ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আইন কমিশন এ পর্যন্ত ১৩৬ প্রতিবেদন পাঠিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ে

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি অপরাধ আইন হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৬ মার্চ ২০১৬

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি অপরাধ আইন হচ্ছে

বিকাশ দত্ত ॥ আইন কমিশন গঠিত হওয়ার পর ২০ বছরে এ পর্যন্ত ১৩৬টি প্রতিবেদন আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে কমিশন, যার মধ্যে ৩৩টি সম্পূর্ণ বা আংশিক বাস্তবায়ন করেছে মন্ত্রণালয়। কমিশন বিদ্যমান আইন সংস্কারের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে কমিশনের বেশকিছু সুপারিশ আইন মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছে। আইন কমিশন আশা করছে শীঘ্রই আরও কিছু আইন সংস্কারে লক্ষ্যে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। কমিশন বর্তমানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইনের খসড়া তৈরির কাজ শুরু করেছে। সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার। আইন কমিশন সূত্রে এ খবর জানা গেছে। কমিশন যে সমস্ত আইন নিয়ে কাজ করেছে তার মধ্যে রয়েছেÑ মানসিক স্বাস্থ্য আইন, শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধ আইনসহ কয়েকটি আইন তৈরি ও যুগোপযোগী করা, আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদন ও বাস্তবায়ন আইন, অর্থঋণ আইন, চিকিৎসাসেবা আইন, খাদ্যের ওপর সকল মানুষের অধিকার আইন, বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংশোধন আইন, আমলযোগ্য মামলা দায়েরের সঙ্গে পুলিশকর্তৃক অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার বা হয়রানি রোধকল্পে প্রয়োজনীয় বিধান প্রণয়ন, ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, প্রস্তাবিত নাগরিক আইন, আইন কমিশন বিধিমালা, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি আইন, সুপ্রিমকোর্টের বিচারক নিয়োগে আইন ইত্যাদি। ২০১৪ সালে মোট ৯টি আইন সংশোধনের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। আইনগুলোর মধ্যে রয়েছে-The Territorial Waters Maritime Zones Act 1974,, অনগ্রসর নাগরিকগণের অধিকার সুরক্ষা, সমান সুযোগ ও পূর্ণ অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন, খাদ্যের বিষয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ সংশোধন, রাষ্ট্র বনাম মিসেস হেলেনা পাশা ও অন্যান্য (ড্রাগ কেস নং ৪/১৯৯৩) মামলা নিষ্পত্তিতে অস্বাভাবিক বিলম্বের কারণ অনুসন্ধান প্রতিবেদন ও সুপারিশ, ময়মনসিংহ জেলা জাজশিপে জট নিরসন গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্র্কে প্রতিবেদন, The The state acquisition and tenancy act (act xxv111 of 1950) ১৯৫০ সংশোধনকল্পে আইন কমিশনের সুপারিশ। আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদন ও বাস্তবায়ন আইন, অর্থঋণ আইন ২০০৩ সংশোধন করার জন্য সুপারিশ। এছাড়া সাক্ষ্য আইন ১৮৭২, মানসিক স্বাস্থ্য আইন, চিকিৎসাসেবা আইন, রাইট টু ফুড, শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধ আইন এবং স্থানীয় সরকারের ওপর যে আইন আছে সেগুলোও সংশোধনের জন্য কমিশন কাজ করেছে। বর্তমানে কমিশন ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন ২০১৬’ খসড়া আইন প্রস্তুতের জন্য কাজ শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতামত ও পরামর্শসমূহ পর্যালোচনা করে খসড়া আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। মুক্তিসংগ্রামের আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, জনসাধারণকে হত্যাসহ অন্যান্য ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা ছোট করে বা ভিন্ন ব্যাখ্যার মাধ্যমে সমর্থন করা প্রকারান্তরে স¦াধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অবমাননা করার সামিল। অনেক দিন ধরে মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন সংগঠন, সুশীল সমাজ, অধ্যাপক, আইনজীবীসহ সমাজের বিভিন্ন পেশা ও আপামর জনগণের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অস্বীকার ও বিকৃতি রোধে খসড়া আইন তৈরি করার অনুরোধ পেয়ে আসার পরই কমিশন খসড়া আইন তৈরির কাজে হাত দিয়েছে। জাতীয় মুক্তির ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ সৃষ্টির ঐতিহাসিক সত্য ঘটনাসমূহ (ঈষবধৎষু ঊংঃধনষরংযবফ ঐরংঃড়ৎরপধষ ঋধপঃং) আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ভিত্তি। এ সকল বিষয় অস্বীকার, খ-িত, আধা-সত্য প্রতীয়মান, বিকৃত করে প্রচার-প্রকাশ বা সমর্থন করা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সংগ্রাম ও অস্তিত্বকে অস্বীকার করার নামান্তর। কমিশন দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ বিষয়ে গবেষণা শুরু করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ বিষয়ে প্রচলিত আইন, রীতিনীতি, বিচার কার্যক্রম পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গণহত্যাকে অস্বীকার করা বা অন্য কোনভাবে সমর্থন করা সংশ্লিষ্ট দেশসমূহ আইনী কাঠামোর মাধ্যমে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। বর্তমানে বিশ্বের বাইশটি রাষ্ট্রে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে এবং প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধ অপরাধসহ অন্যান্য অপরাধকে সমর্থন, প্রচার, প্রসারণ করাকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। ইউরোপের একাধিক রাষ্ট্রে সংশ্লিষ্ট আইনে করা মামলায় একাধিক আসামিকে শাস্তি প্রদানের নজির রয়েছে। দীর্ঘ গবেষণার পর আইন কমিশন এ বিষয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন, ২০১৬-এর খসড়া প্রস্তুত করেছে। খসড়া আইনে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংক্রান্ত ঐতিহাসিক সত্য বিষয়সমূহের কোন ধরনের অবমূল্যায়ন, অপব্যাখ্যা, ভুল ব্যাখ্যা, অপপ্রচার, অবনমন, বিকৃতি, অবমাননা, বিদ্বেষ প্রকাশ, মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত অপরাধমূলক কার্যক্রমের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শণ করা বা প্রচারণা চালানো বা কোন ধরনের সমর্থন, অথবা গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধসমূহের বিচার কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অপরাধসমূহের বিচার দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তির বিধানসহ কারাদ- ও অর্থদ-ের বিধান এবং অপরাধসমূহ তদন্ত ও বিচারের জন্য তুলনামূলক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও বিচারককে দায়িত্ব প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। পৌনঃপৌনিক অপরাধের জন্য সাজার পরিমাণ দ্বিগুণ করার প্রস্তাব রয়েছে।
×