ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তুরিন আফরোজ

ট্রাইব্যুনালে মীর কাশেমের ফাঁসির দ-ের কারণ

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ৬ মার্চ ২০১৬

ট্রাইব্যুনালে মীর কাশেমের  ফাঁসির দ-ের কারণ

৮ মার্চ সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক ফাঁসির দ-প্রাপ্ত মীর কাশেমের আপীলের রায় ঘোষণা করবেন। কিন্তু এরই মধ্যে বাতাসে ভাসছে নানা কথা। এমন কথার সূত্রপাত হয়েছে যে কারণে তা হলো- প্রকাশ্য আদালতে বলা হয়েছে- ‘মীর কাশেমের মামলাতে প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা অদক্ষভাবে মামলা তদন্ত ও পরিচালনা করেছেন’। আরও বলা হয়েছে, ‘এই মামলা নিয়ে অনেক রাজনীতি করেছেন’। এরূপ বক্তব্যে মীর কাশেমের রায় নিয়ে ইতোমধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে। যদিও ৮ মার্চ এখনও আসেনি, আমরা কেউ জানি না সত্যিকারের মীর কাশেমের মামলায় কি রায় আসতে যাচ্ছে, তথাপি টবি ক্যাডম্যানের মতো লবিস্টরা আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে ইতোমধ্যেই নেতিবাচক প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। যুক্তি হিসেবে তারা তুলে ধরেছেন যে, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন যে, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার ‘মানহীন’ এবং ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। তর্কের খাতিরে তর্ক করাই যায়, এমনকি কুতর্কও। কিন্তু আসলে অদক্ষ-অযোগ্য প্রসিকিউশন এবং তদন্ত কর্মকর্তা কি করে তিনজন বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ সুপ্রীমকোর্টের মাননীয় বিচারপতিদের চোখে ধুলো দিয়ে মামলা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে মৃত্যুদ- নিশ্চিত করল- এটা নিঃসন্দেহে গবেষণার দাবিদার। যদি তা-ই হয় তবে কি ধরে নিতে হবে অদক্ষ-অযোগ্য প্রসিকিউশন এবং তদন্ত কর্মকর্তার অযোগ্যতা, অদক্ষতা ধরার মতো কৌশলী ক্ষমতা মাননীয় বিচারপতিদের ছিল না? তবে কি এটাই সত্য প্রমাণিত হচ্ছে যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিচার করার আইনী ক্ষমতা নেই? এসব উত্তর খুঁজতে গেলে একটু জানা দরকার, ট্রাইব্যুনালের রায়ে আসলে কি কারণে মীর কাশেমকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছিল। এই প্রেক্ষিতে চারটি বিষয়ের অবতারণা জরুরী। ১. তদন্তের মান মীর কাশেমের আপীল মামলাতে তদন্তের মান নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলেও ট্রাইব্যুনালের রায়ের ৬৬৫ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে,ÒOn total appraisal, we do not find anything flawed in the investigation task. অর্থাৎ ‘সার্বিক বিবেচনায়, তদন্ত কাজে আমরা (ট্রাইব্যুনাল) কোন ত্রুটি খুঁজে পাইনি’। ঐ একই অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে, ‘The tribunal notes that the Investigation Officer [PW 24], in compliance with the norms and provisions contemplated in the Act of 1973 and the ROP, carried out its investigation on completion of which he duly submitted ÔreportÕ before the Chief Prosecutor’. অর্থাৎ ‘ট্রাইব্যুনালের কাছে পরিলক্ষিত হয়েছে যে, (এই মামলার) তদন্ত কর্মকর্তা ১৯৭৩ সালের আইন ও সংশ্লিষ্ট কার্যবিধি অনুসরণ করেই তদন্ত কার্য সম্পন্ন করেছেন এবং যথাযথভাবে চীফ প্রসিকিউটরের কাছে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করেছেন’। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, তদন্তের মান নিয়ে ট্রাইব্যুনালের মাননীয় বিচারপতিগণ দ্ব্যর্থহীনভাবে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। ২. সাক্ষ্যের মান মীর কাশেমের মামলাতে যে সাক্ষ্য উপস্থাপন করা হয়েছে তার মান নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে মোট ২৪ জন সাক্ষী মীর কাশেমের বিরুদ্ধে আনিত মোট ১৪টি চার্জের সপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করেছিলেন। এই ২৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ০১ জন ছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা, ৩ জন ছিলেন সিজার লিস্ট সাক্ষী এবং অন্য ২০ জন ছিলেন সাধারণ সাক্ষী। ২০ জন সাধারণ সাক্ষীর ১৪ জনই ছিলেন ভিকটিম সাক্ষী এবং অন্য ৬ জন ছিলেন ভিকটিম পরিবারের সদস্য। ১৪ জন ভিকটিম সাক্ষী ডালিম হোটেলে নির্যাতনের ব্যাপারে নিজেদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এই সাক্ষীদের সাক্ষ্যে মাননীয় ট্রাইব্যুনাল প্রমাণ পেয়েছেন ১৯৭১ সালে ডালিম হোটেলের আল বদর নির্যাতন কেন্দ্রে মীর কাশেমের উপস্থিতি ও সম্পৃক্ততা। যে ২টি চার্জে মীর কাশেমকে মৃত্যুদ- দিয়েছেন মাননীয় ট্রইব্যুনাল, এই দুটো চার্জে অন্তত ৫ জন করে চাক্ষুষ সাক্ষী উপস্থাপন করা হয়েছিল। মাননীয় ট্রাইব্যুনালের রায় পড়লে এতটুকু নিশ্চিত হওয়া যায় যে মীর