ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বনশ্রীতে মায়ের হাতে দুই সন্তান খুন

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৬ মার্চ ২০১৬

বনশ্রীতে মায়ের হাতে দুই সন্তান খুন

গাফফার খান চৌধুরী ॥ পড়াশোনা নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকায় মায়ের হাতে দুই সন্তান খুন হওয়ার বিষয়টি বিশ্বাস করতে পারছেন না অনেকেই। পরিবারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, নিশ্চয়ই এর পেছনে আরও কোন কারণ আছে। আর চিকিৎসকরা বলছেন, কোন প্রকার চেতনানাশক ওষুধ প্রয়োগ না করে বারো তেরো বছরের একজনকে কারো একার পক্ষে হত্যা করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এমন মন্তব্য করেছেন নিহতদের লাশ উদ্ধারকারীরাও। যদিও নিহতদের মায়ের বরাত দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, দুই সন্তানকে মা একাই হত্যা করেছেন। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর রামপুরা থানাধীন বনশ্রীর বি ব্লকের ৪ নম্বর সড়কের ৯ নম্বর জিএম এ্যাপার্টমেন্ট লিমিটেডের তৈরি জিএম শাহনূর নামের সাততলা বাড়ির লিফটের চতুর্থ তলার পূর্ব দিকের ৫/এ নম্বর ফ্ল্যাট থেকে নুসরাত আমান অরণী (১২) ও তার সহোদর ভাই আলভী আমানের (৭) রহস্যজনক মৃত্যু হয়। অরণী সিদ্ধেশ্বরীতে অবস্থিত ভিকারুননেসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের স্কুল শাখার পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী আর বাড়ি থেকে মাত্র দু’শ’ গজ সামনেই অবস্থিত হলি ক্রিসেন্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এ্যান্ড কলেজের স্কুল শাখার নার্সারি ক্লাসের ছাত্র ছিল আলভী আমান। খাদ্যে বিষক্রিয়ায় দুই শিশুর মৃত্যু হয় বলে প্রথমে অভিযোগ উঠেছিল। তারই প্রেক্ষিতে খাবার সরবরাহকারী বনশ্রীর ক্যান্ট নামের চাইনিজ রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার মামুনুর রহমান মাসুদ, প্রধান বাবুর্চি আসাদুজ্জামান রনি ও তার সহযোগী আতাউরকে আটক করে পুলিশ। এছাড়া র‌্যাব নিহতদের বাস্থানের নিরাপত্তা কর্মী পিন্টু (৩০) ও ফেরদৌস (২৮) এবং নিহতদের গৃহশিক্ষিকা শিউলী আক্তার (২৮), নিহতদের খালু নজরুল ইসলামের ভাগ্নে শাহীন (২২), নিহতদের মায়ের মামাতো ভাই ওবায়দুর ইসলামকে (৩৪) ঢাকা থেকে আটক করে। এছাড়াও জামালপুর থেকে নিহতদের পিতা গার্মেন্টস এক্সেসরিজ ব্যবসায়ী মোঃ আমানউল্লাহ আমান (৩৯), নিহতদের মা মামলার একমাত্র আসামি মাহফুজা মালেক জেসমিন (৩৬) এবং খালা আফরোজা মালেক মিলাকে (৩২) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকায় আনে। র‌্যাবের কাছে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দী দেন নিহতদের মা। এরপর বৃহস্পতিবার রাতে স্বামীর দায়ের করা মামলায় একমাত্র আসামি করা হয় স্ত্রীকে। মামলা দায়েরের পর আটক সবাইকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জনকণ্ঠকে জানান, জিজ্ঞাসাবাদে নিহতদের মা দুই সন্তানকে একাই হত্যা করেছেন বলে দাবি করেন। হত্যার কারণ হিসেবে মায়ের দাবি, ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে তিনি খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। ছেলেমেয়েরা ভবিষ্যতে তেমন কিছুই করতে পারবে না। এজন্য তিনি তাদের হত্যা করেছেন। