ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

টিলাভূমি চাষের আওতায় আনা হলে বিদেশেও পাঠানো সম্ভব

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৫ মার্চ ২০১৬

টিলাভূমি চাষের আওতায় আনা হলে বিদেশেও পাঠানো সম্ভব

সালাম মশরুর ॥ সিলেট কমলালেবুর জন্য প্রসিদ্ধ- এক সময়ের সর্বজনস্বীকৃত ‘খ্যাতির’ এই বাক্যটি এখন যেন ইতিহাস থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে। কালের বিবর্তনে কমলালেবুর সম্ভাবনাময় এই ক্ষেত্রটি এখন মৃতপ্রায়। এক সময় মৌসুমের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সিলেট অঞ্চলের কমলালেবুতে এ দেশের বাজার সয়লাব হয়ে থাকত অথচ এখন স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত কমলালেবু বাজারে মিললেও তা কেবল নামে মাত্র। সারা বছর পাকিস্তানের কেনু ও চীন থেকে আমদানিকৃত কমলা এদেশের বাজার দখল করে রাখে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, যথাযথ সংরক্ষণ ও বাজারজাতে সমস্যার কারণে দীর্ঘ সময়ে ধীরে ধীরে সিলেটের বাগান থেকে কমলালেবু হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না সিলেটের দীর্ঘদিনের এই ঐতিহ্য। সিলেটের জাফলংয়ের নকসিয়া, প্রতাপুর লামাসহ ৫টি খাসিয়াপুঞ্জির বিশাল এলাকায় এক সময় প্রচুর পরিমাণে কমলালেবুর চাষ হতো। পাশাপাশি সিলেটের জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ সীমান্তের ওপারে ভারতের পাহাড়ী এলাকায় কমলালেবুর অসংখ্য বাগান ছিল। অতীতে ভারতের এই অঞ্চলের উৎপাদিত কমলালেবুর অন্যতম বাজার ছিল সিলেট। সীমান্ত দিয়ে বৈধ-অবৈধভাবে বাংলাদেশে আসার পর এই কমলা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ হয়েছে। এখন ভারতের সীমান্তবর্তী পাহাড়ী এলাকায় কমলার বাগান অনেকটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা এখন মাটি কেটে পাথর, চুনাপাথর, কয়লাসহ খনিজ সম্পদ আহরণ করে অধিক অর্থ রোজগারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। একদিকে সিলেট অঞ্চলে কমলা চাষ লুপ পেয়েছে। অপরদিকে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায়ও কমলা চাষ কমে গেছে। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে কমলালেবুর আকাল চলছে। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করে সিলেট অঞ্চলের টিলাভূমিকে ব্যাপকহারে কমলা চাষের আওতায় নিয়ে আসা হলে এখানকার উৎপাদিত কমলা দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও সরবরাহ করা সম্ভব। আসাম ও মেঘালয়ের পাহাড়ী এলাকার মাঠিতে সুস্বাদু ও বড় আকৃতির কমলা চাষ হয়ে থাকে। আসাম মেঘালয়ের মাটির গুণাগুণ রয়েছে সিলেটের টিলাভূমিতেও। আদিকাল থেকে সিলেটের বিয়ানীবাজার, জৈন্তা-জাফলং, গোলাপগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, সুনামগঞ্জের ছাতক, দোয়ারাবাজার, মৌলবীবাজারের জুড়ি, কুলাউড়া শ্রীমঙ্গলে কমলা বাণিজিকভাবে উৎপাদন ও বিপণন হতো। এক সময় অনেকেই বাড়ির আঙ্গিনায় সখ করে কমলা গাছ রোপণ করতেন। নানান সমস্যার কারণে এসব অঞ্চলে কমলা চাষ একেবারে কমে এসেছে। বর্তমানে জৈন্তাপুর, বিয়ানীবাজার, বড়লেখা, জুড়িসহ কিছু কিছু স্থানে কমলার চাষ হচ্ছে তবে সেটা উল্লেখ করার মতো নয়। বিয়ানীবাজারের জলডোপ, মৌলভীবাজারের জুড়ির কমলার খ্যাতি রয়েছে। সরকারী সূত্র মতে, জুড়িতে ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে দেশী জাতের কমলা আবাদ হয়ে থাকে। এসব বাগানে এক শ’ থেকে এক হাজার গাছ রয়েছে। বিয়ানীবাজারেও কয়েকটি বাগান রয়েছে। কমলা চাষীদের মতে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কমলা উৎপাদনের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হতে সময় লাগবে না। সিলেট অঞ্চলে কমলা উৎপাদনের ব্যাপক সুযোগ ও সম্ভাবনার কথা ভেবে সরকারী উদ্যোগে বৃহত্তর সিলেটে কমলা আনারস উন্নয়নসহ সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২০০১-২০০২ অর্থবছরে ৩ বছর মেয়াদী একটি প্রকল্প চালু করা হয়। প্রকল্পের আওতায় সিলেটে চারটি জেলায় তিনটি করে উপজেলায় বরজ প্রদর্শনী করা হয়। কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিনামূল্যে চারা বিতরণ করা হয়। একই সময় তের হাজার বসতবাড়িতে ১০টি করে বিনামূল্যে চারা দেয়া হয়। তখন চাষীদের মাঝে কমলা নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ দেখা দেয়। কিšুÍ পরবর্তীতে এই প্রকল্প নিয়ে আর কোন মনিটরিং করা হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে কোন খোঁজখবর না থাকায় হারিয়ে গেছে চাষীদেরও উৎসাহ। দীর্ঘ ৭ বছর পর ফের কমলা চাষীদের নিয়ে কাজ করতে এগিয়ে এসেছে ‘আশা (এ্যাসোসিয়েশন ফর সোশাল এ্যাডভান্সমেন্ট)’ নামক বেসরকারী সংস্থা। এগিয়ে এসেছে কমলা চাষ বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানা পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে। আশায় স্বপ্ন দেখতে শুরু করছেন বিভিন্ন উপজেলার প্রান্তিক কমলা চাষীরা। নাম ‘বৃহত্তর সিলেট জেলা সমন্বিত কমলা ও আনারস চাষ প্রকল্প’ হলেও মূলত এই প্রকল্পের কাজ মৌলভীবাজার জেলার জুড়ি উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের পাহাড়ী জনপদে। এই ইউনিয়নের লালছড়া, কচুরগুল, হাওয়াছড়া, রূপাছড়া, বেলাবাড়ী, লাটিঠিলা, লাটিছড়া, কালাছড়া, শুকনাছড়া, ডোমাবাড়ি, জামকান্দি এলাকায়। জুড়ি ছাড়া কুলাউড়া ও বড়লেখা উপজেলার প্রায় ৫ হাজার হেক্টর পরিত্যক্ত পাহাড়ী জমিতে ৫ শতাধিক কমলা বাগান রয়েছে এমন তথ্য সংশ্লিষ্টদের। স্থানীয় সূত্র জানায়, গত বছরের ডিসেম্বরে জুড়ি ও বড়লেখায় পর্যায়ক্রমে ৫০ জন কমলা চাষীকে এনজিও সংস্থা আশার পক্ষ থেকে রাসায়নিক সারের বড়ি, জৈব বালাইনাশক ও সেচের উপকরণ প্রদান করা হয়। এ লক্ষ্যে চাষীদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা নেয়া হয়। আশা কর্মকর্তা জানান, জুড়ি ও বড়েলখা উপজেলায় কমলা চাষ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ক্রমান্বয়ে এর পরিধি আরও বৃদ্ধি করা হবে। বিয়ানীবাজারের জলঢূপ এলাকায় ডাঃ নিশিকান্তের বাড়ি। প্রায় চার হাজার কমলা লেবুর গাছ ছাড়াও তেজপাতা, সুপারি, কাঁঠাল, লেবু গাছ রয়েছে বাগান বাড়িতে। ডাঃ নিশিকান্তের ছেলে নিখিলেশ ভট্টাচার্য বলেন, এক সময় কমলালেবুর গাছে বাগান ভর্তি ছিল। উৎসাহ নিয়ে কমলা চাষ করেছেন তার পূর্ব পুরুষরা। শিক্ষ-দীক্ষায় এগিয়ে যাওয়া নিখিলেশ ভট্টাচার্যের পরিবারের সদস্যরা দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছেন তথাপি আজও তাদের কমলার প্রতি আগ্রহের কমতি নেই। বাড়িতে থাকেন এক ভাই, তিনিই এসব দেখভাল করেন। সিলেটের কমলা উৎপাদন সম্পর্কে কথা বললে তিনি বলেন, এই কমলা আমাদের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। যেখানেই থাকি না কেন বাড়ির কমলার কথা ভুলতে পারি না। এই বাড়িতে আমাদের সাত পুরুষের বাস। আমরা ছোট বেলা থেকেই দেখেই আসছি কমলা কিনে নিতে খাঁচা হাতে লোকদের ভিড়। এখন অবশ্য সে রকম নেই। আলাপকালে তিনি বলেন, কমলা চাষের জন্য তার বড় ভাই বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য ১৪০৫ বাংলা সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। পুরনো বাগানগুলোর বয়স ১০০-১৫০ বছর। তাই এখন নতুন চারা রোপণ প্রয়োজন। টিলা ও পাহাড়ী উঁচু নিচু ভূমিতে কমলা চাষ হয়ে থাকে। সিলেট অঞ্চলের এ সকল টিলাভূমিতে কমলা চাষের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য সরকারকে এগিয়ে আসা দরকার। সিলেটের জৈন্তাপুরে সাইট্রাক গবেষণা কেন্দ্র নামে সরকারের একটি কৃষি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ফলের উপর গবেষণা করে কৃষকদের মাধ্যমে সেটা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা থাকলেও তাদের কার্যক্রম কেবল পুঁথির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কমলালেবুর পাশাপাশি এই অঞ্চলে মাল্টা চাষেরও প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হলে এই অঞ্চলে কমলালেবুর সঙ্গে মাল্টা চাষেও আশানুরূপ সুফল পাওয়া যাবে। সিলেট অঞ্চলে কমলা চাষ করে বাগান মালিকরা আর্থিকভাবে লাভবান হতে গেলে তাদের কাছে অন্যতম একটি বিষয় হচ্ছে বাজারজাত। এই অঞ্চলে কমলালেবু অক্টোবর নবেম্বর মাসে পাকতে শুরু করে। ফল পাকার সঙ্গে সঙ্গে সেটা বাজারজাত করতে হয়। সব বাগানে এক সঙ্গে ফল পাকার কারণে তখন সংঘতভাবেই বাজারে যথাযথ মূল্য পাওয়া যায় না। চাষীদের মতে, অন্তত কিছুদিন হিমাগারে রাখার সুবিধা পাওয়া গেলে বছরের অধিকাংশ সময় বাজারে কমলা সরবরাহ করার পাশাপাশি ন্যায্যমূল্য ধরে রাখা সম্ভব। কিন্তু এই অঞ্চলে হিমাগার না থাকায় কমলা বাগান মালিকরা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অনেকেই এ কারণে কমলা চাষে উৎসাহ হারিয়েছেন। প্রতি বছর পাকিস্তান চায়না থেকে আমদানি করে দেশের বাজারে কমলা সরবরাহ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে কমলা উৎপন্ন প্রক্রিয়া সম্প্রসারিত করা হলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন হবে।
×