কাশেমের মামলাতে সাক্ষ্যের মানের দিক থেকে অপ্রতুলতা ছিল না। এছাড়া দালিলিক প্রমাণেও মীর কাশেমের অপরাধ সম্পৃক্ততার বিষয়টি সুষ্ঠুভাবে ট্রাইব্যুনালের রায়ে ফুটে উঠেছে। ৩. আল বদর নির্যাতন কেন্দ্ররূপে ‘ডালিম হোটেল’ ডালিম হোটেল যে আল বদর নির্যাতন কেন্দ্র ছিল তা মাননীয় ট্রাইব্যুনালের রায়ে সুষ্ঠুভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। এই ব্যাপারে প্রসিকিউশন যে যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন (রায়ের ৬৪ অনুচ্ছেদ) তা সর্বসম্মত মতে মাননীয় ট্রাইব্যুনালের রায়ে গৃহীত হয়েছে। প্রসিকিউশন রেফারেন্স হিসেবে দুটি মামলা উপস্থাপন করেছিল। একটি ছিল ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের অধীনে BELSEN CONCENTRATION CAMP CASE| আর অন্যটি ছিল ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের অধীনে DACHAU CONCENTRATION CAMP CASE। এই দুইটি মামলার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, যদি কোথাও কোন নির্যাতন কেন্দ্র স্থাপন করা হয় তখন ঐ নির্যাতন কেন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল অপরাধী ব্যক্তিরই শাস্তি হওয়া আবশ্যক। এমনকি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি কাউকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্যাতন না-ও করে থাকে, তার পরেও তার শাস্তি হতে হবে। কারণ- সে একটি সংঘবদ্ধ অপরাধ (ঙৎমধহরুবফ ঈৎরসব) এর সঙ্গে সংযুক্ত। প্রসিকিউশনের যুক্তি ছিল ডালিম হোটেল আল বদর ক্যাম্প হিসেবে একটি নির্যাতন কেন্দ্র ছিল। আর তাই এই নির্যাতন কেদ্রের সঙ্গে মীর কাশেমের সম্পৃক্ততা, পরিচালনা এবং উপস্থিতি তাকে একটি (ঙৎমধহরুবফ ঈৎরসব)-এর বড় অংশীদার করে তুলেছে। মাননীয় ট্রাইব্যুনালের রায়ে ৬৩৫ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, ÒThus, the AB Camp at Dalim Hotel was a criminal enterprise of which the accused Mir Quasem Ali was a Ôboss' Accused’s active inducement, approval and endorsement effectively contributed to the commission of all those criminal activities carried out there in furtherance of common purpose' অর্থাৎ “সুতরাং, ডালিম হোটেলে স্থাপিত আল বদর ক্যাম্প ‘ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ’ ছিল যেখানে অভিযুক্ত মীর কাশেম আলী ছিলেন একজন ‘বস’। তার সক্রিয় প্ররোচনা, অনুমোদন এবং সমর্থন সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ঐ নির্যাতন কেন্দ্রে সংঘটিত সকল ধরনের অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল।” ৪. অপরাধের দায়বদ্ধতা মীর কাশেমের অপরাধের দায়বদ্ধতা নিয়ে মাননীয় ট্রাইব্যুনাল দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করেছেন। একটি হচ্ছে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি বা উর্ধতন নেতৃত্বের দায়ভার (রায়ের ৬৩৫ অনুচ্ছেদ)। অন্যটি হচ্ছে জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ (ঔঈঊ) বা যৌথ দায়বদ্ধতা (রায়ের ৬৪৬ অনুচ্ছেদ)। যৌথ দায়বদ্ধতা প্রমাণ করার জন্য ৩টি বিষয় জরুরী। (১) একটি কমন প্ল্যান, ডিজাইন অথবা উদ্দেশ্যের উপস্থিতি; (২) সেই প্ল্যানের অংশ হিসেবে অপরাধীর অপরাধ সংঘটনে অংশগ্রহণ; এবং (৩) অপরাধীর অপরাধ সংঘটনের অভিপ্রায়ের উপস্থিতি। মাননীয় ট্রাইব্যুনাল এই সকল বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণভাবে বিবেচনা অথবা আমলে নিয়েই মীর কাশেমের অপরাধের দায়বদ্ধতা নিরূপণ করে মৃত্যুদ- দিয়েছেন। মীর কাশেমের সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির দায়ভার রায়ের ৬৩৫ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে রায়ের ৬৫৯ অনুচ্ছেদে মাননীয় ট্রাইব্যুনাল উল্লেখ করেছে তার যৌথ দায়বদ্ধতার কথা। এখানে বলা হয়েছে, “'On cumulative evaluation of evidence, circumstances it stands proved too that the accused Mir Quasem Ali took Ôconsenting partÕ in the commission of the system cruelties and is found to have had Ôconnection with plans and enterprise’… in the commission of crimes and he was affiliated with the enterprise or group of AB members engaged in the activities in committing crimes at the AB detention and torture camp … Accordingly, accused Mir Quasem Ali is held criminally responsible under section 4(1) and 4(2) of the Act of 1973 for the commission of crimes proved.Ó সবশেষে বলতে চাই, ট্রাইব্যুনালের রায়ের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবেন মাননীয় আপীল বিভাগ। তবে মাননীয় আপীল বিভাগ যেই সিদ্ধান্তই নিক না কেন তার বিস্তারিত যৌক্তিক ব্যাখ্যা আমরা অবশ্যই আপীল বিভাগের রায়ে খুঁজে পাব। লেখক : আইনের অধ্যাপক, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি
×