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা রামপুরা থানার পরিদর্শক মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, ঘটনার দিন গৃহশিক্ষিকার কাছে অরণী পড়া পারেনি। পড়া না পারার কারণ জানতে চান গৃহশিক্ষিকা। এ সময় অরণী গৃহশিক্ষিকাকে বলে, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রবিবার রাতে তারা চাইনিজ খেতে গিয়েছিল। এজন্য সময়মতো পড়া শিখতে পারেনি। বিষয়টি মা শুনে ফেলে। গৃহশিক্ষিকা চলে গেলে মা অরণীকে ডাক দেয়। পড়া না পারার কারণ জানতে চায়। অরণী আবার একই কথা বললে, মায়ের প্রচন্ড রাগ হয়। তারই জের ধরে মায়ের সঙ্গে অরণীর কথা কাটাকাটি শুরু হয়। এক পর্যায়ে মা রাগ করে অরণীর গলা চেপে ধরে। ধস্তাধস্তির সময় অরণীর নাকে মুখে গালে মায়ের নখের আচড় লাগে। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তারা বিছানা থেকে নিচে পড়ে যায়। নিচে পড়ে যাওয়ার পর মা আরও রাগ করেন। তিনি রাগের বশবর্তী হয়ে অরণীর বুকের উপর চেপে বসেন। এরপর অরণীর গলায় থাকা ওড়না দিয়েই অরণীর গলা চেপে ধরেন। এতে অরণী মারা যায়। এরপর ছেলের দিকে তাকিয়ে মনে করে, ছেলেও তো কথা শোনে না। অতএব ছেলেকেও মেরে ফেলবো। এরপর অরণীর গলা থেকে ওড়না নিয়ে আলভীর গলায় বেঁধে তাকেও শ্বাসরোধে হত্যা করেন। হত্যার পর লাশ নিয়ে কতক্ষণ কান্নাকাটি করে। এরপর পাশের ৫ নম্বর সড়কের ৬ নম্বর বাড়িতে বসবাস করা ছোট বোন আফরোজা মালেক মিলাকে ফোন করেন। আফরোজা মালেক মিলা জনকণ্ঠকে জানান, ফোন করে আপা বলেন, অরণী আর আলভী কেমন জানি করছে। মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছে বলে জানান। দ্রুত তাকে বাসায় যেতে বলেন। তিনি দ্রুত বের হন। বাসার নিচের মূল গেটের ভেতরে থাকা পকেট গেট খোলা ছিল। বাসার প্রতিটি দরজা খোলা ছিল। গিয়ে দেখি অরণী নিচে পড়ে আছে। আর আলভী খাটের উপরে। দু’জনকে অনেক ডাকাডাকি করি। কোন সাড়া শব্দ নেই। তখন সন্ধ্যা আনুমানিক সোয়া ছয়টা। বাড়ির নিচতলায় থাকা নিরাপত্তা প্রহরী পিন্টু জানান, তখন মাগরিবের নামাজের আযান হয়েছে। বাড়ির নিচে ওয়াক্তীয় নামাজ আদায় করার মসজিদ রয়েছে। মসজিদে বাইরের লোকজন এসে নামাজ আদায় করেন। এজন্য ওই সময়টাতে বাড়ির নিচ তলার গেট খোলা রাখা হয়। যাতে নামাজীরা অনায়াসে নামাজ আদায় করতে মসজিদে যেতে পারেন। আফরোজা মিলা আরও জানান, তাকে ফোন করার পরেই দুলাভাইকেও ফোন করেন। তাকেও ফোনে একই কথা জানান। দুলাভাই তখন বাড্ডার অফিসে। দুলাভাই স্বল্প সময়ের মধ্যে আসতে না পেরে তার বন্ধু জাহিদকে ফোন করে দ্রুত বাসায় গিয়ে ঘটনা কি তা দেখার জন্য বলেন। জাহিদুল ইসলাম তালুকদার জনকণ্ঠকে বলেন, আমি বন্ধু আজিম তখন মেরাদিয়ায় ছিলাম। আমান আমাকে ফোন করে ঘটনা জানিয়ে দ্রুত বাসায় যেতে বলে। আমি তখন আমাদের আরেক বন্ধু হ্যাপীকে ফোন করে বনশ্রীতে অবস্থিত আল রাজি হাসপাতাল প্রাইভেট লিমিটেডে সবকিছু প্রস্তুত রাখতে বলি। আমি বন্ধু আর আমার গাড়ি চালক মিজানকে নিয়ে গাড়িসহ আমানের বাসায় যাই। বাসার নিচ তলার গেট খোলা ছিল। আমরা দুজন দ্রুত লিফটে করে উঠে যাই। গিয়ে দেখি অরণী আর আলভী পড়ে আছে। আলভীকে তার ছোট খালা আফরোজা মিলার কাছে দেই। আমরা দুই বন্ধু অরণীকে নিয়ে লিফটে নামি। নিচতলায় এসে দারোয়ান ও পিন্টুকে সহায়তা করতে বলি। এরপর আমরা হাসপাতালে যাই। সে সময় আলভীর খালা ও মাও সঙ্গে ছিলেন। হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকরা খোলামেলা কোন কিছু না বললেও, হাবভাবে শিশু দুইটি মৃত বলে বুঝিয়ে দেয়। তারা শিশু দুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে পরামর্শ দেন। আমরা