। এজন্য চৈত্রসংক্রান্তিতে ঘণ্টাকর্ণ বৃক্ষের আরাধনা করা হয় চর্মরোগ নিবারণের জন্য। তিনি জানাচ্ছেন, এখনও গ্রামের মানুষ জ্বর হলে এর পাতার রস খেয়ে থাকে। ক্রিমি, পুরনো শূল বেদনা দূর করতে ভাঁট একটি উৎকৃষ্ট ভেষজ। বৈদ্যদের পাশাপাশি ইউনানি হেকিমেরাও এর ব্যবহার করেন বলে লেখায় উল্লেখ করেছেন বিপ্রদাশ বড়ুয়া। তবে পরিশেষে ফুলটির রূপ আর মিষ্টি ঘ্রাণের কথাই প্রধান হয়ে ওঠে।
×