ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সেই ‘বশির চাচা’ নিজেই যা বললেন-

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৬ মার্চ ২০১৬

সেই ‘বশির চাচা’ নিজেই যা বললেন-

বিভাষ বাড়ৈ ॥ মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে পাকিস্তানী সমর্থককে জোর করে বাংলাদেশের পতাকা পরিয়ে হেনস্থা করার খবরকে অপপ্রচার বলে উল্লেখ করেছেন সেই সমর্থক ‘বশির চাচা’ নিজেই। বিবিসির একটি বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রচারের পর তোলপাড় সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে বশির চাচাই বলেছেন, ‘আমাকে কেউ হেনস্থা করেনি। বাংলাদেশ জেতার পর আমি নিজেই সেদিন বাংলাদেশের পতাকা গায়ে জড়িয়েছিলাম, কেউ আমাকে জোর করেনি। যারা আমাকে হেনস্থার খবর প্রচার করেছেন তারা আসল ঘটনা না জেনে অপপ্রচার করেছেন।’ বাংলাদেশের প্রতি নিজের ভালবাসার কথা জানিয়ে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ খুবই ভাল। ১৯৭১ সালে আমি খুবই ছোট ছিলাম। তারপরও তখন বাংলাদেশে যা হয়েছে আমি তার জন্য অত্যন্ত দুঃখিত। আল্লাহতায়ালা তার জন্য পাকিস্তানকে শাস্তিও দিচ্ছেন। মোহাম্মদ বশির বা বশির চাচার কোন বক্তব্য ছাড়াই বিবিসির প্রতিবেদন প্রচারের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরও ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে বিষয়টি। ফেসবুকের ভুয়া আইডির মাধ্যমে প্রচার হওয়া একটি বিষয় ছড়িয়ে পড়লে কয়েকজনের স্ট্যাটাস দেখে বিবিসি একটি সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। ঘটনাকে কেন্দ্র করে এখন বাংলাদেশের ভারমূর্তি ক্ষুণেœর দায়ে বিবিসি বা অন্যদের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগসহ অন্য মাধ্যমে। জানা গেছে, ৬২ বছর বয়সী শিকাগোর একটি রেস্তরাঁর মালিক বশির চাচা গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পৌঁছেন। তিনি ভারত-পাকিস্তানের পতাকা সংবলিত একটি পোশাক পরেন। যার অর্ধেকে থাকে পাকিস্তানী পতাকা, অর্ধেকে থাকে ভারতের। তিনি পাকিস্তানী হলেও তার স্ত্রী রাফিয়া ভারতীয়। গত বুধবার এশিয়াকাপে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের খেলার পরে বশিরের গায়ে জোর করে বাংলাদেশী পতাকা পরানো হয়েছে বলে ফেসবুকে কিছু ছবি ছড়িয়ে পড়ে। ফেসবুকের বিভিন্ন পোস্টের সূত্রে জানা গেছে, পাকিস্তানী এ নাগরিক পৃথিবীর যেখানেই পাকিস্তানের খেলা হয় সেখানেই নিজ দেশের খেলা দেখতে হাজির হন, সমর্থন দেন নিজ দেশকে। ফেসবুকের ছবিতে দেখা যায়, মিরপুরের সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লা চেয়ারে বসে রয়েছেন এবং বয়স্ক পাকিস্তানী সমর্থক কাঁদছেন তার সামনে দাঁড়িয়ে। সেই মুহূর্তে চারপাশে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েক নারী-পুরুষ দৃশ্যটি উপভোগ করছেন, হাসছেন এবং কেউ কেউ তার সঙ্গে সেলফি তুলছেন, কেউবা ক্যামেরাবন্দী করছেন সেই মুহূর্তটি। ছবিগুলো ভার্চুয়াল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ফেসবুকে এ ঘটনায় তদন্তও চাইছেন কেউ কেউ। তবে তখনই অনেকে একে ভুয়া ফেসবুক আইডি থেকে পোস্ট করা মিথ্যা তথ্য বলে উল্লেখ করেছেন। ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লাকি আক্তারের ফেসবুক স্ট্যাটাসের সূত্র ধরেই মূলত ওই খবরটি প্রচার করে বিবিসি বাংলা। যদিও লাকি আক্তার পরে তার স্ট্যাটাসটি ফেসবুক থেকে ডিলিট করে দিয়েছেন। বিবিসির প্রতিবেদনের পর আইসিসিসহ আন্তর্জাতিক মহলের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে বার্তা যায় যে, মিরপুর স্টেডিয়ামে আমেরিকা প্রবাসী ক’জন পাকিস্তানী সমর্থককে হেনস্থা করার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে পাকিস্তানী ওই সমর্থককে জোর করে বাংলাদেশের পতাকা পরানো হয়েছে। এমনকি তিনি লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আওয়ামী লীগের এমপি ইলিয়াস মোল্লার উপস্থিতিও রয়েছে ওসব ছবিতে। ঘটনা প্রচারের পর থেকেই বিষয়টিকে মিথ্যা বলে দাবি করে আসছিলেন সংসদ সদস্য। তবে তাতেও সমালোচনার হাত থেকে রক্ষা পাননি। অনেকে ঘটনা বিশ্বাস করে ইলিয়াস মোল্লা এমনকি আইসিসির কাছে বাংলাদেশের ক্ষমা চাওয়ারও আবদার তুলে বসেন। এসব ঘটনায় যখন তোলপাড় চলছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তখন রীতিমতো বোমা ফাটালেন সবার প্রিয় বশির চাচা নিজেই। গত দুদিনে একাধিক ভিডিও এবং অডিও সাক্ষাতকারে ঘটনাকে অপপ্রচার উল্লেখ করেছেন তিনি। একই সঙ্গে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের প্রতি তার ভালবাসার কথা বাংলাদেশের একটি অনলাইন পত্রিকায় দেয়া ভিডিও সাক্ষাতকারে পাকিস্তানী ক্রিকেট সমর্থক বশির চাচা বলেছেন, কেউ কেউ বলছেন সেদিন ওখানে আমাকে হেনস্থা করা হয়েছে কিন্তু আমি বলতে চাই, নাথিং হ্যাপেন্ড, নাথিং হ্যাপেন্ড। নো বডি ফোর্সড মি, আফটার বাংলাদেশ উইন আই ক্যারিড বাংলাদেশ ফ্ল্যাগ, বলাথা বাংলাদেশ জিতেগা। আই টুক দি বাংলাদেশী ফ্ল্যাগ। কেউ কেউ বলছেন আমি কেঁদেছি, আমি বলতে চাই আমি একজন পাকিস্তানী সমর্থক, আমি চেয়েছি পাকিস্তান জিতুক সেখানে পাকিস্তান হেরে গেছে আমার তো তখন কষ্ট হতেই পারে। আমাকে কেউ হেনস্থা করেনি এবং খেলায় বাংলাদেশ জেতার পর আমি নিজেই সেদিন বাংলাদেশের পতাকা গায়ে জড়িয়েছিলাম, কেউ আমাকে জোর করেনি। যারা আমাকে হেনস্থার খবর প্রচার করেছেন তারা আসলে আসল ঘটনা না জেনে অপপ্রচার করেছেন, এমনকি কেউ ঘটনা জানার জন্য আমার সঙ্গে কথাও বলেনি। বিষয়টি আমাকে আহত করেছে। এছাড়া বশির চাচা একই অডিও সাক্ষাতকারও দিয়েছেন। এসব সাক্ষাতকারে বশির চাচা বলেন, বাংলাদেশে এইবার নিয়ে আমি তিনবার এলাম। কিন্তু কখনও বাংলাদেশের কেউ আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি, যতবার আসি ততবার এই একই হোটেলে থাকি। এখানকার সবাই আমার পরিচিত, বাংলাদেশের সবাইকে নিয়ে আমি খুবই হ্যাপি, বাংলাদেশের মানুষ খুবই ভাল। দু’একজন খারাপ হতেই পারে তার মানে এই না যে, এখানকার সবাই খারাপ। আমি কখনও মিথ্যা বলি না, এখনও মিথ্যা বলব না। আর মিথ্যা বলার দরকারও নেই। আমার সঙ্গে সেদিন স্টেডিয়ামে অপ্রীতিকর কিছুই হয়নি এবং আমাকে জোর করে কেউ বাংলাদেশের পতাকা পরাননি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ, ভারতসহ যে কোন দেশই