একটি এ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। এরপর চিকিৎসকরা সেখানে দুই শিশুকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি আরও বলেন, ভাবি নিঃসন্দেহে অনেক ভাল মানুষ। তার ভেতরে কোন দিন কোন রাগ অনুরাগ দেখিনি। যদিও তিনি পারিবারিক বিষয়াদি কোন দিনই আমাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতে না। যতদূর দেখেছি, তিনি অত্যন্ত ভাল মানুষ। এমন একজন মানুষের পক্ষে নিজের দুই সন্তানকে হত্যা করার বিষয়টি আমার বিশ্বাস হয় না। এর পেছনে আরও কোন কারণ থাকতে পারে। নিহতদের খালা আফরোজা মিলা আরও বলেন, মৃত ঘোষণার পর চিকিৎসক ও তার আশপাশের লোকজন শিশু দুটি খাবারের বিষক্রিয়ায় মারা গেছে বলে বলতে থাকেন। এরপর থেকেই আপা (নিহতদের মা) বিষক্রিয়া দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে আসছিল। র‌্যাব আটক করার পর আপা নিজেই তার দুই সন্তানকে হত্যা করেছে বলে দাবি করে। যদিও আপার এমন কথা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। এ ব্যাপারে নিহতদের পিতার বন্ধু আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান দিপু জনকণ্ঠকে বলেন, একজন মায়ের পক্ষে একাই ত্চ্ছু কারণে দুই সন্তানকে হত্যার করার বিষয়টি বিশ্বাস করতে পারছি না। যতদূর জানি, ভাবি অত্যন্ত ঠা-া মানুষ। তিনি মানসিক রোগী কিনা তা চিকিৎসকরা বলতে পারবেন। তবে যতদিন যাবত চিনি, তাতে তিনি মানসিক রোগী বলে কখনো মনে হয়নি। লাশ দুটির পোস্টমর্টেমকারী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ জনকণ্ঠকে বলেন, নিহতদের নাকে, মুখে, গালে, হাতে পায়ে প্রচুর আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। দেখে বুঝা যায় নখের আঁচড়। গলায়ও আঙ্গুলের ছাপ রয়েছে। স্পষ্টই বোঝা যায়, দুই শিশুকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। তবে একার পক্ষে বারো থেকে তেরো বছর বয়সী একজনকে শ্বাসরোধে হত্যা করা প্রায় অসম্ভব। বিশেষ করে ওই শিশু যদি চেতন থাকে তাহলে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কারণ যেকোন বয়সের মানুষকেই হত্যার সময় মানবদেহে এক্সটা পাওয়ার (বাড়তি শক্তি) চলে আসে। যার পরিমাণ অনেক। মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে মানুষ মরণ কামড় দিয়ে থাকে। শরীরের সঙ্গে যোগ হওয়া বাড়তি শক্তি তাকে আরও বলশালী করে তুলে। এজন্য এ বয়সের একজনকে অনেক বলশালীর মানুষের একার পক্ষেও শ্বাসরোধে হত্যা করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তবে একার পক্ষেও সম্ভব, তবে সেক্ষেত্রে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে চেতনানাশক কোন কিছু খাওয়াতে হবে। যাতে সে দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর সম্ভব। সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় এ বয়সের একজনের, তাও আবার মায়ের পক্ষে হত্যা করা প্রায় অসম্ভব। এই চিকিৎসক আরও বলেন, নিহতের খাবারের রাসায়নিক পরীক্ষা ও ভিসেরা রিপোর্ট হাতে পেলেই হত্যাকা-ের মূল রহস্য উদঘাটন হবে। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার আনোয়ার হোসেন জনকণ্ঠকে এমনটাই জানিয়েছেন। সব রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর হত্যাকারী ও হত্যার মোটিভ পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে। তার আগে হত্যাকারী ও হত্যার কারণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
×