ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সীমান্ত বন্দরে সনদ পেতে নানা ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয় ব্যবসায়ীদের

অশুল্ক বাধায় উত্তর-পূর্ব ভারতে ব্যবসা বাণিজ্যে গতি আসছে না

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ৬ মার্চ ২০১৬

অশুল্ক বাধায় উত্তর-পূর্ব ভারতে ব্যবসা বাণিজ্যে গতি আসছে না

তৌহিদুর রহমান ॥ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তঃসংযোগ ধীরে ধীরে বাড়লেও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এখনও অশুল্ক প্রতিবন্ধকতা বিরাজ করছে। সেখানকার সীমান্তে অবকাঠামোগত উন্নয়নেও পিছিয়ে রয়েছে উভয় দেশ। তবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে আন্তঃসংযোগ বাড়লে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো সম্ভব হবে বলে অভিমত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে আর্থ-সামাজিক, ব্যবসায়িক, যোগাযোগ বন্ধন বাড়াতে চায় বাংলাদেশ। সম্প্রতি অসমে বাংলাদেশ উপহাইকমিশন, ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি বাস সেবা, ত্রিপুরা ভিসা অফিসকে সহকারী হাইকমিশনে উন্নীত, আখাউড়া-আগরতলা রেললাইন চালু ইত্যাদির মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে সংযোগ বেড়েছে। তবে এসব বাড়লেও সে অনুযায়ী ব্যবসা-বিনিয়োগ এখনও প্রসারিত হয়নি। সেভেন সিস্টার্স হিসেবে পরিচিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্থলবন্দরে পণ্য ওঠানামা হচ্ছে এখনও খোলা আকাশের নিচে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানি বাড়াতে অবকাঠামো উন্নয়নও সেভাবে হয়নি। এছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন সীমান্তে যাওয়ার জন্য সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনও ভাল নয়। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের ভারতের নানা সনদ পেতে স্থলবন্দরে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয়। এই অপেক্ষা দু’একদিন নয়, কোন কোন সময় এক থেকে দেড় মাস পর্যন্ত অপেক্ষার পর ভারতে পণ্য প্রবেশের অনুমতি পায়। ইন্দো-বাংলা চেম্বার অব কমার্স ত্রিপুরার সভাপতি প্রশান্ত ভট্টাচার্য গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আখাউড়া স্থলবন্দর ইন্টিগ্র্যান্ট চেকপোস্ট চালু হওয়ায় এখন নানা নিয়ম কানুন চালু হয়েছে। নিয়মের বেড়াজালে পড়ে উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়ে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। যে কারণে ব্যবসায় ভাটা পড়েছে। আগে বাংলাদেশ থেকে বছরে ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার পণ্য যেত ত্রিপুরায়। এখন তা ১০০ থেকে ১৫০ কোটিতে নেমে এসেছে। এতে বাংলাদেশেরই ক্ষতি হচ্ছে বেশি। ত্রিপুরা থেকে বছরে মাত্র এক থেকে দেড় কোটি টাকার পণ্য আসে বাংলাদেশে। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ও ত্রিপুরার মধ্যে বাণিজ্য শুরু হয়। এরপর ১৯৯৯ সালে সেখানে প্রাণ কোম্পানি রফতানি শুরু করে। প্রাণ ছাড়াও আবুল খায়ের গ্রুপ, আকিজ ও আল-আমিনসহ অনেক কোম্পানি ফ্রুট জুস, বিস্কুট-পাউরুটি ও অন্য খাবার রফতানি করে। এছাড়াও সিমেন্ট ও ব্যাটারিও রফতানি করা হয়। ধীরে ধীরে এসব পণ্য উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। তবে বাণিজ্য বাধা এখনো রয়ে গেছে। ব্যবসাবাণিজ্য প্রসারে বিভিন্ন বাধা থাকলেও আন্তঃসংযোগ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে উভয় দেশ। অসমের গুয়াহাটিতে বাংলাদেশের নতুন উপহাইকমিশন চালুর বিষয়ে ভারতের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক সম্মতি দেয়া হয়েছে। সেখানে খুব শীঘ্রই একটি উপহাইকমিশন চালু হবে। অসম, মেঘালয়, মিজোরাম, মনিপুর, অরুণাচল ও নাগাল্যান্ডের কনস্যুলার সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি এই নতুন উপ হাইকমিশনের এখতিয়ারে থাকবে। ফলে এসব রাজ্যের লোকদের বাংলাদেশের ভিসা নেয়ার জন্য ত্রিপুরা বা কলকাতা যেতে হবে না। গুয়াহাটি থেকে খুব সহজেই বাংলাদেশের ভিসা পেয়ে যাবেন। এছাড়া ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশের ভিসা অফিসকে সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ে উন্নীত করা হয়েছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে আখাউড়ার সঙ্গে ভারতের আগরতলার রেল সংযোগ চালু হচ্ছে। ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশন ফর ট্রান্সফর্মিং ইন্ডিয়া (এনআইটিআই) এ সময়ের মধ্যে রেলপথের কাজ সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগরতলা-আখাউড়া ১৫ কিলোমিটার রেলপথের ১০ কিলোমিটার বাংলাদেশের ভূখ-ে হবে। বাকি ৫ কিলোমিটার রেললাইন ত্রিপুরায় হবে। ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (ইরকন) এ রেললাইন নির্মাণের কাজ করবে। ভারতের নর্থইস্ট ফ্রন্টিয়ার রেলওয়ে (এনএফআর) এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। আগরতলা-আখাউড়া রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ কোটি মার্কিন ডলার। ভারত সরকার এ খরচ বহন করবে। বাংলাদেশ অংশে ১০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের খরচ জোগাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আর ত্রিপুরা অংশে পাঁচ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের খরচ দেবে ভারতের রেল মন্ত্রণালয়। মোদির ঢাকা সফরের পর গত ১৮ জুন এনআইটিআইয়ের এক বৈঠকে রেলপথের ব্যয় নির্বাহের বিষয়ে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওই বৈঠকেই ২০১৭ সাল নাগাদ এ রেলপথের কাজ সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত হয়। আগরতলা-আখাউড়া রেলপথ হলে ভারতের দুটি অংশের দূরত্ব কমে আসার পাশাপাশি উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে ভারতের মূল ভূখন্ডের সংযোগ দৃঢ় হবে। ত্রিপুরার পরিবহনমন্ত্রী মানিক দে জানিয়েছেন, আগরতলা-আখাউড়া রেলপথ বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের আর্থ-সামাজিক, বাণিজ্যিক ও ব্যবসায়িক বন্ধন জোরদার হবে। একই সঙ্গে ত্রিপুরা দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোয় যাওয়ার করিডরে রূপান্তর হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকালে ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি ও কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস উদ্বোধন করা হয়। এখন পুরোদমে এই দুই রুটের বাস সেবা চালু হয়েছে। প্রতিদিন দুই দেশের লোকজন এসব বাসে যাতায়াত করছেন। এতে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ যেমন বাড়ছে, তেমন পর্যটন শিল্পেরও প্রসার ঘটছে। ২০০২ সালে ঢাকা-শিলং বাসসেবা চালু করার প্রস্তাব থাকলেও ১২ বছর ধরে এর বাস্তবায়ন হয়নি। তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির ঢাকা সফরের মধ্যে দিয়ে ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি পর্যন্ত সরাসরি বাস চালু করা হয়। ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করে সিলেট হয়ে মেঘালয়ের শিলং দিয়ে অসমের গুয়াহাটি চলাচল করছে এসব বাস। ভারত সরকার বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ত্রিপুরার দূরত্ব কমাতে চায়। ত্রিপুরার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের যোগাযোগ ছিল শিলিগুড়ি হয়ে। কিন্তু শিলিগুড়ি করিডরে গেলে আগরতলা থেকে কলকাতার দূরত্ব কমবে এক হাজার ৭০০ কিলোমিটার। কিন্তু বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে আগরতলা-ঢাকা-কলকাতা বাস সেবা প্রতিষ্ঠা হওয়ায় এ দূরত্ব কমে ৪৫০ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। আর এই সেবা চালুর জন্য বাংলাদেশের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে ত্রিপুরা সরকার। তবে ঢাকা-আগরতলা-গুয়াহাটি-ঢাকা বিমান চালুর জন্য দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। এই রুটে বিমান চালু হলে আরও সহজেই ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ আরও সহজ হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, অসম, ত্রিপুরা ও ঢাকার মধ্যে বাসের পাশাপাশি বিমান পথে যোগাযোগ বাড়লে আন্তঃসংযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যও বাড়বে দ্বিগুণ।
×