হারুক না কেন, সেই দেশের সমর্থকরা কাঁদেন এবং সেই দৃশ্য টেলিভিশনে দেখানো হয়। তার মানে কি তাদেরকেও জোর করে কাঁদানো হয়ে থাকে। তাহলে কেন আপনাকে নিয়ে এই অপপ্রচার জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছবিগুলো কে তুলেছেন, কেন তুলেছেন; তিনি জানেন না। তবে যারা এগুলো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ এবং প্রচার করেছেন তারা কেউ তার সঙ্গে কথা বলেননি। তিনি নিজেই একাত্তরের কথা তুলে সাক্ষাতকারে বলেন, ‘আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ১৯৭১ সালে আমি খুবই ছোট ছিলাম। তারপরও তখন বাংলাদেশে যা হয়েছে আমি তার জন্য অত্যন্ত দুঃখিত। আল্লাহতায়ালা তার জন্য পাকিস্তানকে শাস্তিও দিচ্ছেন। পাকিস্তানে এখন নানাবিধ সমস্যা। আমি বাংলাদেশের মানুষকে বলতে চাই, আমাকে মাফ করে দাও, আমি স্যরি। আমি ভারতীয় ক্রিকেট তারকা ধোনিকে ভালবাসি, পাকিস্তানকে ভালবাসি। কারণ সেখানে আমার জন্ম। একই সঙ্গে আমি বাংলাদেশকেও ভালবাসি। অভিযুক্ত সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লা সম্পর্কে বশির আহমেদ বলেছেন, তিনি সেখানে বসেছিলেন কিন্তু তিনি আমাকে কিছু বলেননি এবং এর সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। আদতে সেখানে কিছু ঘটেওনি। আই লাভ আমজাদ ভাই, আই লাভ বিসিবি ডিরেক্টর ববি ভাই, তিনি আমাকে সব সময় টিকেট দেন, সব সময় আমার খোঁজ নেন। আমি চাই বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সবাই সবাইকে ভালবাসবে, আর যুদ্ধ কেন। এই যুদ্ধের অবসান হোক। এদিকে এবার বাংলাদেশের ভারমূর্তি ক্ষুন্নের দায়ে বিবিসি বা অন্যদের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগসহ অন্যান্য মাধ্যমে। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিবিসি বাংলার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। বিবিসি বাংলার মতো একটি সংবাদ সংস্থা কোন যাচাইবাছাই ছাড়া এ ধরনের সংবাদ প্রকাশ করায় তারা বিস্মিত! আনিসুর সুমন নামে একজন ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘ফেসবুক থেকে ছবি আর কয়েকজনের স্ট্যাটাস নিয়ে বিবিসি কীভাবে এমন স্পর্শকাতর সংবাদ ছাপাল? কেন এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে খোঁজখবর না নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করল? আসলে কি উস্কানি দেয়া হচ্ছে না? ভূপেন কিশোর দাস নামে একজন লিখেছেন, মিথ্যা নিউজ করে দেশের মানমর্যাদা ছোট করে লাভ কি? শরিফ নামের একজন লিখেছেন, আন্তর্জাতিকভাবে দেশ, দেশের সংসদ ও দেশের ক্রিকেটের ওপর কালিমা আরোপের জন্য দায়ী সব ষড়যন্ত্রকারীকে গুজব ছড়াবার অপরাধে আইনের আওতায় আনা হোক। জাতির এত বিবেকের দরকার নেই। অন্যের পোস্টের রেফারেন্স দিয়ে দায় এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। মলয় দাস নামে একজন লিখেছেন, খেলার দিনে গ্রান্ড স্ট্যান্ডের যে গ্যালারিতে বশির সাহেব ছিলেন, সেই গ্যালারিতেই আমরা ছিলাম। তাই তো তাকে লাঞ্ছিত করার এই খবর দেখে অবাক হচ্ছি! সেই সঙ্গে কিছু সো-কল্ড চেতনাধারী সেই গুজবকে সত্য বলে প্রমাণ করার চেষ্টা দেখে বিস্মিত হচ্ছি।
×